গুলাল আবু বকর

Comedy

4  

গুলাল আবু বকর

Comedy

কে ধরবে হাঁস, মানে হাঁসা!

কে ধরবে হাঁস, মানে হাঁসা!

12 mins
427




সাঈদ মুন্সী একজন সজ্জন ব‍্যক্তি। পাড়া প্রতিবেশী থেকে আরম্ভ করে কাছাকাছি এলাকার বেশিরভাগ মানুষ তথা সকল আত্মীয়স্বজন তার দয়াদাক্ষিণ‍্য আর সদগুণের প্রশংসা করে থাকে। তাই বলে আড়ালে যে তার নিন্দুক নেই তা কিন্তু নয়। অনেকে নিন্দাকে তাদের প্রিয় প‍ছন্দ হিসেবে নিয়ে থাকে। ভালো কিছু অন্বেষণ করার স্বভাব ওদের ধাতে নেই। সত্যিটা হলো, বিশ্বে কোন্ ভালো মানুষের নিন্দুক পাওয়া যায় না!


       তা, সেই সাঈদ মুন্সীর ছিলো একখানা বড় পুষ্করিনী মানে পুকুর। তার বাসস্থান থেকে খানিক দূরে, হেঁটে তিন মিনিটের রাস্তা। পুকুরটি দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বেশ বড়। বিঘা দেড়েক জায়গা জুড়ে সেটি বিস্তৃত। আশেপাশের বয়স্ক মানুষ, কম বয়সী ছেলেপুলে, সাঁতার জানা শিশু, সাঁতার শিখতে আসা শিশু, কাপড় কাচতে আসা নারী, গরুর গা ধোওয়ানোর জন্য চাষা, বাসন মাজার সরঞ্জামসহ বধূ...এমন সকল ধরনের জল-প্রত‍্যাশী মানুষ অল্প বেলা হওয়ার পর থেকে বিকেল গড়ানোর আগ পর্যন্ত পুকুর তোলপাড় করতে থাকে।


       বহুবছর আগে পুকুরের একটি দিকে তৈরি করা হয়েছিলো একটি শান বাঁধানো ঘাট। বাল‍্যবয়সে যারা এটি তৈরি হতে দেখেছিলো তাদের কেউ কেউ এখন বৃদ্ধ এবং কেউ বা আজ ইহজগতে নেই। ঘাটটি বসিয়েছিলেন সাঈদ সাহেবের বাবা। দুপুরের আগে এই ঘাট কানায় কানায় ভরে যায়, মনে হয় কোনো অনুষ্ঠান বাড়ির কাজকর্ম চলছে। সাঈদ সাহেব প্রতি বছর পুকুরে মাছ চাষ করেন। বছর শেষে কতটা কী হিসাব পেতেন জানা যায় নি। আর্থিক লাভের জন্য নাকি শখ করে তিনি মাছ চাষ করতেন তাও কখনো বলেননি। তার কারণ পাড়ার ছেলেপুলেরা কত কায়দায় যে মাছ তুলে নিয়ে যেতো তার প্রমানাদি কেউ রাখেনি। ছিপ ফেলে, ঝুড়ি চাপা দিয়ে, ছোট ছোট জাল দিয়ে, নাইলনের একপ্রকার সুক্ষ্ম জাল পেতে রেখে ― এমন আরও কত কি। তার সম্পত্তির এইসকল অবৈধ ভক্ষণ সত্ত্বেও আড়ালে তার নিন্দা করায় ভাটা পড়েনি। পুনরাবৃত্তি করে বলি, তবে প্রশংসার লোকই সংখ‍্যায় বেশি।


   একবছর এক গ্রীষ্মের শুরুতে তার নিজের পাড়ার কয়েকজন চ‍্যাংড়া ছেলেপুলে ঠিক করলো খেলাধুলার এক গ্রাম‍্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। এই সূত্রে একটি বড় পুকুর প্রয়োজন। সাঈদ সাহেব তাদের পুকুরটি ব‍্যবহারের অনুমতি দিলেন। অন‍্যান‍্য খেলার মধ্যে আছে নানারকম দৌড়, যেমন তিন পায়ে দৌড়, পিছন দিকে দৌড়, বস্তা দৌড়, অন্ধের হাঁড়ি ভাঙা, মিউজিক‍্যাল চেয়ার, চোখ বেঁধে হাঁটা ইত্যাদি। দু'দিনের আয়োজন। শেষদিন দুপুরবেলা একটি খেলা দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হবে। খেলাটি হলো পুকুরে নেমে হাঁস ধরা। সন্ধ্যায় পুরস্কার বিতরণ। আমার এখনকার কাহিনী সেই হাঁস ধরার বৃত্তান্ত নিয়ে।


