রঙ্গমঞ্চ
রঙ্গমঞ্চ
'মনিমালা, চা নিয়ে এসো' প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় বিমলবাবুর গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজ শোনা যায়। ঠিক তখনই অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে একটা রিনিঝিনি শিঞ্জিনীর আওয়াজ এগিয়ে যায় চিলেকোঠার ঘরটার দিকে। নিঃশব্দে ওনার ঘরে প্রবেশ করে একটা মোটা লালপাড়-সাদা-শাড়ী পরিহিতা রমণী, বুক অবধি আঁচল টেনে তার মুখ ঢাকা।
বিমলবাবু চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে 'আঃ' শব্দে মন্তব্য করলেই, সে গিয়ে বসে দক্ষিণাভিমুখী খোলা জানালাটার সামনে। পরম তৃপ্তিভরে বিমলবাবু চা-পান করেন আর অতীতের স্মৃতিমধুর গল্পে মশগুল হয়ে ওঠেন। রমণীটি শান্ত হয়ে কথাগুলো শোনে, যেমন শুনে এসেছে চিরটাকাল।
এই এলাকার প্রত্যেকে জানে বিমল মুখুজ্জ্যের প্রতাপের কথা। ওনাকে অমান্য করে, এমন বুকের পাটা এই অঞ্চলের কোনো মানুষের কোনকালেই ছিল না।
একমাত্র নাত্নি রুক্মিনী যখন এই আইনজীবী ঠাকুরদাদার কথার খেলাপ করে, ডাক্তারি না পড়ে নাটকে পারদর্শী হতে চেয়েছিল, তখন ওনার হুঙ্কারে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে, প্রকৃতিও বুঝি রুষ্ট তুফান হয়ে নেমে এসেছিল শহরতলিতে। স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূর শত চেষ্টাতেও গলেননি তিনি।
অভিমানিনী রুক্মিনী সেদিন ঘরছাড়া হয়েছিল নিজেকে প্রতিস্থাপন করার জেদে। বাড়ির আর সকলে মনে মনে ওনাকে ভর্ৎসনা করলেও, নিজের সিদ্ধান্তের জন্য এতটুকু অনুতাপ করেননি বিমলবাবু।
তবে আজ জীবনের শেষ ধাপে এসে মনে হয়, পুরো জীবনটাই একটা রঙ্গমঞ্চ। যে যার ভূমিকায় ক্ষুদ্র পুত্তলিকার মতন পূর্বনির্ধারিত লিপি অনুসারে অভিনয় করে চলেছে। এত মান-অভিমান, আবেগ-উত্তেজনা সবটাই বুঝি বৃহৎ কোনো মায়ার খেলা... রুক্মিনী না জানি আজ কোথায় আছে, কেমন আছে?
মনিমালা দেবী গত হওয়ার বছরখানেক পরেও, স্বামীর ডাককে উপেক্ষা করার সৎসাহস অথবা অভিলাষ, কোনোটাই বোধহয় ওনার হয়ে ওঠেনি। আজও আসেন ভালোবেসে, চায়ের পেয়ালা হাতে। বয়স্ক স্বামী যে বড়ো মনোক্লিষ্টের মধ্যে আছেন। সারাজীবন অতিবাহিত হয়ে গেল, সম্মান পেলেও আদৌ ভালোবাসা কি পেলেন কারুর? তাই প্রতিনিয়ত এই সন্ধ্যালগ্নে, নুপুরের মৃদুমন্দ শব্দের জানান দিয়ে তিনি ঠিক আসেন, স্বামীর আলো-আঁধারি মিশ্রিত বিশ্রামের ঘরটায়। শোনেন ওনার বিগত পৃথিবীতে ফেলে রেখে যাওয়া মানুষটার মনের কথা।
মণিমালাদেবীর পারাপার পেরিয়ে বিমলবাবুর ডাকে সাড়া দিয়ে আসাটা ওনার কাছে খুব স্বাভাবিক লাগলেও, ঐসময়টুকু এবাড়ির আর কেউ চিলেকোঠার ঘরের ধারেকাছে আসেনা। সবাই ভীতত্রস্ত, কারণ বাড়ির সকলেই জানে, মণিমালাদেবী আসেন ঠিক ওই সময়টায়। নানারকম পূজা-অর্চনা করেও না জানি কেন, এই অতিলৌকিক ভালোবাসার ছেদ ঘটানো সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি কারুর পক্ষেই।
ঘোমটার আড়ালে চোখের জল মোছে রুক্মিণী। আজ সে একজন স্বনির্ভর, সুপ্রতিষ্ঠিত, সুখ্যাত নাট্যকার।
কিন্তু মেকি মঞ্চে মুখস্ত ভূমিকায় অভিনয় করে সহস্র দর্শকদের করতালি কুড়ানোর থেকেও, এই অভিনয়ের প্রদর্শন যে আরও বেশি রোমাঞ্চকর।
এই বৃহদ জীবনের রঙ্গমঞ্চের কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, শ্রেষ্ঠ উপহারটি সে পেয়েছে অবশেষে! হাজারো আলোর রোশনাই, খ্যাতি, প্রাচুর্য এর কাছে যৎসামান্য। ক্যান্সার আক্রান্ত ঠাকুরদাদার সান্নিধ্য তার চাইতে যে বড়ো বেশি প্রাপ্তির।
কাছে থেকেও, সে তার ঠাকুরদাদার বহুদুরে। তবুও, মানুষটার তার প্রতি অগাধ স্নেহ অনুভব করতে পারছে! সংস্পর্শবিহীন এই অনুভূতিগুলোতে নেই কোনো তাপ-উত্তাপ, আছে শুধু অপার শান্তি আর স্নিগ্ধতা। আর এখানেই আছে পৃথিবী নামক এই সাংঘাতিক রঙ্গমঞ্চের ঊর্দ্ধে, জীব ও জীবনের সারসত্য।
তার ঠাম্মির বেশে রুক্মিণী আজ মানুষটার শেষ মুহুর্তগুলোকে রঙ্গীন রামধনুর মতন উজ্জ্বল করতে বদ্ধপরিকর!