Ananya Podder

Classics Inspirational Others

4  

Ananya Podder

Classics Inspirational Others

টার্গেট

টার্গেট

6 mins
314


আজ ক্লাসে ইংলিশ খাতা বেড়িয়েছে | সুহানি আর অদিত্রী একই ক্লাসে পড়ে | ওদের ক্লাসে দুজন ইংলিশ টিচার ক্লাস নেন | একজন লিটারেচার পড়ান, আরেকজন ল্যাঙ্গুয়েজ |


ফার্স্ট টার্মের পরীক্ষার খাতা বেরিয়ে আজ | দুজন টিচার ভাগ করে খাতা দেখেছেন বলে, প্রথম একটা ইংলিশ পিরিয়ডে কিছু খাতা ফেরত দেন ল্যাঙ্গুয়েজ ম্যাম, আর বাকি অর্ধেক স্টুডেন্টের খাতা লাস্টের ইংলিশ পিরিয়ডে লিটারেচার ম্যাম ফেরত দেবেন বলে জানিয়েছেন |


সুহানি পরীক্ষার খাতা পেয়ে মুখ শুকিয়ে ফেললো | কারণ সে ইংলিশে পঁচাশি পেয়েছে | তার মা তাকে বলেছিল, "নব্বইয়ের কম যেন কোনোভাবেই না আসে | "


তাই সুহানির ভীষণ ভয়, বাড়ি গিয়ে মায়ের মুখোমুখি হলে সে কি বলবে মাকে?? পাশে বসা প্রিয় বন্ধু অদিত্রীর কাছে সে বলল , " আজ আমার দিনটাই খারাপ যাবে রে | বাড়ি গেলে মায়ের কাছে যা বকা খাবো না!! এমনকি মারও খেতে পারি | ভীষণ ভয় করছে রে | "


অদিত্রী অবাক হয়ে বলল, "ভয় পাওয়ার তো কোনো কারণ নেই তোর | তুই তো এখনও পর্যন্ত হাইয়েস্ট পেয়েছিস | ভয় কিসের তোর ?? "


সুহানি বলল, "মা ওসব হাইয়েস্ট টাইয়েস্ট শুনবেই না | টার্গেট দিয়ে দিয়েছিলো আমায়, মিনিমাম নাইন্টি আনতে হবে | তোর মা তোকে কত টার্গেট দিয়েছে রে ?? "


সুহানির কথা শুনে অদিত্রী খুব হাসলো | হেসে বলল, "উমম, টার্গেট বলছিস?? টার্গেট বললে বলতে হয়, খুব কম হলে শূন্য, আর খুব বেশি হলে একশো | "


সুহানি অদিত্রীর হেয়ালি বুঝতে পারলো না | সে বিস্ময় ভরে অদিত্রীর দিকে তাকাতেই অদিত্রী বলল, "আমার মা আমাকে কোনো টার্গেট দেয় না | শুধু বলে, পরীক্ষার জন্য যতটা পারা যায় তৈরী হতে নিজেকে | নাম্বার কম বেশি নিয়ে মাথা ব্যথা নেই আমার মায়ের | কোথায় ভুল করেছি, আর কেন সেই ভুলটা হয়েছে, সেটা নিজেও দেখে, আমাকেও দেখায় | আর সাবধান করে দেয়, এই একই ভুল যেন দ্বিতীয়বার না করি আমি | "


সুহানি অবাক হয়ে বলল, "সত্যিই তোর মা তোকে বকে না, তুই কম নাম্বার পেলে ?? "


অদিত্রী বলল, " না রে, সত্যিই আমার মা আমাকে বকে না | "


টিফিন পিরিয়ডেও সুহানি সেই একই ভয় পোষণ করাতে অদিত্রী বলল, "তুই তো এখনো সবচেয়ে বেশি পেয়ে বসে আছিস | সেটাই বলবি গিয়ে তোর মাকে | "


সুহানি আনমনা হয়ে বলল, "লাস্ট পিরিয়ডে তোদের যখন খাতা বেরোবে, তখন তোদের মধ্যে যদি কেউ আমার চেয়ে বেশি পেয়ে যায়,, তাহলে কি বলবো মাকে?? "


অদিত্রী চাওমিন মুখে পুরতে পুরতে বলল, "আগে কাউকে তোর চেয়ে বেশি নম্বর তো পেতে দে | "


সুহানি যে ভয় পেয়েছিলো, সেটাই হোলো | লাস্ট পিরিয়ডে লিটারেচার ম্যাম যখন ইংলিশ খাতা দিলেন বাকি স্টুডেন্টদের, তখন দেখা গেলো সুহানিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে অদিত্রী | ইংলিশে তার প্রাপ্ত নম্বর বিরানব্বই, এবং এই নম্বরটা ক্লাসে সে একাই পেয়েছে |


