রুদ্ধকল্প
রুদ্ধকল্প


---"এই তোমায় আমি বড্ড ভালোবাসি।"
পার্কের বেঞ্চে বসা হালকা গোলাপি চুড়িদার পরা মেয়েটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল অনিক।
একটু যেন কেঁপে উঠল মেয়েটা,তারপরই হেসে উঠল শব্দ করে,
--"ভালোবাসা!!পাগল হলে নাকি?"
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল অনিক,এদিকে তখন শব্দ করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে রিমি।
--"কি হল?হাসছিস কেন এত?এমন কি বলে দিলাম তোকে!!"
--"না না সেরকম কিছু না...আসলে...থাক বাদ দাও।" হাসির দমক সামলে কোনোক্রমে বলে রিমি,চোখে জল ভরে আসে তার।
--" আজ ভালোবাসার দিন,তাই ভাবলাম আজ তোকে মনের কথাটা বলেই দিই।কিন্তু তুই এভাবে মজা করবি জানলে কোনোদিন বলতাম না,বড্ড কষ্ট দিলি আজ।" ছলছল চোখে পার্কের গেটের দিকে হাঁটা লাগায় অনিক,পেছন থেকে গম্ভীর গলায় শব্দ ভেসে আসে,--"দাঁড়াও।"
--"আমি তোমায় কষ্ট দিতে চাইনি,আসলে ভালোবাসা শব্দটাতে আমি বিশ্বাস করিনা আর।অনিকদা,তুমি বড্ড কাছের,সবকিছুই জানো,তারপরও এরকম করবে আশা করিনি।" দলাপাকানো কান্নাটাকে কোনোক্রমে চেপে রেখে মাটিতে বসে ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে জবাব দেয় রিমি।
হাঁটুমুড়ে বসে রিমির মুখের দুইপাশে নিজের হাতের তালুদুটো চেপে ধরে অনিক,
--"সব জানি আমি রি,সব বুঝি রে,তবু তোকে চাই।বিশ্বাস করে দেখিস,ঠকবি না এবার।একবার সুযোগ দে,শুধু একবার,নিজেকে প্রমাণ করার,আগলে রাখব তোকে,কাউকে আসতে দেব না,কাউকে না।" রিমির কপাল বেয়ে নেমে আসা চুলগুলোকে আলগোছে সরিয়ে ঠোঁটখানা তার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় অনিক।চোখ বন্ধ করে ফেলে রিমি,নিকোটিনের কড়া গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে তার,কানে ভেসে আসে একটা গলার স্বর ও তার কিছু কথা, "কোত্থাও যেতে দেব না,আগলে রাখব,কোনোদিন ছেড়ে যাব না,কোথাও যাব না।"
--"না আ আ আ আ।" তীব্র চিৎকারের সাথে অনিককে ধাক্কা মেরে সরিয়ে উঠে দাঁড়ায় রিমি,চোখমুখ লাল হয়ে গেছে তার,থরথর করে কাঁপছে সে,হিস্টিরিয়া রোগাক্রান্তের মত চিৎকার করে সে,
--"কাউকে চাই না আমার জীবনে,কাউকে না।কেউ কথা রাখেনা,কোনোদিন রাখবে না।আর কাউকে সুযোগ দেব না আমি,কোনোদিন না,আজকের পর আমার সাথে আর দেখা করবে না অনিকদা,ভালোবাসাকে ঘেন্না করি আমি।শুনতে পাচ্ছ??ঘেন্না করি আমি ভালোবাসাকে।" ছুটে বেরিয়ে যায় সে পার্ক থেকে,তার গমনপথের দিকে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে অনিক।প্রাক বাসন্তিক সন্ধ্যা নামে গাছপালার ফাঁক বেয়ে আকাশে সিঁদুরে আবীর ছড়িয়ে।
* * * *
বিছানার ওপর চুপ করে বসে আছে অনিক,পাশে রাখা সকালে কেনা লাল গোলাপগুচ্ছ, এর মধ্যেই কেমন শুকিয়ে এসেছে,ফিকে হয়ে এসেছে রঙখানা।সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রায়ান্ধকার ঘরে দমবন্ধ পরিবেশ,যত্ন করে লেখা গ্রিটিংস কার্ডখানা চার টুকরো হয়ে গড়াচ্ছে মেঝেতে।এখনো পর্যন্ত প্রায় পঁচিশ বার কল করে ফেলেছে সে রিমিকে,কিন্তু সে ফোন ধরেনি।কি করছে মেয়েটা কে জানে,বড্ড চিন্তা হচ্ছে অনিকের।সে তো চেয়েছিল রিমিকে সুখী করতে,তার কষ্টগুলোকে আপন করে নিতে,কিন্তু রিমি এভাবে আচরণ করবে ভাবেনি,তবে কি সে কোনো ভুল করল!! শেষ সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে চালান করে জানলার পাশে এসে দাঁড়ায় অনিক,আকাশে জ্বলজ্বল করছে একলা চাঁদ,কেমন যেন শূন্যতাবোধ চারিদিকে।আজ ফেব্রুয়ারির চোদ্দ তারিখ,কত কষ্টে সাহস সঞ্চয় করেছিল এই দিনটার জন্য,রিমিকে দিতে চেয়েছিল সর্বসুখ,জীবনটাকে করে তুলতে চেয়েছিল কুসুমাকর, তার বদলে.....
--"ক্ষমা করিস রিমি,সব জেনেও বড্ড আঘাত দিয়ে ফেলেছি তোকে।ভেবেছিলাম সময় সব ক্ষত ভুলিয়ে দেয়,কিন্তু কিছু আঘাতের ওপর যে সময়ও প্রলেপ দিতে অক্ষম, ভুলেছিলাম।ক্ষমা করে ফিরে আয়,আজীবন পাশে থাকব,যেভাবে চাস সেভাবেই,একবার ফিরে আয়।" ডুকরে ওঠে অনিক,নোনাজল গড়িয়ে নামে অভিজ্ঞ চক্ষুদ্বয় দিয়ে।
* * * *
অন্ধকার ছাদে একলা বসে রিমি,সামনে গড়াগড়ি খাচ্ছে সদ্য শেষ হওয়া ওল্ড মঙ্কের বোতলটা।জবাফুলের মত লাল চোখ,ফোলা গালে শুকনো জলের দাগ।
--"অনিকদা কেন?কেন জাগিয়ে তুললে সেই পুরানো ক্ষত?তুমি জানো না আমি ওই স্মৃতি থেকে পালাতে চাই,আমি ভালোবাসা থেকে পালাতে চাই!! সবই তো জানো তুমি,তাও!! কেন করলে এরকম,কেন!!" দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে গুঙিয়ে ওঠে রিমি,চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুবছর আগের কিছু ছেঁড়া ডাইরির পাতা।
--"এই তুমি আমায় এত ভালোবাসো কেন বলোতো?কি আছে আমার ভেতর?" রিমির কোলে শুয়ে তার চোখে চোখ রেখে আদুরে গলায় প্রশ্ন করে সাগ্নিক।
--"কিছু দেখে তো ভালোবাসিনি,ভালোবাসি তাই ভালোবেসেছি,কারন কিকরে বলি বলো।"সাগ্নিকের নাকটা আলতো নেড়ে দিয়ে তার রেশম চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে রিমি।
--"কতটা ভালোবাসো আমায়?"
--"সঠিক পরিমাপ জানিনা,তবে যতটা ভালোবাসলে নিজেকে হারানো যায় ঠিক ততটা।তুমিও কখনো আমায় ফেলে পালাবে না তো?আমার মায়ের মতো?"
--"কোনোদিন যাব, বুকের মাঝে আগলে রাখব আজীবন,তোমায় কোথাও যেতে দেব না।"
--"মনে রেখো আমি কিন্তু কাটাঘুড়ি,হারালে একবার ফিরব না কোনোদিন।"
--"হারাবো বললেই হল!!সাধ্য থাকলে আমার সরিয়ে গিয়ে দেখাও।" দুবাহুপাশে তাকে জড়িয়ে নিয়ে বলেছিল সাগ্নিক।না পারেনি রিমি,আলগা করতে বন্ধন,দিনে দিনে আরো ডুবেছে পরম নির্ভরতায়।
কিন্তু সময় পরিবর্তনশীল, সে কবেই বা কার জন্য থেমেছে,সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বদলে গিয়েছে সাগ্নিকও।এককালে সবচেয়ে ভালো লাগা শাসন হয়েছে বিরক্তির কারণ, যে কথাগুলো সবচেয়ে ভালো লাগত শুনতে আজ তাই জ্বালা ধরায় কানে।না পারেনি রিমি আটকে রাখতে তাকে,সম্পর্কের জাল কেটে পাখি মুক্ত আকাশে উড়ে গেছে,নিজেকে প্রতিদিন একটু একটু করে নেশায় ডুবিয়েছে রিমি।পারিবারিক বন্ধন শিথিল থাকায় নিজ ধ্বংসসাধনে সমস্যা হয়নি তার,কলম ও নেশা এই হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার নিয়তি।সেখান থেকে তাকে বের করে অনিক,আস্তে আস্তে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে প্রায় মানসিক ভারসাম্য হারানো রিমি।আজ আবার......তবে কি নিয়তি এভাবেই প্রতিনিয়ত খেলবে তার সাথে?এসব থেকে কি কোনোদিনও মুক্তি নেই তার?? রাত বাড়ে পাল্লা দিয়ে নেশার মাত্রাও,প্রায়ান
্ধকার বিষাদের অতল খাদে তলিয়ে যেতে থাকে রিমি......আস্তে আস্তে।
* * * *
আচমকা মুঠোফোন বেজে ওঠায় চমকে উঠে বসে অনিক,কাল রাতে অপেক্ষা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল সে মনে নেই তার,তাড়াতাড়ি স্ক্রিনে চোখ রাখে সে----রিমি!!!
