মেঘের ডায়েরি থেকে...✍️ সব্যসাচী সাহা
মেঘের ডায়েরি থেকে...✍️ সব্যসাচী সাহা
মেঘের পথচলা
গরম এখনো ঠিক জমিয়ে বসেনি; তবে এ দেশে সবকিছুতেই যেন একটু বাড়াবাড়ি। ভয়ানক শীতে সামান্য উষ্ণতার জন্য লোকে সোয়েটার-জ্যাকেট জড়িয়ে রাখে, আর গরম এলেই তীব্র লু-এর তাণ্ডব! হঠাৎই সন্ধ্যের আকাশ কালো হয়ে এল, আর শুরু হলো শিলাবৃষ্টি। মাটির সোঁদা গন্ধ মিশে গেল বাতাসে, শিলার ঝমঝমে শব্দের মাঝে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। জানালার পাশে বসে মেঘ তাকিয়ে রইল বাইরে—মনের ভেতর চিন্তার ঝড়। যদি রাতেই দিল্লি স্টেশন পৌঁছানো যায়, তবে ভোরের কালকা মেইল ধরা যাবে। টিকিট নেই, রিজার্ভেশনও নয়, কিন্তু ট্রেনের টি.টি.-র সঙ্গে কথা বলে হয়তো একটা ব্যবস্থা করা যাবে। এখানে থাকলে চলবে না, আজই যেতেই হবে—কোনোভাবেই এই আলোচনাটা ফেলে রাখা যায় না।
সেদিন রাত কেটেছিল স্টেশনেই। পরদিন ভোরবেলা কালকা মেইল। মেঘের গন্তব্য কলকাতা, শুধুমাত্র কিছু না বলা কথা বলার জন্য।
ফিরে দেখা শহরপ্রায় তিন বছর আগে সে ঘর ছেড়েছিল। এই শহরে কিছু বন্ধু পেয়েছে, তাদের সঙ্গে তার ছোট্ট এক কামরার ঘরে রোজ আড্ডা, গল্প, হৈ-হুল্লোড়, উল্লাস—সব মিলিয়ে সময়কে বাঁধতে শিখে গিয়েছে মেঘ। ডিস্ট্যান্স MBA-তে IGNOU-তে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু ব্যস্ততার অজুহাতে বইয়ের পাতা আর খুলেই দেখা হয়নি। নতুন করে পড়াশোনা শুরু করতে একটা একাগ্র মন লাগে, একটা নিরিবিলি পরিবেশ লাগে—সেই মুহূর্তে দুটোই তার কাছে ছিল অনুপস্থিত।
ট্রেনে একটা বসার জায়গা জুটেছিল, তবে রিজার্ভেশন না থাকায় রাতটা ঠিক কেমন কাটবে, তা নিয়ে কোনো ভাবনাই ছিল না মেঘের। রাতটুকু কেটে গেলেই পৌঁছে যাবে সে কলকাতা। বিকেলেই যেতে হবে তার বাড়ি। অনেক কথা বলা বাকি আছে।
"একটা ফোন করেই কি জানিয়ে দেব আমার আসার কথা? না, থাক, বরং না বলাই ভালো," মেঘ ভাবল। কিন্তু নিজেকেও ঠিক বোঝাতে পারছিল না—সে আসলে কী চায়। এতটা বিভ্রান্ত, এতটা অস্থির সে আগে কখনো হয়নি। কিছু বোঝার আগেই যেন সবকিছু আপনাআপনি ঘটতে শুরু করেছে, তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
অজানা অনুভূতিট্রেনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল মেঘ। এতদিন কারও সাথেই সে কিছু শেয়ার করেনি, অনুভূতিগুলো ছিল একান্তই তার নিজের। জমে থাকা না বলা কথাগুলো কতটা যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে, সেই সত্যিটা বুঝে গিয়েছিল মেঘ। আর তাই, সে আর নিজেকে আটকাতে পারেনি। বলতেই হবে। সে ভালোবেসে ফেলেছে। হঠাৎ করেই। একেবারে অজানাভাবে।
প্রেম কখন আসে, কীভাবে আসে, সেটা কি কেউ জানে? একদিন হয়তো সে নিজেও ভাবেনি, অথচ আজ, এই মুহূর্তে, সে নিশ্চিত।
পরিবারের ছোঁয়াকিছুদিন আগে পূজোর সময় মেঘের বাবা-মা’র সঙ্গে তারাও তো এসেছিল দিল্লিতে। পূজোর দু’টো দিন কেটেছিল একসঙ্গে, দিল্লি কালীবাড়িতেই। দিল্লি এয়ারপোর্টে গিয়ে সবাইকে রিসিভ করেছিল মেঘ। এরপর পরিকল্পনা হলো—একটা গোটা দিন মেঘের সেই একটুকরো বাসস্থানে সবাই মিলে থাকবে, জমিয়ে রান্নাবান্না হবে, একরকম পিকনিকের আমেজেই কেটে যাবে সময়।
আগের দিন সারারাত ধরে মেঘ নিজের এই অবলম্বন আশ্রয়টাকে ধুয়ে-মুছে, পরিষ্কার করে রেখেছিল পরদিন তাদের স্বাগত জানানোর জন্য। ধুলো জমা অব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার, ঘরে থাকা গুটিকয়েক বাসন, তার রান্নাঘর—সবকিছুই যেন মনে হচ্ছিল একদম নতুন। অথচ সেদিন যেন মেঘ নিজেকেও একটু অন্যভাবে চিনেছিল।
ভুল বোঝার ভয়সারাদিন সবাই মিলে আনন্দে কাটিয়ে দিল—কত আড্ডা, কত গল্প! তবুও সেদিন যেন নিজের মনের কথাগুলো শুনতে পেল না মেঘ। ফ্যামিলি ফ্রেন্ড পরিচয়ের সূত্রে একসঙ্গে পথচলা, অভ্যস্ত সময়ের ছকে বাঁধা বন্ধন—সবই ছিল চেনা।
মেঘ কখনো কল্পনাও করেনি যে এমন কিছু ঘটতে পারে তার সঙ্গে। হঠাৎ করেই কীভাবে যেন এক অজানা টান তৈরি হলো তার প্রতি। কিন্তু যখন সেটা মেঘ অনুভব করল, তখনই বুঝল—এটাকে প্রকাশ করাটা এত সহজ নয়। মনের মধ্যে কথাগুলো জমিয়ে রেখেছিল, ভয় পেয়েছিল—সে যদি ভুল বোঝে মেঘকে?
শেষ প্রশ্নের উত্তরস্টেশন থেকে নেমে শহরের চেনা ব্যস্ততা চোখে পড়ল মেঘের। আকাশ আজ অনেক পরিষ্কার। সবাইকে অবাক করে বাড়ি ফিরে মেঘ ঠিক করেছিল, আজই কথা বলবে। কিন্তু রাতের পারিবারিক আলাপে সেই সুযোগটুকু পেল না। বলা হলো না তার কথা।
পরের দিন তার ফোন এসেছিল—
"মেঘ দা, তুই অনেক দেরি করে ফেললি রে! এতদিন তো কিছুই বলিসনি, এখন আর কিছুই হওয়ার নেই... আমার জীবনে কেউ এসে গেছে।"
ভালোবাসা কি কখনও অপেক্ষা করে? নাকি সময়ের বাইরে গিয়ে আর কোনো দাবি করা যায়? মেঘ বুঝল, কিছু অনুভূতি কেবল মনে রাখার জন্যই আসে, পাওয়ার জন্য নয়।
সময় এগিয়ে চলেআজ খুব ভোরেই ট্যাক্সি ডাকা হলো। অফিসের কাজে মেঘকে শহর ছাড়তে হবে। জানলার বাইরে এক ঝলক ছড়িয়ে পড়া নতুন দিনের আলো চোখে পড়ল। ঘুম না কাটানো অলস শহরের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে ছুটছে ট্যাক্সি। গাড়ির ভেতর মৃদু রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে—
"আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে..."
মেঘ ভাবল, মুক্তি তো কখনোই থেমে থাকার গল্প নয়, বরং নিরন্তর পথচলার প্রতিশ্রুতি। সে চোখ বন্ধ করল। মনে হলো, সময় তাকে খোঁচা দিয়ে বলছে—
"এতো কিছু নতুন এলো, পুরোনো কিছুর হিসেব মেলানোর দরকারটাই বা কী? প্রত্যেক ভোর এক নতুন দিগন্তের আহ্বান—আর সেই দিগন্ত ছুঁতেই তো যাত্রা!"

