STORYMIRROR

Laxman Bhandary

Others

4  

Laxman Bhandary

Others

সিঁদুর দিয়ে কেনা ভালবাসা

সিঁদুর দিয়ে কেনা ভালবাসা

9 mins
5

সিঁদুর দিয়ে কেনা ভালবাসা
অশ্রুসজল সামাজিক উপন্যাস
রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ভূমিকা

গোধূলির আবছা আলোয় যখন মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে শঙ্খধ্বনি ভেসে আসত, সোনালীর শূন্য সিঁথিটা আরও বেশি করে চোখে পড়ত আমার। গ্রামের আর পাঁচজন বিবাহিত নারীর মতো তার সিঁথিতে সিঁদুরের উজ্জ্বল রেখা নেই, কপালে নেই ছোট্ট টিপ। তার কপালে কেবলই এক গভীর শূন্যতা, আর সিঁথিতে এক শুকনো নদী, যেখানে একদা প্রেমের টলটলে জল ছিল, ছিল জীবনের রঙ।

বছর দুয়েক হল সোনালী বিধবা। অল্প বয়সে স্বামী হারিয়েছে। ছেলেপুলে নেই। দিন কাটে ঠাকুর সেবা আর সামান্য ঘরের কাজ করে। সমাজ তাকে "শুভ" কাজ থেকে দূরে রেখেছে। তার হাসি যেন হারিয়ে গেছে কোন অতল গভীরে। সিঁদুর, যা এতদিন তার বিবাহিত জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতীক ছিল, স্বামীর মঙ্গল কামনার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল, আজ সেটাই তার বিধবা হওয়ার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে – তার অনুপস্থিতি। প্রথা বলে, স্বামীর মৃত্যুর পর সিঁদুর পরার অধিকার সে হারিয়েছে। এ যেন তার ভালবাসার চিহ্ন মুছে ফেলার এক সামাজিক বাধ্যবাধকতা।

আমি গ্রামের নতুন শিক্ষক। সোনালীকে প্রথম যখন দেখি, ওর চোখগুলো আমাকে খুব টানে। সে চোখে ছিল না কোন অভিযোগ, ছিল শুধুমাত্র এক নিদারুণ শূন্যতা আর সমাজের দেওয়া প্রথার কাছে মাথা নত করার এক অদ্ভুত আত্মসমর্পণ। আমি বুঝতে পারতাম, সমাজের এই অলিখিত নিয়মগুলো কিভাবে একজন নারীকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। সিঁদুর শুধুমাত্র একটা প্রথা নয়, এটা আত্মমর্যাদা, ভালবাসা আর আপন অস্তিত্বের এক নিবিড় সম্পর্ক। সোনালীর কাছ থেকে এই অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।

অনেক রাত নির্ঘুম কেটেছে। সিঁদুর কি শুধু স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনার প্রতীক? নাকি এটা নারীর নিজস্ব অস্তিত্বের, তার নিজের ভালোবাসার, তার নিজের জীবনের উৎসবের প্রতীকও হতে পারে? প্রথা আর বিশ্বাস কি একতরফা হতে পারে? কেন একজন নারী জীবনের সব রং হারিয়ে বাঁচবে?

একদিন সাহস করে আমি সোনালীর কাছে গেলাম। সে তখন তুলসী তলায় প্রদীপ দেখাচ্ছিল। তার মুখে এক অপার্থিব শান্তি, কিন্তু চোখে সে একই শূন্যতা। আমি তার সামনে ছোট একটা সিঁদুরের কৌটো রাখলাম। সে চমকে উঠল। তার চোখে ফুটে উঠল ভয়, বিস্ময় আর একরাশ প্রশ্ন।

"এ কী করছেন মশাই?" তার গলা কেঁপে উঠল। "সোনালী," আমি বললাম, আমার গলাতেও উত্তেজনা। "সিঁদুর শুধু একটা প্রথা নয়। এটা শুভময় প্রতীক, জীবনের প্রতীক। তোমার জীবনেও তো শুভ রং থাকতে পারে। তোমার নিজের জন্য, আপনার নিজের ভালবাসার জন্য।"

তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। না, সে জল দুঃখের ছিল না। সে জল ছিল এক অবরুদ্ধ আবেগের, এক নীরব বিদ্রোহের। সে হয়তো ভাবতেই পারেনি, কেউ একজন তার জন্য এতটা ভাববে, এতটা সাহস দেখাবে।

আমি খুব সাবধানে সিঁদুরের আলতো ছোঁয়া দিলাম তার কপালে, তারপর তার সিঁথিতে। সিঁদুরের লাল রঙে তার নিষ্প্রভ মুখটা যেন মুহূর্তেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে চোখ বন্ধ করলো। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক বিষণ্ণ হাসি, যা বহু বছর ধরে আমি দেখিনি। সে যেন নতুন জীবন ফিরে পেল।

সিঁদুরের প্রথাগত অর্থ হয়তো স্বামীর মঙ্গল কামনা, বিবাহিত জীবনের প্রতীক। কিন্তু আমি সেদিন সিঁদুর পরিয়ে দিলাম সোনালীকে তার নিজের জন্য। তার হারানো আত্মপরিচয় ফিরিয়ে দিতে। তার জীবনে শুভত্বের, ভালবাসার আর এক নতুন জীবনকে স্বাগত জানাতে। সমাজ হয়তো এই কাজকে মেনে নেবে না, হয়তো নিন্দাও করবে। কিন্তু আমার কাছে, সেদিন সোনালীর সিঁথিতে যে সিঁদুর ছিল, তা কোন প্রথা বা বাধ্যবাধকতার প্রতীক ছিল না; তা ছিল মানবিকতা, ভালবাসা আর এক নতুন দিগন্তের প্রতীক। সেদিন আমি সিঁদুর দিয়েছিলাম এক শুষ্কপ্রায় নদীর বুকে নতুন জলের ধারা ফিরিয়ে দিতে, এক আঁধার রাতে আলোর রেখা ফোটাতে। আমার কাছে সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় শুভ কাজ।

সমাজ, প্রথা আর নিয়মের এক জটিল জালে আমরা প্রায়শই নিজেদের অজান্তেই জড়িয়ে পড়ি। কিছু প্রথা বহন করে চলে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, আর কিছু হয়ে ওঠে অদৃশ্য শেকল। সিঁদুর, বাঙালি নারীর জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য প্রতীক; স্বামীর মঙ্গল কামনা আর বিবাহিত জীবনের পরিচায়ক। কিন্তু সেদিন, যখন আমি সোনালীর সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছিলাম, তখনও কি জানতাম যে এই লাল রং এক নতুন উপাখ্যান লিখছে? এক শুষ্কপ্রায় নদীর বুকে নতুন জলের ধারা ফিরিয়ে দিচ্ছে, এক আঁধার রাতে আলোর রেখা ফোটাচ্ছে? সেদিন, আমার কাছে সিঁদুর ছিল না কোন প্রথা বা বাধ্যবাধকতার প্রতীক; তা ছিল মানবিকতা, ভালোবাসা আর এক নতুন দিগন্তের প্রতীক।

অধ্যায় ১: ধূসর সোনালীর জীবন

সোনালীকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, তার নামটা যেন তার অস্তিত্বের সঙ্গে বেমানান মনে হয়েছিল। সোনালী – এই নামটা যেন উজ্জ্বলতা, প্রাণবন্ততা আর এক অফুরন্ত আশার প্রতীক। অথচ আমার সামনে যে নারীটি বসেছিল, তার চোখে ছিল না কোন ঔজ্জ্বল্য, তার হাসি ছিল বিষণ্ণতায় ঢাকা। সে ছিল একটি ধূসর ক্যানভাসের মতো, যেখানে রঙের ছোঁয়া ছিল বটে, কিন্তু প্রাণ ছিল না।

সোনালী ছিল সমাজের চোখে এক "ভাগ্যহত" নারী। অল্প বয়সে এক ধনী পরিবারের ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। সেই বিয়ে ছিল না ভালোবাসার, ছিল না পছন্দের। ছিল কেবলই প্রথা আর পরিবারের মান রক্ষার অঙ্গীকার। বিয়ের পর থেকেই সোনালীর জীবনটা যেন এক সোনার খাঁচায় বন্দী হয়ে গিয়েছিল। শাশুড়ি, ননদ আর স্বামীর অত্যাচার তার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল। তার ছোট ছোট স্বপ্ন, তার ভালো লাগার বিষয়গুলো একে একে মুছে যেতে শুরু করেছিল। একসময় যে সোনালী গান গাইতে ভালোবাসত, কবিতা আবৃত্তি করত, সে কেবল নীরবে নিজের ঘরকন্নার কাজ করে যেত, আর রাতে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদত।

আমি একজন লেখক। মানুষের মুখে আমি গল্প খুঁজি, চোখের গভীরে দেখি তাদের স্বপ্ন আর ভাঙা আশা। সোনালীর মুখ দেখে মনে হয়েছিল, যেন তার মুখে হাজারো না বলা কথা জমে আছে, যা কোনদিন আলো দেখেনি। আমি তার কাছে গিয়েছিলাম তার সাথে দেখা করার জন্য, কিন্তু ফিরে এসেছিলাম তার জীবনের গল্প শুনে। তার চোখগুলো ছিল সমুদ্রের গভীরের মতো, যেখানে ঢেউ নেই, শুধু স্থির এক গভীরতা, যেখানে কোন আলো পৌঁছায় না।

অধ্যায় ২: আত্মপরিচয়ের মরণদশা

সোনালীর সাথে আমার নিয়মিত দেখা হতে শুরু করল। আমি তার কথা শুনতাম, তাকে ছবি আঁকার গল্প বলতাম, প্রকৃতির সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা করতাম। ধীরে ধীরে সে একটু একটু করে খুলতে শুরু করল। সে বলত, "জানেন দাদা, আমার নিজের বলে আর কিচ্ছু নেই। আমার নামটা শুধু আমার আছে, কিন্তু আমার আত্মাটা কবেই যেন মরে গেছে। আমি কেবল একটা শরীর, যা অন্যের ইচ্ছে পূরণের জন্য বেঁচে আছে।"

তার এই কথাগুলো আমার বুকে বিঁধে যেত। আমি দেখতাম, তার কপালে জ্বলজ্বল করত সিঁদুর। সেই সিঁদুর তার বিবাহিত জীবনের প্রতীক ছিল, যা তাকে তার স্বামীর সাথে জুড়ে রেখেছিল। কিন্তু সেই সিঁদুরই যেন তার শেকলের মতো মনে হতো আমার। একসময় হয়তো সেও স্বপ্ন দেখেছিল এই সিঁদুর পরে এক সুখী জীবন পাবে। কিন্তু বাস্তবতার রুক্ষতা তার সেই স্বপ্নকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল। সিঁদুর যেন তাকে মনে করিয়ে দিত তার বাধ্যবাধকতা, তার নিঃস্বতা।

সেদিন সোনালী আমাকে বলেছিল, "আমার স্বামী আমাকে ভালোবাসে না। সে কেবল আমার শরীরটাকে ব্যবহার করে, আর আমাকে তার সম্পত্তি ভাবে। আমি এই সিঁদুর পরতে চাই না, কিন্তু সমাজ, পরিবার… সবাই আমাকে বাধ্য করে। আমি জানি না এই সিঁদুর আমার স্বামীর মঙ্গল কামনা করে কিনা, কিন্তু এটা আমার নিজেরই অমঙ্গল ডেকে এনেছে।"

সোনালীর এই কথাগুলো শুনে আমার মনে এক অদ্ভুত চিন্তা এলো। সিঁদুর, যা এতদিন সমাজের চোখে নারীর এক অবিচ্ছেদ্য পরিচিতি, তাকে কেন নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা যায় না? কেন এই প্রথাকে মানবিকতার ছোঁয়ায় উজ্জ্বল করা যায় না?

অধ্যায় ৩: এক সাহসী ভাবনা

আমার মাথায় সেই চিন্তাটা ঘুরপাক খেতে লাগল। সিঁদুর, যা কেবলই একজন পুরুষের সাথে নারীর সম্পর্কের প্রতীক হয়ে আছে, তা কি নারীর আত্মপরিচয়ের প্রতীক হতে পারে না? তার নিজের শক্তির, তার ভালোবাসার, তার নতুন করে বেঁচে ওঠার প্রতীক?

আমি সোনালীকে দেখেছিলাম, সে যেন এক শুষ্ক নদীর মতো। তার বুকে জল নেই, জীবন নেই। সে যেন এক আঁধার রাতের মতো, যেখানে আলোর রেখা ফোটার অপেক্ষায়। আমি চাইছিলাম, তার জীবনে নতুন জলের ধারা ফিরিয়ে দিতে, সেই আঁধার রাতে আলোর রেখা ফোটাতে। কিন্তু কিভাবে?

একদিন, সোনালীর সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই আমি বলে ফেললাম, "সোনালী, তুমি কি আবার হাসতে চাও? নিজের জন্য বাঁচতে চাও?"

সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। তার চোখে এক ঝলক বিস্ময়। "নিজের জন্য বাঁচা? সে তো কবেই ভুলে গেছি দাদা।"

আমি বললাম, "যদি এমন একটা প্রতীক থাকে, যা কেবল তোমার জন্য, তোমার নিজের আত্মপরিচয়ের জন্য, তোমার নতুন করে ভালবাসার জন্য, শুভত্বের জন্য?"

সে কিছু বুঝতে পারছিল না। তখন আমি তাকে আমার মনের কথাগুলো খুলে বললাম। সমাজের প্রথা, বাধ্যবাধকতার বাইরে গিয়ে সিঁদুরকে এক নতুন অর্থ দেওয়ার কথা বললাম। তাকে বললাম, "সোনালী, যে সিঁদুর তুমি স্বামীর জন্য পরো, তার পাশাপাশি একদিন এমন এক সিঁদুর পরবে, যা তোমার নিজের জন্য। তোমার হারানো আত্মপরিচয় ফিরিয়ে দিতে। তোমার জীবনে শুভত্বের, ভালোবাসার আর এক নতুন জীবনকে স্বাগত জানাতে।"

প্রথমটায় সোনালী চমকে উঠল। হয়তো সে সমাজের ভয়ে কুঁকড়ে গেল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার চোখে আমি এক নতুন ঝলক দেখলাম। একরাশ দ্বিধা আর ভয়ের মধ্যেই যেন এক চিলতে আলোর রেখা উঁকি দিল।

অধ্যায় ৪: সিঁদুরের নতুন উপাখ্যান

সেই দিনটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সোনালীর বাড়ির এক কোণের ছোট ঘরটায় সেদিন আমরা বসেছিলাম। বাইরে হয়তো লোকেদের আনাগোনা ছিল, কিন্তু ঘরের ভেতরটা ছিল এক অদ্ভুত শান্তিতে ভরা। আমি পকেট থেকে ছোট্ট একটা সিঁদুরের কৌটো বের করলাম। সোনালীর চোখে তাকিয়ে দেখলাম – একরাশ ভয় আর আশার মিশ্রণ।

"সমাজ হয়তো এই কাজকে মেনে নেবে না, হয়তো নিন্দাও করবে," আমি তাকে বললাম। "কিন্তু আমার কাছে, সেদিন তোমার সিঁথিতে যে সিঁদুর থাকবে, তা কোন প্রথা বা বাধ্যবাধকতার প্রতীক হবে না; তা হবে মানবিকতা, ভালবাসা আর এক নতুন দিগন্তের প্রতীক।"

সোনালী মাথা নিচু করে রইল। তার দু চোখ জলে ভরে এলো। সে জল হয়তো ছিল মুক্তির, হয়তো ছিল আশার, হয়তো ছিল এতদিন ধরে জমানো বেদনার।

ধীরে ধীরে আমি সোনালীর সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিলাম। প্রথাগতভাবে নয়, বরং এক লেখকের হাতে যেন সে নতুন এক সাহিত্য সৃষ্টি করছিল। সিঁদুরের লাল রং তার ফ্যাকাশে মুখে এক নতুন আভা ছড়িয়ে দিল। সেদিনের সেই সিঁদুর ছিল না স্বামীর মঙ্গলের জন্য, ছিল না সমাজের চোখে বিবাহিত নারী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য। সেই সিঁদুর ছিল সোনালীর নিজের জন্য। তার হারানো আত্মপরিচয় ফিরিয়ে দিতে। তার জীবনে শুভত্বের, ভালবাসার আর এক নতুন জীবনকে স্বাগত জানাতে।

সেই সিঁদুর ছিল এক শুষ্কপ্রায় নদীর বুকে নতুন জলের ধারা ফিরিয়ে দিতে, এক আঁধার রাতে আলোর রেখা ফোটাতে।

অধ্যায় ৫: অপ্রথাগত পরিচয়ের স্ফুরণ

সমাজ সত্যিই মেনে নেয়নি। সোনালীর স্বামীর পরিবার, প্রতিবেশীরা, আত্মীয়স্বজন – সবাই ছি ছি করেছে। আমাকে নিয়ে কত কথা। "ছিঃ ছিঃ, একজন অবিবাহিত পুরুষ হয়ে বিবাহিত নারীর সিঁথিতে সিঁদুর পরানো!" "এ কেমন নির্লজ্জতা! সভ্যতা বলে কিছু নেই?" আমি জানতাম এমনটা হবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল, এই কাজটা ভুল ছিল না।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা এলো সোনালীর জীবনে। প্রথম প্রথম সে দ্বিধায় ভুগছিল, লোকনিন্দার ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই সিঁদুর তার ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তুলল। সে বুঝতে পারল, এই সিঁদুর তাকে নতুন করে বাঁচার সাহস দিচ্ছে। সেদিনের সেই সিঁদুর যেন তার শরীরে আত্মবিশ্বাসের রক্ত সঞ্চালন শুরু করল।

সোনালী তার স্বামীর অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো। সে তার পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলল। অবশেষে, সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে সে নিজের একটি নতুন জীবন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিল। সে ডিভোর্সের আবেদন করল। আমি তাকে সবরকম ভাবে সাহায্য করলাম, পাশে দাঁড়ালাম।

সেদিন সোনালীর সিঁথিতে যে সিঁদুর ছিল, তা তাকে কেবল এক নতুন পরিচয় দেয়নি, তা তাকে দিয়েছিল এক নতুন মানসিক শক্তি। সেই সিঁদুর যেন তাকে মনে করিয়ে দিত, সে একা নয়, সে ভালবাসার যোগ্য, সে জীবনের যোগ্য। সেই সিঁদুর ছিল তার নিজের প্রতি অঙ্গীকার, নিজের জন্য ভালোবাসা।

আজ সোনালী নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। সে আবার গান গাইতে শুরু করেছে, পুরানো হারানো সুর ফিরে পেয়েছে। সে এখন ছোট ছেলেমেয়েদের গান শেখায়। তার চোখে আমি সেই হারানো ঔজ্জ্বল্য ফিরে পেতে দেখেছি। তার হাসি এখন প্রাণবন্ত, কোন বিষণ্ণতার ছোঁয়া নেই। তার কপালে এখন আর সেই ভয় জড়ানো সিঁদুর দেখা যায় না, বরং তার সিঁদুর যেন হয়ে উঠেছে তার নিজস্ব শক্তির প্রতীক। সে প্রতিদিন নিজের জন্য, নিজের ভালোবাসার জন্য সিঁদুর পরে।

আমার কাছে, সেই সিঁদুর ছিল এক মানবতাবাদের প্রতীক। এক প্রথা ভাঙার গল্প, যেখানে ভালবাসার জয় হয়েছিল, সহানুভূতি আর সাহসের জয় হয়েছিল। সোনালীর জীবন এক শুষ্কপ্রায় নদীর মতো ছিল, যেখানে আমার দেওয়া সেই সিঁদুর হয়ে এসেছিল এক নতুন জলের ধারা। তার জীবন ছিল এক আঁধার রাতের মতো, যেখানে সিঁদুর দিয়ে কেনা আমার ভালবাসা হয়ে ফুটেছিল এক আলোর রেখা।

সমাপ্ত


Rate this content
Log in