বন্ধুর নম্বর দেখে সুহানি প্রায় কেঁদেই ফেললো, "গেলি তো আমাকে টপকে !! এবার তো বাড়ি গিয়ে মাকে এটাও বলতে পারবো না, যে, আমি হাইয়েস্ট পেয়েছি | "


অদিত্রী বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বলল, "তাতে কি হয়েছে ?? তুই তো সেকেন্ড হাইয়েস্ট হয়েছিস | এটাই বা কম কি রে?? "


সুহানি মুখ শুকনো করে বলল, " মা এসব কথা শুনবেও না, বুঝবেও না | "


তারপর হঠাৎ করেই আবার অদিত্রীকে জিজ্ঞেস করে বসলো, " তুই কি করে এতো নম্বর পেলি ?? ক্লাসে আমরা দুজনেই তো সমান ভাবে পড়া বলি | "


অদিত্রী একটু হেসে বলল, "কারণ তুই টার্গেট নিয়ে পরীক্ষায় বসিস, তাই একটা এক্সট্রা প্রেসার তোর উপরে কাজ করে | আমার কাছে কোনো টার্গেট থাকে না | আমি ফ্রি ভাবে নিজের বেস্টটা দেওয়ার চেষ্টা করি, ব্যস | "


অদিত্রীর লাস্ট কথাটা লিটারেচার ম্যাম সঙ্গীতার কানে গেলো |


পিটিএম এর দিন সব সাবজেক্ট টিচাররা বসে আছেন | দেখা গেলো, সব বিষয়ে ভালো মার্কস পেলেও অঙ্কতে অদিত্রী ছিয়াত্তর পেয়েছে যেটা অদিত্রীর মোটেও পাওয়া উচিত ছিল না | কারণ অদিত্রী অঙ্কে ভীষণ ভালো, শুধুমাত্র কিছু ক্যালকুলেশনে ভুল করে বেশ কিছু নম্বর কম পেয়ে গিয়েছে সে |


সঙ্গীতা ম্যাম শুনেছিলেন, অদিত্রী বলেছিলো, তার কাছে কোনো টার্গেটের চাপ থাকে না বলেই সে সবসময় তার বেস্টটা দিতে পারে |


সঙ্গীতা ম্যাম হঠাৎ করেই বলে উঠলেন, "মিসেস ব্যানার্জী, আপনার কি মনে হয় না, আপনি অদিত্রীকে একটু বেশি ছাড় দিয়ে রেখেছেন ?? "


অভিজ্ঞা ব্যানার্জী অদিত্রীর মা | তিনি সঙ্গীতা ম্যামের প্রশ্নে বললেন, "অদিত্রী তো খোটায় বেঁধে রাখা গোরু নয়, যে তাকে বেঁধে রাখবো বা চোখে চোখে রাখবো !! আপনি কি রকম ছাড়ের কথা বলছেন যদি এটা একটু পরিষ্কার করে বলেন আমায় প্লিজ  | "


সঙ্গীতা ম্যাম বললেন, "আমি অদিত্রীর কাছে শুনেছি, আপনি ওকে কখনো কোনো টার্গেট দেন না কোনো পার্টিকুলার মার্কস পাওয়ার জন্য | কথাটা কি ঠিক ?? "


অভিজ্ঞা বলল, "হ্যাঁ, একদম ঠিক " |


সঙ্গীতা ম্যাম এবার বললেন, "আপনার এই মানসিকতার জন্যই কি অদিত্রী অঙ্কে কম পেল বলে আপনার মনে হয় না ?? অদিত্রী এটা জানে যে, কম নম্বর পেলেও তাকে বাড়িতে বকা খেতে হবে না | এটাই কি অদিত্রীর অঙ্কে খারাপ করার কারণ নয় ?? "


অভিজ্ঞা সঙ্গীতা ম্যামের কথা শুনে একটু হাসলো, তারপরে বলল, "আচ্ছা ম্যাম, আপনার মনে আছে কি, আপনি ক্লাস সেভেনে থাকতে কোন বিষয়ে কত নম্বর পেয়েছিলেন ?? এখানে বসে থাকা কেউ কি বলতে পারবেন স্কুলে পড়া কালীন কোনো বিশেষ একটি ক্লাসে প্রাপ্ত পরীক্ষার নম্বর ?? আমি জানি, কেউ বলতে পারবেন না | অথচ, দেখুন, আপনি আজ এতো বড়ো একটা স্কুলের শিক্ষিকা | এখানে উপস্থিত সবাই নিজের নিজের জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত | তাহলে স্কুলে পড়া কালীন ছেলেমেয়েদেরকে মার্কসের পিছনে ছোটানো কেন ?? এই বয়সটা তো ওদের শেখার সময় | আর শিখতে গিয়ে ভুল কে না করে, বলুন ?? অদিত্রীকে আমি কেন টার্গেট দেবো | টার্গেট যদি ঠিক করতেই হয়, তবে সে টার্গেট অদিত্রী নিজে তৈরী করবে, নিজের জন্য, অত্যন্ত ভালোবাসার সাথে | আর অঙ্কে ছিয়াত্তর পাওয়াটা খুব কমও নয় | বরং, ভালোই হোলো কম পেয়ে, অদিত্রী আরও বেশি যত্নশীল হবে অঙ্ক কষার সময় | "


সঙ্গীতা ম্যাম এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন | তারপরে ক্লাসরুমে বসে থাকা সব অভিভাবক অভিভাবিকার সামনে বলে উঠলেন, "আমি ইচ্ছে করেই এমন একটা প্রশ্ন করেছিলাম মিসেস ব্যানার্জীকে | উনার উত্তরটা আপনাদেরকে শোনাবো বলে |


আপনারা সবাই ওই বাচ্চাগুলোকে টার্গেট ধরে দেন | কি হয় তাতে জানেন ?? বাচ্চাগুলোর মধ্যে ট্রমা তৈরী হয়, পরীক্ষার ট্রমা, বেশি নম্বর পাওয়ার ট্রমা | তার থেকেই জানা জিনিসগুলোকে সুন্দর করে খাতায় ফুটিয়ে তুলতে পারে না ওরা |


ওরা পরীক্ষা দেয় নিজেদের জন্য নয়, আপনাদের জন্য | জানবেন, ভালো নম্বরের পিছনে ওরা ছুটে বেড়ায় শুধু আপনাদের খুশি করার জন্য, নিজেদের খুশির জন্য নয় | তাই, একসময় পড়াশোনাটা বাচ্চাগুলোর কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায় |


মনে রাখবেন, মার্কস -- জাস্ট এ নাম্বার | টার্গেট কখনোই এটা হওয়া উচিত নয়, যে স্টুডেন্ট কত মার্কস পেল পরীক্ষার খাতায় | টার্গেট এটা হওয়া উচিত স্টুডেন্ট কতটা শিখলো | তাই এবার থেকে প্লিজ বাচ্চাগুলো পরীক্ষার খাতা বাড়িতে নিয়ে গেলে আর বকবেন না ওদের | বরং বলবেন, "দুজনে মিলে আরেকটু বেশি প্রিপেয়ার হবো এর পরের পরীক্ষার জন্য | ".... "


সঙ্গীতা ম্যামের কথায় উপস্থিত সব অভিভাবক অভিভাবিকা বোধহয় লজ্জা পেলেন তখন, কিন্তু শিক্ষা নিলেন কতটুকু তা তো ভবিষ্যতই বলবে |


পিটিএম থেকে বেরিয়ে যাবার সময় সঙ্গীতা ম্যাম অভিজ্ঞাকে বললেন, "আপনার এতো সুন্দর বোধ দেখে আমি অভিভূত !! আপনার জীবন দর্শনে আমি সত্যিই মুগ্ধ !! "


সঙ্গীতা ম্যামকে ধন্যবাদ জানিয়ে অদিত্রীর স্কুল ছাড়ার সময় অভিজ্ঞার মনে পড়লো, প্রতিবার স্কুলের রিপোর্টকার্ড হাতে নিয়ে বাড়িতে ঢোকার পরে তাকে তার মায়ের হাতে মার খেতে হতো, এমনকি মা তার পায়ের জুতো দিয়েই তাকে পেটাতো | অভিজ্ঞা যে খুব খারাপ রেজাল্ট করতো তা নয়, শুধু সে ফার্স্ট সেকেন্ড না হয়ে ক্লাসে কখনো ফিফথ, আবার কখনো সিক্সথ হতো |


অভিজ্ঞার বাবা মায়ের ব্যস্তজীবনের জন্য অভিজ্ঞা নিজেই নিজের লেখাপড়াটা করে নিত, তবুও সে তার বাবা মাকে সন্তুষ্ট করতে পারতো না | ফলে লেখাপড়ায় ঢিলেমি আসে, তাই আজকের স্কুল শিক্ষিকা অভিজ্ঞা আর ডাক্তার হয়ে উঠতে পারেনি | বাবা মায়ের উপরে রাগ করেই জয়েন্ট এন্ট্রানসে বসেনি সে, কারণ তার ভয় ছিল কোনো ভাবে প্রথম বারে মেডিক্যালে চান্স না পেলে তাকে হয়তো আবার জুতোর মার খেতে হবে |


জীবনের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই অভিজ্ঞা শিখেছে, মার্কসের টার্গেট না রেখে জীবনের লক্ষ্যকে টার্গেট করা উচিত | আর অভিজ্ঞা তার সেই টার্গেট থেকে এক চুলও নড়বে না | অদিত্রীকে সে পৌঁছে দেবেই অদিত্রীর মন পসন্দ লক্ষ্যে |


সমাপ্ত




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics