সেই কলম
সেই কলম
শেষবারের মতো তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। আজও কলম আনতে ভুলে গেছে। আমার কলম দিয়ে সবগুলো কাগজ একমনে সই করে যাচ্ছে। তাকিয়েই রইলাম ।
মনের মধ্যে একগুচ্ছ ছবির প্রদর্শনী চলছে। সেই প্রথম দেখা, প্রথম হাতে ধরা , প্রথম নিরবে নিঃশব্দে কাছে আসা, সেই বৃষ্টিতে একসাথে ভেজা, সেই বৃষ্টিস্নাত অবস্থায় একে অপরের দিকে নিষ্পলক ভাবে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা,বিয়ের লজ্জামেশা শুভদৃষ্টি, প্রথম সিদুরদান, ফুলসজ্জা, একসাথে পথ চলার অঙ্গীকার -- সবকিছু চলছিল মনে মনে।
"নিন সই করুন" আমার ঘোর কাটছেনা।
"কি হলো, সই করুন" -- উকিলের কথায় সম্বিত ফিরল আমার।
"ও হ্যাঁ" - বলে উকিল সাহেবের কলমদানি থেকে কলম নিয়ে সই করলাম।
" নিন মুক্তি আপনাদের, একে অপরের থেকে"
বেরিয়ে এলাম নিশ্চুপে দুজনে আদালত কক্ষ থেকে।
"কি এখন, বাড়ি যাবে? রিকশা ডেকে দেবো?"
কোনো উত্তর পেলাম না।
অগত্যা নিজেই হেঁকে একটা রিকশা ডাকলাম।
"উঠে এসো। একসাথে যাবো।" -- রিকশায় উঠে তার প্রথম কথা।
" ভুলে গেলে, আজকের থেকে দুজনের দুটি পথ?" -- আমার কষ্টমেশানো রসিকতা।
" এখন দুপুরবেলা , আর পাবেও না রিকশা, আর এমনিতেও তো আমার বাড়ি পার হয়েই যেতে হয়। উঠে এসো। কথা বাড়িও না।"
অগত্যা চেপেই বসলাম। রিকশা চলতে শুরু করলো। সেইসঙ্গে চলমান আমাদের নিস্তব্ধতা।
হটাৎ ব্রেক কষায় দুজনেই হুড়মুড়িয়ে পড়ার উপক্রম। সম্বিৎ ফিরতে দেখলাম আমার হাত নিজের থেকেই তাকে জড়িয়ে আছে।
--" ঠিক আছে তো? লাগেনি তো?"
-"নাহ্, লাগেনি? তোমার?" তার ছোট্ট জিজ্ঞাসা।
-" নাহ্" আমারও সংক্ষিপ্ত জবাব।
তার বাসার সামনে এসে দাঁড়াতে সে নেমে রিকশা ভাড়া দিতে চাইলে আমি মানা করলাম।
রাস্তায় অন্যমনস্ক ভাবে ভবিষ্যতের চিন্তায় মশগুল ছিলাম। ছন্দ কাটলো তার ফোনে।
--"হ্যালো?"
-" বলছি তোমার কলমটা দিতে মনে নেই"- ওপাশ থেকে আওয়াজ।
-" রেখে দাও।"
--"কেনো আবার? সবই তো শেষ আমাদের মধ্যে "
-"সেজন্যে বলছি রেখে দাও।"
--" ধুর ওসব স্মৃতি আঁকরে বেচেঁ থাকার মানে হয়না। তার উপর অভীক দেখলে রাগ করবে।"
-"তৃণা কলমটা একবার হাতে নিয়ে দেখ তো কিছু মনে পড়ে কিনা?"
--"নাহ্ মনে পড়ছে না"
-"পড়বে পড়বে, একটু হাঁটুতে জোর দাও।ঘিলুর উপকার হবে"
--" নাহ্ মানতে হবে তোমার রসিকতার অভ্যাস যায়নি আবির।দাড়াও দেখছি।" ওপাশ থেকে হালকা হাসির আওয়াজ।
--" মনে পড়লো, এটা দিয়েই রেজিস্ট্রি করেছিলাম।"
-"হমম, এটা দিয়েই আলাদা হলাম, এই কলম আমাদের সল্প দিনের বিবাহের সাক্ষী, তার স্মৃতি হয়েই তোমার কাছে রেখে দিও"- থামলাম। গলার কাছে কান্না বুজে আসছে "
-" তৃণা স্বামী হিসেবে তোমাকে আমি কিছুই দামী দিতে পারিনি, না ঘর, না গয়না,না গাড়ি। এই কলমটা যদি স্ত্রীধন হিসেবে রেখে দাও, আপত্তি করবে?"থামলাম আমি।
-- "নাহ্" ওপাশ থেকে ছোট্ট উত্তর।
- " খুব সুখে থেকো তৃণা। ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করব অভীক তোমাকে খুব খুশি রাখে, ওইসব কিছু দেই যা তুমি চাও। আর দিনে একবার কলমটা একটু ছুঁয়ে নিও। আমি টের পাবো তোমার স্পর্শ। তাতেই আমার হয়ে যাবে, কেটে যাবে আমার নিঃসঙ্গ জীবন। ভালো থেকো তৃণা।"
ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ নেই। শুধু দীর্ঘশ্বাস।
কেটে দিলাম ফোন। মুছে দিলাম নম্বর। নাহ্ আর পিছনে চাইবো না। আর আগলে রাখবো না কাউকে। বাড়ি গিয়ে সব অ্যালবাম, সব চিঠি পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
আমার ফেলে আসা কলম তো পাবে তার হাতের ছোঁয়া । তাতেই হবে আমার।