STORYMIRROR

Bansika Banik

Drama

4  

Bansika Banik

Drama

শেষ শীতের চিঠি

শেষ শীতের চিঠি

3 mins
1

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ।

শহরের বাতাসে শীতের কামড় আর কুয়াশার অদ্ভুত নরম গন্ধ।

মায়া রোজকার মতো বাবার ঘর গুছাতে গিয়েছিল—আজ হঠাৎই মনে হল, শীতের কোটগুলো একটু দেখে রাখা উচিত।

বাবা যেসব জিনিস নিজেদের কাছে রেখেছিলেন, সেগুলোতে আজও এক অদ্ভুত উষ্ণতা মায়া খুঁজে পায়।


আলমারির ওপরের তলায় রাখা পুরনো বাদামি কোটটা নামাতে গিয়ে মায়া থামল।

কোটটি যেন এখনও তার বাবার দেহের উষ্ণতা ধরে রেখেছে—

বহুবার ব্যবহার করা, কিন্তু কখনও অবহেলায় পড়ে থাকা নয়।


মায়া কোটটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে কাগজের হালকা খসখস শব্দ।

পকেটে হাত দিয়েই ভাঁজ করা পুরনো একটা খাম বের হলো।

চোখের সামনে লেখা—


“অরুণের জন্য। ১৯৮৫।”


অরুণ—তার বাবা।

'৮৫ সাল… অর্থাৎ বাবার বয়স তখন ২৬ কি ২৭।

মায়া আগে কখনও কোন প্রেমপত্র পায়নি বাবার নামে।

মনে এল—বাবা আর মা তো প্রেম করে বিয়ে করেননি; arranged marriage।

তবে কি…


মায়া ধীরে ধীরে খাম খুলল।

চিঠিটা খুব নরম হয়ে গেছে সময়ের স্পর্শে।


চিঠিতে লেখা—


“অরুণ,

এবারের শীতটা আগের সব শীতের মতো নয়।

যদি তুমি আমার কথা ভুলেও যাও, তবু নববর্ষের আগের রাতটাতে আমি পার্ক স্ট্রিটের সেই পুরনো ক্যাফের সামনে অপেক্ষা করব।

কেন জানি মনে হয়—

এই বছরটা আমার শেষ সুযোগ।”

— আরতি


মায়ার হাত কেঁপে উঠল।

বাবার জীবনে কি এমন একটা অধ্যায় ছিল, যা সে জানতই না?

মায়ের কাছেও কি গোপন ছিল?

আরতি কে ছিলেন?

শেষ সুযোগ বলতে কী বোঝাচ্ছেন?


চিঠিটা আবার পড়তে পড়তে মায়ার মনে একটা অদ্ভুত কৃতজ্ঞতা জন্মাল—

কেউ বাবাকে এতটা ভালোবেসেছিল!


সেই রাতে মায়া ঠিক করল—

এই ৩১ ডিসেম্বর সে সেই ক্যাফেতেই যাবে।

হয়তো আরতি আসবেন।

হয়তো বাবার অতীতের কোনো পরত খুলে যাবে।

হয়তো কোনো গল্প অসমাপ্ত থেকে গেছে, যেটা জানার অধিকার তার আছে।


৩১ ডিসেম্বর, রাত ১১টা ২০।


পার্ক স্ট্রিট ঝলমল করে আলোয়।

নববর্ষের আগের রাত—আলো, গান, মানুষের ভিড়…

কিন্তু মায়ার ভেতরটা কেমন স্নায়ুচাপা।


ক্যাফের সামনে দাঁড়াতেই মনে পড়ল চিঠির লাইন—

“শেষ সুযোগ।”


হঠাৎ কাঁধে হাত।

বয়সী, ধবধবে সাদা চুলের এক মহিলা দাঁড়িয়ে।


“তুমি কি… অরুণের মেয়ে?”


মায়া বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।

চোখে জল, কিন্তু ঠোঁটে এক অদ্ভুত শান্তি।


“আপনি… আরতি?”

মহিলা মাথা নাড়লেন।


এক অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প


আরতি ধীরে ধীরে বললেন—

“তোমার বাবা খুব চুপচাপ মানুষ ছিলেন।

কোনো অভিযোগ করতেন না, কাউকে দোষ দিতেন না…

কিন্তু ভালোবাসাকে ভয় পেতেন।”


মায়া শুনছে নিঃশ্বাস আটকে।


“আমার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব থেকেই শুরু।

সেটা প্রেম হয়ে উঠেছিল… কিন্তু তোমার বাবার পরিবার ঠিক করেছিল তাঁর বিয়ে। তিনি বাধ্য হয়েছিলেন।

আমি দূরে সরে যাই।”


“তাহলে আপনি প্রতি বছর আসতেন কেন?”—মায়া জিজ্ঞেস করল।


আরতি মৃদু হাসলেন—

“ভালোবাসা সবসময় পেতে হয় না। কিছু ভালোবাসা শুধু দেখলে চলে।

আমি শুধু দেখতে আসতাম—তিনি সুখী কিনা।”


মায়ার চোখ ভিজে গেল।

“বাবা কি আপনাকে ভুলে গিয়েছিলেন?”


আরতি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন—

“ভালোবাসায় ভুলে যাওয়া বলে কিছু নেই।

হয়তো তোমার বাবার জীবনে আমাকে অন্যভাবে জায়গা ছিল—

মনে নয়, স্মৃতির কোণে।

সেটাই যথেষ্ট ছিল।”


হঠাৎ তিনি কোট থেকে একটি ছোট্ট নীলখাম বের করলেন।


“এটা অরুণ আমাকে দিয়েছিলেন অনেক পরে… যখন তোমার জন্ম হয়েছিল।

বলেছিলেন—‘এটা ওকে একদিন দিয়ে দেও। সময় এলে বুঝবে।’

তোমার বাবার কথা কখনও অমান্য করিনি।”


মায়ার হাত কেঁপে উঠল।


খামের ভেতরে একটি ছোট্ট নোট—


“আরতি,

যদি কোনোদিন আমার মেয়ে তোমার কাছে আসে,

জেনে নিও—

তার মা-ই আমার জীবনের সত্যি ভালোবাসা।

তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা আজও রয়ে গেছে।

তুমি আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলে।

— অরুণ”


মায়ার চোখ দিয়ে পানি গড়াতে লাগল।

আরতির চোখেও জল।


দুই নারীর নীরব আলিঙ্গন


মায়া নিঃশব্দে আরতির হাত ধরল।


“আপনি বাবাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন—

আর আমার মা তাকে বাঁচতে শিখিয়েছিলেন…

আপনাদের দুজনের কারণেই আমি আছি।”


আরতি কাঁপা গলায় বললেন—

“এটাই ভালোবাসার অদ্ভুত শক্তি, মা।

কিছু প্রেম থাকে না,

তবু থাকে।”


ভিড়ের আওয়াজের মাঝেও মনে হলো—

চিঠির ভাঁজ, কোটের গন্ধ, পুরনো গল্প—সব মিলেমিশে এক ধরনের উষ্ণতা তৈরি করছে।


ঘড়ির কাঁটা ১২ ছুঁতেই চারদিকে হুল্লোড়।


কিন্তু দুই নারী—

একজন মেয়ে, একজন অতীতের ভালোবাসা—

নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।


নতুন বছরের আলোয়

এক অসমাপ্ত গল্প

আজ পূর্ণ হলো।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama