Apurba Kr Chakrabarty

Abstract Inspirational Others

4.0  

Apurba Kr Chakrabarty

Abstract Inspirational Others

শাঁখারী পুকুর।

শাঁখারী পুকুর।

4 mins
226


মনোহর শী ছিল জাতে স্বর্নকার কিন্তু সোনার গহনা নয়।শাঁখের কাজ করতেন। হাতের কাজছিল নিখুঁত। সকাল থেকে রাত অবধি কতসব ডিজাইন হাতের শাঁখা তৈরী করত। সপ্তাহে একদিন সে এ সব তৈরী শাঁখা ছোট টিনের বাক্সে ভরে গ্রামে গ্রামে ফেরী করে বেড়াত। বড় নিষ্ঠাবান সৎ মানুষ। তার কর্মশালায় একটা মস্ত শাঁখের উপর নিজের বহু শ্রমে ঘাম ঝরিয়ে দেবী দূর্গার মূর্তি খোদাই করে এক অপূর্ব সৃষ্টি করেছিল। অনেক খদ্দের এই মূর্তির অনেক দাম দিয়ে কিনতে চাইলে মনোহর বলত ,

" নিজের মাকে কেউ বেচবে ! এমন পাপীষ্ঠ অন্তত এই হতভাগা মায়ের দাস মনোহর নয়।"

নিজেই মায়ের প্রার্থনা করে তবে সকালে জল গ্রহন করত। প্রতি বুধবার কোনদিন পূর্ব দিকে কোন দিন পশ্চিম কোন দিন উত্তর কোনদিন দক্ষিণ দিকের গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করত।সঙ্গে থাকত সধবা নারীদের পবিত্র শুভ শাঁখার অলঙ্কার। আবার দেবী পূজার কাজে শাঁখের অলঙ্কার রাখত যা কম দামী অনেকটা অবশিষ্ট পরিত্যক্ত শাঁখের অংশ থেকে হত। 

একবার মনোহর স্বপ্নে দেবী দূর্গার তিরস্কার খেয়ে দুদিন ধরে খুব কেঁদেছিল। দেবী যেন তাকে বলছেন ভালো শাঁখা মানুষ পড়বে আর যত কমা পরিত্যক্ত শাঁখা আমার জন্য ছিঃ তুই এই আমার ভক্ত! তোর লজ্জা করে না! কত টাকা লাগবে বল!

মনোহর এর পর তার সবচেয়ে পছন্দের এক জোড়া শাঁখা, তার নিজ হাতের শাঁখের তৈরি দেবী দূর্গা মায়ের পদতলে রেখে দেয়। তারপর দেবী তাকে স্বপ্নে প্রসন্ন হয়ে বলে তুই আমার সাচ্চা ভক্ত আমার আশীর্বাদ সব সময়ই তোর সাথেই থাকবে।

এরপর মনোহরে খুশীতে আর ধরে না।দরিদ্র হলেও তার মনে ছিল চরম শান্তি। যেদিন গ্রামে গ্রামে ফেরী করতে বের হত , এক হাতে শাঁখের তৈরী শাঁখা ভর্তি টিনের বাক্স,অন্য হাতে ছাতা আর কাঁধে ব্যাগে থাকত চিড়ে বাতাসা ছোট থালা গ্লাস।গ্রামের রাস্তার কোন নলকূপে জল নিয়ে চিড়ে ভিজে আর বাতাসা সহযোগে তার আহার করতে কোন সমস্যার নয়।দরকারে সারাদিনে দুবার তিন বার আহার করলেও অন্য কোন বাড়ি জল গ্রহন করত না।

তার নির্দিষ্ট ছন্দে "শাঁখা চাই শাঁখা" শব্দের চেনা সুরে বাড়ির গিন্নি বৌরা দরজা খুলে গৃহে ডাকত।সে যুগে এত প্রসাধন গহনা দোকান ছিল না। সোনার গহনা স্বর্নকার গৃহে, এমন কী কাচের চুরি মেলা ছাড়া অন্য সময় নির্দিষ্ট গৃহে পাওয়া যেত।যারা বিভিন্ন মেলা ঘুরত, বাকী সময় অবশিষ্ট মাল বাড়িতে রাখত।

শাঁখা এই মনোহর ছাড়া এই এলাকায় বিকল্প ছিল না।একমাস অন্তর তার দেখা মিলত ,তাই শাঁখা ভেঙ্গে গেলে তার অধীর অপেক্ষা! অনেকেই তাই অতিরিক্ত একজোড়া কিনে রাখত।কিন্তু তার যে সধবা নারীর হাতে শাঁখা পরানোর কৌশল, হাতে লাগত না শাঁখাও ভাঙ্গত না । সেজন্য তার অপেক্ষা গ্রামের মহিলারা বেশী করত।

সারাদিন সেদিন বিশটা গ্রাম ঘুরে রাতে মনোহর বাড়ি ফিরত। সারাদিনে বিশ ক্রোশ বা চল্লিশ মাইল কোন কোন দিন হাঁটা হত। তখন এত বাস, পিচ রোড যেমন ছিল না আর তার যারা খদ্দের তাদের বাড়ি বাড়ি যেতে সমস্ত গ্রাম চক্কর দিতে হত।

বিক্রমপুর বড় গ্রাম,খড়িনদী পেরিয়ে গ্রাম ঢুকতেই রায় পুকুর। পুকুরের চারপাড়ে গাছপালা, গ্রীষ্মের দুপুর ছায়াশীতল পরিবেশ ।মনোহর সেকরা দীর্ঘপথ হেঁটে গ্রামে ঢোকার আগে পুকুরের পাড় বরাবর গ্রাম্য রাস্তার পাশে এক আমগাছের তলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। প্রকান্ড আমগাছটির সামনেই পুকুরের ঘাট বাঁধানো। সকাল সন্ধ্যায় গ্রামের মেয়েরা স্নান করত।বেলা তখন বারোটা এক কিশোরীর ডাকে মনোহরের আধঘুম ভেঙ্গে গেল।

মেয়েটির ষোল সতের বয়স, সুন্দরী,মাথায় সিঁদুর, পড়নে লালপেড়ে  সাদা শাড়ি, গায়ে লাল গামছা জড়ানো ,একটু হেসে বলে।

"শাখাঁরী কাকু তোমার অনেক দিন খোঁজ করছি।এ গ্রামে সেই কবে এসেছ।আমার শাঁখা দুটো হাতে চেপে বসেছিল, খুলতে গিয়ে ভেঙ্গেই গেল। আমাকে দুটো শাঁখা পরিয়ে দাও।"

মনোহর ছোট টিনের বাক্সে গ্রামে গ্রামে শাঁখা ফেরি করে বেড়ায়।এগ্রামে একমাসের উপর আসা হয়নি।

বলল,"তা মা, এখানে কেন বাড়িতে চলো!"

কিশোরী বলে "না,আমি শাঁখা পরে পুকুরে স্নান করে ফিরব।"

"মা শাঁখার দাম!"

"তোমার শাঁখার দাম কত!"

"ভালোটা, তোমায় সেটা খুব মানাবে ষোল আনা।"

"তোমার কোন চিন্তা নেই আমার বাবা শরৎ চক্রবর্তী , গ্রামের জাগ্রত দেবী অম্বিকার পুরোহিত,তুমি আমার বাবার কাছে শাঁখা দাম চেয়ে নেবে। লক্ষ্মীর কুলঙ্গিতে তোমার পয়সা রাখা আছে।"

শাঁখারী মনোহর আর কথা বলে না।যত্ন করে কিশোরীর হাতে একজোড়া দামি শাঁখা পরিয়ে দেয়।

কিশোরী তারপর পুকুরে স্নানে নামল। মনোহর শরৎ চক্রবর্তীর বাড়িতে আগে তার স্ত্রীকে শাঁখা পরিয়ে গেছে। গ্রামের অনেক মানুষ তার চেনা পরিচিত।

শরৎবাবুকে সদর থেকে হেঁকে মনোহর শাঁখারী বলল, "বাবা ঠাকুর, আপনার মেয়েকে শাঁখা পরিয়ে এলাম, রায়পুকুর পাড়ে।"

শরৎ বাবু আকাশ থেকে পড়ে!" আমার মেয়ে! কেমন দেখতে!"

"খুব সুন্দরী বিবাহিতা লাল গামছা গায়ে জড়িয়ে!"

শরতবাবু বলে" কী সব বলছ! আমার একটি মেয়ে, এখনও বিয়ে হয়নি, সেতো মায়ের সাথে রান্নার ঘরে!"

"কিন্তু মেয়েটি বলল,আপনি ওর বাবা। শাঁখার দাম আপনার ঘরে লক্ষ্মীর কুলঙ্গিতে রাখা আছে ,আমায় দিতে বলল।"

"লক্ষ্মীর কুলঙ্গি! ওখানে তো পয়সা থাকে না! দাঁড়াও কেমন রহস্য লাগছে!"

 শরৎ বাবু ঘরে গেলেন একটু পর হন্তদন্ত হয়ে ফিরে বললেন "ষোলআনা!"

"হ্যাঁ,বাবা ঠাকুর।"

শরতের চোখে জল,ষোল আনা মনোহরকে দাম দিয়ে বললেন,"চল তোমার সাথে এখুনি ঐ পুকুরে যাব।"

মনোহরের সাথে প্রায় ছুটতে ছুটতে শরৎবাবু রায় পুকুরে এসেছিলেন, কিশোরী স্নানে নেমেছিল পুকুরে আর তার কোন দেখা নেই।

শরৎ হাউ হাউ করে কেঁদে বলেন "মা তুমি শাঁখারী মনোহরকে দেখা দিলে,ওর কাছে শাঁখা পরলে,আমি কী পাপ করেছি!এত তোমায় নিষ্ঠাভরে নিত্য তিনবেলা পূজা করি। আমাকে দেখা দেবে না মা!"

পুকুরের মাঝে গভীর জলে দুটো শাঁখা পরা হাত শুধু দেখা গেল, শরতকে সান্ত্বনা দিতে হাত নাড়ছিল কীনা কে জানে, মুহূর্তেই তা অদৃশ্য হল।

"ধন্য মা" বলে কেঁদেফেলে দেবীর উদ্দেশ্য শরত ভুমিষ্ঠ হয়ে প্রনাম করল।

সেই থেকে রায়পুকুরের নাম হল শাঁখারী পুকুর।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract