লকডাউনের রোজনামচা ১৩
লকডাউনের রোজনামচা ১৩


ডিয়ার ডায়েরি, ৬ই এপ্রিল, ২০২০... লকডাউনের ত্রয়োদশ দিনে "জীবন বড় অনিশ্চিত"
আজ লকডাউনের তেরোতম দিনটি পার হয়ে যাচ্ছে। গত মাসের মানে মার্চের ৬ তারিখের ঠিক এইসময়ে আমি সপরিবারে তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেসে ছিলাম... হোলির ছুটির সাথে উইকেণ্ড মিশিয়ে নিয়ে সপ্তাহ খানেকের ছুটিতে উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স ও ভূটান গন্তব্য। বেশ খুশি মনে চলেছিলাম। তখন শুনেছি পৃথিবীর অন্যান্য দেশে করোনা ভাইরাসের কথা। অন্য দেশে আক্রমণের খবর শুনতে পাচ্ছি। তখনো বুঝতে পারছি না করোনা বা কোভিড ১৯-এর ভয়াবহতা সম্পর্কে। যাইহোক মার্চের ৭ তারিখ থেকে ভ্রমণ শুরু হলো। দিব্যি সব স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে। ৮ তারিখ সন্ধ্যায় আমাদের ট্র্যাভেল এজেন্ট খবর দিলো ভূটানে যাওয়া যাবেনা। বর্ডার লক হয়েছে ট্যুরিস্টের জন্য। তবে থার্মাল স্ক্রিনিঙে পাশ করলে কেবলমাত্র ফুন্টশিলিং শহর পর্যন্ত যেতে দেবে। কোনো নাইট স্টে করা যাবে না। সমস্ত হোটেল ট্যুরিস্টদের বুকিং ক্যান্সেল করে দিয়েছে ওদেশের সরকারি নির্দেশ মেনে।
আমরা ভাবলাম, ঠিক আছে ঐ টুকুই দেখে আসি, কয়েকঘন্টা তো মাত্র জলদাপাড়া থেকে যাতায়াতে। জয়গাঁও ভারত সীমান্ত শহরের ঠিক ওপারেই ভূটান সীমান্ত শহর ফুন্টশিলিং। মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার আবশ্যিক বর্ডার পেরিয়ে ফুন্টশিলিং যেতে চাইলে। সেভাবেই গেলাম এবং খুব হাসাহাসি করলাম নিজেদের মধ্যেই। সামান্যতম গুরুত্বও দিইনি। সন্ধ্যের মধ্যে ফিরেও এলাম আমাদের জলদাপাড়ার সরকারি ট্যুরিস্ট লজে। ভিড়ে গমগম করছে। বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে কাতারে কাতারে পরিবার ডুয়ার্সের জঙ্গলে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সন্ধ্যেবেলায় ট্রাইবাল নাচের অনুষ্ঠান হচ্ছে। কোথাও কোনো ছন্দপতনের আভাস মাত্র নেই। ভূটানে না থাকতে পারায় আমাদের হাতে তখনো বাড়তি তিনটি দিন। ডুয়ার্সের জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালাম, বাড়তি কিছু ট্যুরিস্ট স্পটে গেলাম। সব জায়গায় ট্যুরিস্টদের ঠাসা ভিড়। তারপর ১৪ তারিখ রাতের ট্রেনে ফিরেও এলাম। সেদিনই শুনেছিলাম... হাজব্যাণ্ডের কলেজ থেকে এক সরকারি নির্দেশের কথা... ১৬ই মার্চ থেকে আমাদের রাজ্যের সব স্কুল, কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হস্টেল বন্ধ থাকবে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত।
তারপর কলকাতায় ফিরে এসে শুনলাম ও ৩১শে মার্চ পর্যন্ত সময়টা বেড়ে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত সব স্কুল কলেজই বন্ধ থাকবে। তখনো লকডাউন হয়নি, আন্তর্জাতিক ও আন্তঃরাজ্য বর্ডার খোলা, ট্রেন চলছে, বাস চলছে। শুধুমাত্র স্কুল কলেজ বন্ধ। তারপর ২২শে মার্চ ঘোষণা হলো শুধু আমাদের রাজ্যে ২৩ থেকে ৩১ মার্চ লকডাউন। তারপর ২৪ তারিখ থেকে তো সারা দেশ জুড়েই ২১ দিনের লকডাউন শুরু হলো। গোটা পৃথিবীর খবরে আমার দেশের নাম জুড়ছে শুনে প্রথমবারের জন্য শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে একটা বরফ শীতল স্রোত বয়ে গেলো। তারপর থেকে এই লকডাউনের প্রতিটি দিনেই নতুন কিছু শিখছি। নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হচ্ছে রোজই। কী সাংঘাতিক সহনশীলতা রপ্ত করেছি এই কদিনে।
প্রতি সকালে সারাটাদিন ভালো ভাবে নির্বিঘ্নে চলার শপথ নিচ্ছি। প্রার্থণা করছি করোনা ভাইরাসমুক্ত পৃথিবীর। তার মধ্যেই খবর শুনে বিচলিত হচ্ছি, আবার সামলে নিচ্ছি। একে অপরকে স্বান্ত্বনা দিচ্ছি, পরামর্শ দিচ্ছি। আর মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের যুগে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মানে আসলে ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং। মনে মনে আর ফোনে ফোনে তো আমাদের মধ্যবিত্ত মানসিকতায় জুড়েই আছি সবাই। অপেক্ষা করে আছি আগামী মাসের ৬ তারিখেই যদি সব ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে পারি... কোভিড ১৯-এর ভ্যাকসিন, প্রামাণ্য ওষুধ সব দেশে... পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় পৌঁছে যায় যেন। আশায়, শুধুমাত্র সেই সদর্থক আশায় দিন গুনছি। -