--"অনিকদা...." জড়ানো গলায় ওপার থেকে ভেসে আসে শব্দ।
--"কাল আবার তুই মদ খেয়েছিস রিমি?বারণ করেছিলাম না তোকে?শুনিস না কেন?যা হয়েছে ভুলে যা, আমি কিচ্ছু মনে রাখিনি বিশ্বাস কর।প্লিজ আবার তলিয়ে যাস না তুই,কোনোদিন ক্ষমা করতে পারব না নিজেকে।" একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁপাতে থাকে অনিক।
--"শসসসস।বলতে দেবে আমায়?আমার ওভাবে চলে আসা ঠিক হয়নি,পারলে ক্ষমা করে দিও।"
--"ধুর পাগলি,আমি ওসবে কিচ্ছু মনে করিনি রে,শুধু তুই ভালো থাক।"
--"একটা কথা বলার ছিল,বলব?"
--"হ্যাঁ বল,যত পারিস গালি দে।" রুদ্ধ হয়ে আসে অনিকের গলা।
--"উফফ,শোনো না।দেখো,আমার দ্বারা ভালোবাসা হবেনা,কিন্তু তোমাকেও আমি হারাতে পারব না।বলি আমাকে আজীবন সহ্য করতে পারবে?"
--"কি বলছিস তুই পাগলি?"
--"আমি যদি প্রতিদিন তোমায় শাসন করি,এটা কোরো না সেটা কোরোনা বলি তাও আমার সাথে থাকবে?যদি অন্য কারো সাথে বেশি সহজ হলে ঝগড়া করি,অভিমান করি মানিয়ে নিতে পারবে?যদি তোমায় জড়িয়ে বাঁচতে চাই,নির্ভর করতে চাই করতে দেবে?যদি মন খারাপ হলে মধ্যরাতে ফোন করে কাঁদি,কাঁদতে দেবে?যদি কথায় কথায় তোমায় আমার বলে দাবী করি,সবার সামনে তোমায় নিয়ে গর্ব করি করতে দেবে?নাকি বিরক্ত হয়ে অপমান করে ছেড়ে যাবে,আজই ভেবে উত্তর দাও,বেশি সময় নেই আমার।"
রুদ্ধবাক দাঁড়িয়ে থাকে অনিক,আনন্দাশ্রুকণা গাল বেয়ে নেমে ভিজিয়ে দেয় চিবুক,
--"সব অধিকার দিলাম পাগলি,যত পারিস পাগলামি কর,চাইলে আমায় নিয়ে পোস্টার লাগা,সব চলবে,শুধু তুই টা থাক।"
--"বেশ,তবে এখুনি এসো লেবুজল নিয়ে,ছাদে আছি,বমি করতে হবে।"
--"হতচ্ছাড়ি খেতে কে বলে অত?আজ যদি না চামড়া তুলেছি তোর,দেখ তুই।"
--"চামড়া তোলার জন্য প্রকাশ্যে আসতে হয়,ফোনে তোলা যায় না। "
ফোন রেখে দুদ্দাড় ছোটে অনিক,এদিকে তখন সদ্য পরিষ্কার হচ্ছে আকাশটা,পাখির দল কিচিরমিচির করতে করতে চলেছে কুলা ছেড়ে খাদ্য সন্ধানে,পাপড়ি মেলতে শুরু করেছে গোলাপকুঁড়িরা।।
(সমাপ্ত)