সায়াহ্নে
সায়াহ্নে
মৌ আজ সকাল থেকেই খুব ব্যস্ত, আর দুঘণ্টার মধ্যে বেরোতে হবে বাবাকে নিয়ে । দু মাস ব্যাঙ্গালোরে ওর কাছে থাকার পর ওর বাবা সুকান্ত সেন আজ ফিরে যাচ্ছেন কলকাতায়। মৌ সঙ্গে যাচ্ছে পৌঁছে দিতে। অফিস থেকে আজ শুক্রবার ছুটি নিয়েছে। রবিবারই ফিরে আসবে । এসেই সামনের সপ্তাহে আবার মেয়েকে নিয়ে যেতে হবে চেন্নাই । চেন্নাই আই.আই. টি তে সুযোগ পেয়েছে ওর মেয়ে তিন্নি । ওকে পৌঁছে দিয়ে , ওর হোষ্টেলে থাকার সব ব্যবস্থা করে আসতে হবে। তারপর বাড়ি একদম ফাঁকা। কিন্তু এখন ওসব ভাবার সময় নেই । আপাতত সব গুছিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। বাবার ওষুধ, জল, অল্প শুকনো খাবার সব হাত ব্যাগটাতেই নিতে হবে মনে করে। দুপুর দুটো কুড়ির ফ্লাইট, তার মানে কলকাতার বাড়ি পৌঁছোতে সন্ধে। অবশ্য ওখানে সব বন্দব্যস্ত করাই আছে । অঞ্জলি মাসি তো অনেক পুরোন লোক, মনে হয় সব ব্যবস্থা ঠিক মত করেই রাখবে। হাতের কাজ সারে মৌ আর মনে মনে এই সব ভাবনা চিন্তা চলতেই থাকে । ভাবনাগুলো তো ইচ্ছে করলেই দূর করা যায় না।
সাড়ে বারোটার মধ্যে পৌঁছতেই হবে এয়ারপোর্টে। ওদের বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট প্রায় দু ঘণ্টার রাস্তা । মৌ যথা সময় বেরিয়ে পড়ে বাবাকে নিয়ে । এয়ারপোর্টে পৌঁছে বাবার জন্য হুইল চেয়ার নিয়ে চেক ইন এর সব ঝামেলা মিটলে তবে একটু শান্তি । বসে পড়ে বাবার পাশে , "বললাম, আরও কিছু দিন থাকো"। " না রে , বাড়ি ছেড়ে এতদিন ভাল লাগে না, " বললেন সুকান্তবাবু ।" শরীর ভাল থাকলে আবার আসব"। কিন্তু বাবা এত দূরে একা থাকলে মৌ এর যে কি চিন্তা হয়, সেটা বাবা বোঝে না। অনেক চেষ্টা করেও মৌ নিজের কাছে রাখতে পারে নি বাবাকে।
ফ্লাইট যথা সময় টেক অফ করলে, বাবাও অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখতে দেখতে মৌএরও চোখ বুজে যায় । হঠাৎই মনে পড়ে যায় সেই ভয়ানক দিনটার কথা। তিন বছরের বেশি হল। সকালে ঘুম ভেঙেছিল অপরেশ কাকুর ফোনে । অপরেশকাকু মৌদের কলকাতার বাড়ির ভাড়াটে। ভাড়াটে হলেও পারিবারিক বন্ধু , বিপদে আপদে সব সময় ওদের পাশে থাকেন। " হ্যালো , কাকু বলুন", ফোন তুলে বলে মৌ কিন্তু মুহূর্তে নানা চিন্তা ঘুরপাক খায় মাথায়, এত সকালে অপরেশ কাকুর ফোন কেন। উত্তর আসে অপর প্রান্ত থেকে, " মৌ তুই তাড়াতাড়ি কলকাতায় আসার ব্যবস্থা কর, তোর বাবা আজ ভোরে বাথরুমে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। আমরা হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি, এখনও জ্ঞান আসে নি"।
কয়েক মুহূর্ত মৌ নিশ্চুপ। ফোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় সুকমলেরও। সব শুনে বলে, " আমি তোমার টিকিট দেখছি, তুমি তাড়াতাড়ি প্যাকিং করে নাও"। মৌ এর কলকাতায় পৌঁছোতে বিকেল হয়ে যায় । তারই মাঝে দাদাকে খবর দেয় মৌ। মৌ এর দাদা মনোজ থাকে স্যানফ্রানসিসকোতে। মৌ কলকাতায় পৌঁছে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা যায় হসপিটালে । কনডিশন বেশ সিরিয়াস । ডাক্তার বাবু বললেন , "এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না, সিভিয়ার সেরিব্রাল অ্যাটাক "। প্রায় দশ দিন যমে মানুষে টানাটানির পর ডাক্তারবাবু জানান যে সুকান্ত বাবু আপাতত আউট অফ ডেঞ্জার , তবে আরও বেশ কিছু দিন হসপিটালে থাকতে হবে। বাঁদিকটা প্যারালিসিস হয়ে গেছে । কথা সম্পূর্ণ জড়ানো।
"বাবাকে বাঁচাতে পারব তো? বাবা সুস্থ হয়ে উঠবে তো?" এই চিন্তা মৌ কে যেন গ্রাস করতে আসে প্রতিমুহূর্তে । সারা দিন পর যখন বাড়ি ফেরে তখন ফাঁকা বাড়িটা যেন ওর দিকে আঙুল তুলে নানা প্রশ্ন করে-- কেন ও বাবাকে একলা রেখে গেছিল? এ প্রশ্নের উত্তর ওর জানা, কিন্তু তাও যেন প্রশ্নটা বার বার ফিরে আসে । রাত্রের ঘুম চলে যায় ওর।
এর মধ্যেই মনোজ আসে কলকাতায় । দিন পনেরো থাকে । বাবার দেখাশোনাও করে। বাবা তখনও হাসপাতালে । মনোজ চিকিৎসার সব রকম খরচ বহন করার দায়িত্ব নেয়। কিন্তু তারপর? মৌ আবার একা। ও বুঝতে পারে দাদার পক্ষে আর থাকা সম্ভব নয় কিন্তু মনকে বোঝাতে পারে না। "বাবার দায়িত্ব কি আমার একার? বাবা কি আমার একার?" আবার পরমুহূর্তেই নিজেকে বোঝায় এই সব চিন্তা না করে বাবার চিকিৎসাই ওর একমাত্র লক্ষ হওয়া উচিত ।
সুকমল কলকাতায় আসতে পারে না কিন্তু দূরে থেকেই সবসময় মৌ এর পাশে থাকার চেষ্টা করে। ফোনে মৌ এর সঙ্গে কথা হয় রোজ। ওর পরামর্শ অনুযায়ী মৌ ওয়ার্ক ফ্রম হোম এর সুবিধা দেওয়ার জন্য আবেদন জানায় অফিসে । মৌ যে বেসরকারি সফ্টওয়্যার কোম্পানিতে ব্যাঙ্গালোরে কাজ করে, তারা যথেষ্ট সহযোগিতা করে। মৌ দিনের পর দিন কলকাতায় থেকে ওয়ার্ক ফ্রম হোম আর সকালে বিকালে হাসপাতালে গিয়ে বাবাকে দেখে, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে। দেখতে দেখতে এক মাস কেটে যায় । ডাক্তার বাবু জানান এখন সুকান্তবাবু খানিকটা সুস্থ ; আর কয়েকদিনের মধ্যে ওনাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন । কিন্তু বাড়িতে গেলেও সব সময় বিশেষ দেখভাল এবং যত্ন প্রয়োজন । প্রয়োজন প্রতিদিন চেকআপ এবং প্যারালিসিস এর জন্য রোজ ফিজিওথেরাপি ও স্পিচ থেরাপি । ওনার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়তো হবে কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই ।
মৌ এর মাথায় আরো একবার বাজ ভেঙে পড়ে । দাদার সঙ্গে ফোনে আলোচনা করে ; মনোজ সম্পূর্ণ ভাবে বাবার চিকিৎসার খরচ দিতে চায় , কিন্তু দায়িত্ব? সত্যি কি সেই সুদূর সাত সমুদ্র পারে বসে দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব , না কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব ! মৌ বার বার পরামর্শ করে সুকমলের সঙ্গে । সুকমল সব সময় ওর পাশে থেকেছে, ওকে সাহস যুগিয়েছে । কিন্তু দিনের শেষে মৌ এর মনে হয় সে বড় একা। এইরকম কঠিন সময় ওর পাশে কেউ নেই । কিন্তু মৌ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বাবাকে সে সুস্থ করে তুলবেই। দুবছর আগেই ও মাকে হারিয়েছে হঠাৎ হার্ট এট্যাকে। তখন মায়ের জন্য কিছু করার সুযোগই পাইনি । মৌ মনস্থির করে-- কি ভাবে কি করা যায় , তা ওকেই সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ।
বাবাকে এই অবস্থায় একা বাড়িতে রেখে ওর পক্ষে ব্যাঙ্গালোর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়, আর ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়, ওখানে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়তো সম্ভব ; কিন্তু এখন ওর শাশুড়ি থাকেন ওদের সঙ্গে, উনিও অসুস্থ । মা মারা যাওয়ার পর বাবাকে যখন মৌ কিছু দিনের জন্য নিয়ে গিয়েছিল ব্যাঙ্গালোরে তখন মুখোমুখি কোন ঝামেলা-ঝগড়া না হলেও নানা ছোট খাটো ব্যাপারে পরিবেশটা বেশ অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল । তার উপর বাবা এখন এতটাই অসুস্থ । তিন্নির ক্লাস নাইন, পড়াশুনার চাপ, সুকমল আর ও নিজেও অফিসের কাজে প্রায় দশ - এগারো ঘন্টা বাড়ির বাইরে থাকে।
ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী মৌ সিদ্ধান্ত নেয় বাবাকে এক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে রাখা হবে । এটি একটি নার্সিং হোমের সঙ্গে যুক্ত । নার্সিং হোমটি পাশেই। প্রতিদিন নার্সিং হোম থেকে ডাক্তারবাবু এসে দেখে যাবেন সুকান্তবাবুকে। প্রতি সপ্তাহে স্পেসালিস্ট ডাক্তার আসবেন। প্রতিদিন সবরকম থেরাপি হবে । মৌ বাবাকে হাসপাতাল থেকে সোজা নিয়ে আসে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে । সব ব্যবস্থা করে এক সপ্তাহ পর ব্যাঙ্গালোরে ফিরে আসে মৌ। বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে আসে অপরেশ কাকুর উপর।
এরপর শুরু হয় এক মানসিক যুদ্ধ । কাকা, পিসি, মামা মামী এমনকি দুঃসর্ম্পকের আত্মীয় স্বজনরা ফোনে নানা কথা শোনাতে থাকে মৌকে, কখনো সোজাসুজি কখনো বা ঘুরিয়ে। সে বাবার খেয়াল না করে ব্যাঙ্গালোরে কেন ফিরে গেল অথবা বাবাকে সঙ্গে নিয়ে গেল না কেন, এই নিয়ে নানা প্রশ্ন বানে মৌ জর্জরিত হতে থাকে । কিন্তু মৌ নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। ও বিশ্বাস করে বাবার জন্য যে ব্যবস্থা ও করেছে ওনার স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য তাই শ্রেয়। কাউকে যুক্তি দিয়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করে না কারণ ও জানে ওর পরিস্থিতি কেউ বুঝবে না। এর ফলে অনেকে ওকে ভুল বোঝে। দুবছর টানা প্রতি তিন মাস অন্তর কলকাতায় যায়, বাবার সঙ্গে দেখা করে, বাবার শারীরিক উন্নতির খবর নেয়, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে; নিজের কর্তব্য করে চলে ও নিজের সংকল্পে অটল থাকে বাবাকে সে সুস্থ করে তুলবে ।
এর মধ্যে তিন্নি আই সি এস ই পাশ করে, ওর পড়াশুনোর চাপ আরও বাড়ে। তারপর হঠাৎ মৌ এর শাশুড়ি মারা যান। বাবাকে ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে আসতে খুব ইচ্ছে হয় মৌ এর, কিন্তু যে ভাবে চিকিৎসা চলছে তার মাঝে নিয়ে আসার সাহস হয় না । প্রায় বছর দুই পর অনেকটা সুস্থ হন সুকান্তবাবু। আর তখনই ওই রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার থেকে জানানো হয় " এখন সুকান্তবাবু অনেকটাই সুস্থ, ওনাকে বাড়ি নিয়ে যান"।
স্বাভাবিক ভাবেই বাবাকে আর ওখানে রাখা চলে না। আরও একবার চিন্তার পাহাড় নেমে আসে মৌ এর উপর। সুকান্তবাবুর হাঁটাচলা বা কথাবার্তা এখনও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নয়। মৌ বাবাকে ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে আসতে চায় কিন্তু সুকান্ত বাবু রাজী হন না। এটা কি অভিমান? হতেও পারে। উনি নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে চান। কিন্তু মৌ এই অবস্থায় কি করে ওনাকে একা বাড়িতে রেখে আসে , শুধু অঞ্জলি মাসির ভরসায়! বাবা ব্যাঙ্গালোরে যেতেও নারাজ। মৌ দাদা ও সুকমলের সঙ্গে পরামর্শ করে কিন্তু শেষ সিদ্ধান্ত ওকেই নিতে হবে ।
এরপর শুরু হয় মৌ এর এক নতুন কাজ । খোঁজ শুরু হয় বৃদ্ধাশ্রমের। ইন্টারনেট ও বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে সন্ধান পায় বেশ কিছু ভাল বৃদ্ধাশ্রমের । নিজে বেশ কয়েকটিতে যায় । সমস্ত ব্যবস্থাপনা, সুযোগ সুবিধা, চিকিৎসা ব্যবস্থা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে। শুধুমাত্র কতৃপক্ষ নয়, ওখানকার আবাসিক বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের সঙ্গেও কথাবার্তা বলে, এবং প্রথমবার জানতে পারে বেশ কয়েকজন বৃদ্ধ বৃদ্ধা ঐ বৃদ্ধাশ্রমে সম্পূর্ণ স্বইচ্ছায় আছেন। ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকেন। কলকাতা শহরে এনাদের নিজেদের বাড়িও আছে । কিন্তু একা বাড়িতে থাকার সমস্যা অনেক । রোজকার দোকানবাজার, বাড়ির নানা ছোটখাটো কাজ , সর্বোপরি একাকিত্ব, এই সবের প্রতিকারের জন্য ওনারা বেছে নিয়েছেন এই " শান্তি নীড়"। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সুব্যবস্থা সম্পন্ন এই " শান্তি নীড় " বেশ পছন্দ হয় মৌ এর।
সুকান্ত বাবু কিন্তু নারাজ। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন আরও একবার নানা কথার ঝড় তোলে। মৌ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে। কি করবে ও? বাবাকে বাড়িতে একা রাখার বিরোধী ডাক্তারবাবুও। যে ডাক্তারবাবুর চিকিৎসায় বাবা ওইরকম কঠিন অবস্থা থেকে সুস্থ হয়েছেন, তার কথার মূল্য তো দিতেই হবে। অনেক কষ্টে মৌ বাবাকে রাজী করায় অন্তত ছ'মাস বৃদ্ধাশ্রমে থাকার জন্য । ব্যাঙ্গালোরে উনি যেতে চান না তাই আপাতত মেয়ের কথায় রাজী হন সুকান্ত বাবু। কিন্তু কয়েকদিন পর থেকেই ওনার আর ওখানে থাকতে ভাল লাগে না। কোনমতে চার মাস কাটিয়ে একরকম জোর করেই উনি ফিরে আসেন নিজের বাড়িতে । এতদিন মৌ কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত ছিল যে বাবা এমন একটি জায়গায় আছেন যেখানে শুধু বাবার দেখভালের জন্য অভিজ্ঞ মানুষজন রয়েছেন তা নয়, হঠাৎ অসুস্থ হলেও ওনারাই চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন । আবার সেই অঞ্জলি মাসি আর অপরেশকাকুর ভরসা । অপরেশকাকুকেই বা ও কত ঝামেলায় ফেলবে !
একটি এজেন্সির সাথে মৌ ব্যবস্থা করে যারা প্রতিদিন ফোনে খবর নেয় ও সপ্তাহে একদিন বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা ও সবরকম প্রয়োজনের খবর নেয় ও ব্যবস্থা করে। এখন এসব অনেকরকম সুবিধা আছে শহরে, সুকান্তবাবুর মত অনেক বয়স্ক মানুষরাই একা থাকেন, তাঁদের সুবিধার্থেই এসব সেন্টার গড়ে উঠেছে ।
বেশ কিছুদিন বাড়িতে থাকার পর অনেক কষ্টে রাজী করিয়ে দু মাসের জন্য মৌ বাবাকে নিয়ে এসেছিল ব্যাঙ্গালোরে । "বাবার আজও কি অভিমান, সেই অসুস্থতার সময় ও নিয়ে আসতে পারে নি বলে? বাবা নিজমুখে কিছুই বলেন নি কখনও । কিন্তু উপায় থাকলে কি সে নিয়ে আসত না? বাবাকে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার ও বৃদ্ধাশ্রমে রাখার জন্য কত কথাই না সে শুনেছে। এখন তো বাবা বাড়িতেই থাকে - ক'জন আসে দেখতে!"
হঠাৎই ফ্লাইটের এনাউন্সমেন্টে সজাগ হয় মৌ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবে কলকাতা । সুকান্তবাবুও জেগে উঠেছেন-- মুখে হাসি , বললেন, "কলকাতায় এলেই মনটা ভাল হয়ে যায়" । কিন্তু মৌ এর মনটা যে খারাপ হয়ে যায় এখানে বাবাকে একা রেখে যেতে, সেটা কি বাবা কোন দিন বুঝবে না? দুদিন পরই ফিরে যেতে হবে তাকে । আবার সেই অফিস আর বাড়ি। এই দু মাস বাবা ছিলেন, কত ভাল সময় কেটেছিল সকলে মিলে হৈ হৈ করে। বাবা কেন একটু বুঝল না ওকে ।
অনেক চিন্তা জট পাকাতে থাকে মৌ এর মনে। বাবা মায়েরা হয় তো অনেক সময়ই সন্তানদের ঠিক বুঝতে পারে না। ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশুনো করছে বা চাকরি করছে সেই আনন্দে গৌরবান্বিত হন, কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই চিন্তাধারারও পরিবর্তন হয় । নিজের বা নিজেদের একাকিত্ব দূর করার জন্য কাছে পেতে ইচ্ছে করে ছেলেমেয়ে নাতি নাতনিদের। কিন্তু ততদিনে তারা অন্য এক জগতের বাসিন্দা। নিজ নিজ কর্মস্থলে তাদের নিজেদের রাজত্ব বিস্তার করে ফেলেছে । হঠাৎ হঠাৎ সেই রাজত্ব ছেড়ে চলে আসা সম্ভব হয় না। ঐ যে দেখা হয়েছিল " শান্তি নীড় " এ শ্রী প্রবাল বিশ্বাসের সঙ্গে , হ্যাঁ নামটা আজও মনে আছে মৌ এর কারণ কথা বলে খুব ভাল লেগেছিল ওর। উনি বলেছিলেন, " আমার কাছে এখানে থাকাটা কোন অভিশাপ নয়, আমাকে কেউ বাধ্য করে নি এখানে থাকতে। আমি নিজের সুবিধার্থে, ছেলেমেয়েদের সুবিধার্থে স্বইচ্ছায় থাকি এই " শান্তি নীড় " এ। খুব ভাল আছি, আনন্দে আছি ।" মৌ ভাবে "সবাই যদি ওনার মত ভাবতে পারত? বাবার তো ওখানে কারোর সঙ্গে সেই ভাবে বন্ধুত্ব হয় নি।" কোথাও থাকতে গেলে এই বন্ধুত্ব হওয়াটা খুব প্রয়োজন । কিন্তু বেশ কয়েকজনকে মৌ দেখেছে যারা হৈ হৈ করে মাতিয়ে রেখেছিলেন ঐ বৃদ্ধাশ্রম।
মৌ ভাবতে থাকে, "তিন্নি তো পড়াশুনো শেষ করে কোথায় চাকরি করবে বা বিয়ের পর কোথায় থাকবে ঠিক নেই। আমরাও এরকমই কোন এক "শান্তি নীড় " কি খুঁজে নিতে পারি না ভবিষ্যতে"?