       এই খেলাটির উপকরণ বলতে তেমন কিছু লাগে না। একটি বড় পুকুর আর কয়েকটি হাঁস হলেই চলে যায়। তবে নিরীহ মনমরা হাঁস নিলে খেলার মজা আর পাওয়া যায় না এবং খেলা বেশিক্ষণ টিকবেও না। তাই হাঁস নির্বাচন করাটা বেশ জরুরি। কয়েকটি পূর্ণবয়স্ক হাঁসা হলে ভালো হয় কারণ সেগুলো হাঁসীদের তুলনায় বেশি চটপটে। দেখা গেলো এরা সত‍্যসত‍্যই চারখানা তেজি হাঁসা যোগাড় করে এনেছে। যেহেতু পুকুরখানা বড় তাই পুকুরের স্থানে স্থানে স্বেচ্ছাসেবী পর্যবেক্ষক দাঁড় করানো হলো। এখানে অন্য আরও অনেকের সঙ্গে মেয়েরা রইলো দর্শকের ভূমিকায়। এ খেলায় অংশগ্রহণ মোটেও তাদের উপযুক্ত নয়। প্রতিযোগী হিসাবে বালক আর যুবক মূলত নাম লেখালো। কয়েকটি ফাজিল ছেলে জোর করে কয়েকজন প্রৌঢ়কে জোরজবরদস্তি পুকুরে নামিয়ে দিলো। হুড়োহুড়ি করে নামিয়ে দেওয়ায় তাদের লুঙ্গি গেলো ভিজে, কারো বা পাঞ্জাবি। অগত্যা মুখ কাঁচুমাচু করে কষ্টের হাসি হেসে তারা প্রতিযোগিতায় থেকে গেলো। সব মিলিয়ে প্রতিযোগী হলো জনা কুড়ি। বেশিরভাগ আদুল গায়ে, মানে জামা গেঞ্জি না পরে খালি গায়ে। বেশিক্ষণ জলে থাকতে হবে এটা ভেবে কেউ কেউ গায়ে আগমার্কা খাঁটি সরিষার তৈল মর্দন করে নিলো।


       পর্যবেক্ষকদের একজনকে প্রধান রেফারি করে খেলা শুরু হতে চলেছে। পুকুরপাড় ভরে গেছে রঙবেরঙের জামাকাপড় পরা পুরুষ, নারী, বাচ্চা দর্শকে। সবাই প্রত‍্যাশা করে আছে একটি জমজমাট খেলা দেখার জন্য।

       উদ‍্যোক্তা পক্ষের দু'জন তরুণ দুই হাতে একটি করে মোট চারটি হাঁসা নিয়ে চৌকো পুকুরের মোটামুটি মাঝ বরাবর ছেড়ে দিয়ে এলো। ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে তারা সবকটা এক জায়গায় জড়ো হয়ে গেলো। তারপর সবাই ডানা ঝাড়া দিয়ে ঘুরে ঘুরে পরিস্থিতি কি হতে যাচ্ছে তা বুঝে নিলো। চারিদিক সব দেখেশুনে বোধহয় বুঝলো তাদের জন্য নতুন কিছু অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে । এতদিন তারা নির্ঝঞ্ঝাট পুকুরে জলকেলী করে এসেছে, কেউ কোনোদিন বিরক্ত করেনি। কিন্তু পুকুর ঘিরে আজ এরা সব কারা, কেন তাদেরকে এমনভাবে রেখে হৈহল্লা করছে আর হাততালি দিচ্ছে! তারা খানিক ভীত হয়ে একজায়গায় ভেসে কয়েকপাক ঘুরে নিলো আর গলা বাড়িয়ে ঠোঁট দিয়ে জল তুলে মাথা ভেজাতে থাকলো খানিকক্ষণ। বোঝাতে চাইলো, এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির মোকাবেলায় মাথা ঠাণ্ডা রাখা প্রয়োজন।


       ঐ দুটি ছেলে পাড়ের কাছাকাছি চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে রেফারির বাঁশি বেজে গেলো। প্রতিযোগীরা এবার ঝুপ্ ঝাপ্ করে ঝাঁপিয়ে পড়লো জলে, যেন রাজ‍্য জয়ের কোনো ডাক তাদের কাছে এসেছে। যারা একটু ভালো সাঁতার জানে তারা নানা কসরৎ করে এগোতে থাকলো। জোর করে নাম লিখিয়ে দেওয়া জনা তিনেক প্রৌঢ় ইতস্ততঃ করছিলো যাবো কি যাবো না, এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে। আশপাশে থাকা কয়েকটি ছোকরা দু'জনকে ধাক্কা দিয়ে পাঠিয়ে দিলো জলে আর বাকিজন তাল খুঁজছিলো কেটে পড়ার কিন্তু ধরা খেয়ে তার কপালে জুটলো অন‍্যরকম নাটক। তাকে চ‍্যাংদোলা করে তুলে আলতোভাবে জলে ছুড়ে দিলো। অন‍্যসময় হলে বয়স্কদের সাথে এমন ইয়ার্কি কেউ বরদাস্ত করতো না, কখনো। কিন্তু মজার আবহে আজ তারা ছোটদের মাফ করে দিচ্ছে। সাঁতারে তারা কম বয়সীদের সাথে এঁটে উঠবে না এটা তারা নিজেরাও জানে। তবুও নিমরাজি হয়ে তারা যোগ দিয়েছে খেলায় শুধু একটু আমোদ বৃদ্ধি করার জন্য। দর্শকরা তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য জোরে হাততালি শুরু করলো। এতে করে তরুণ প্রতিযোগীদের উৎসাহ আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। পুকুরে তখন কুড়িজন মানুষের দাপাদাপি শুরু হয়ে গেছে, ফলে অদ্ভুত এক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে।


       হামলে পড়া মানুষজন তাদের দিকে ধেয়ে আসছে দেখে সবকটা হাঁস এবার প্রমাদ গুনলো। চারিদিকে তারা ঘেরাও, ঠিক পুলিশী কায়দায়। ভেবে পায়না কোনদিক দিয়ে পালানো যায়। তারা চঞ্চল হয়ে উঠলো। এখন যেদিকে যাবে ধরা পড়ে যাবে। ফাঁকফোকর খোঁজার চেষ্টা যখন বৃথা, সকলে মিলে একসাথে দিলো ডুব।... এই রে! সবগুলো পঞ্ছি যে ফুরুৎ। কোনদিকে গেলো রে? প্রতিযোগীরা পড়ে গেলো ফাঁপরে। সকলে একইসঙ্গে থমকে গেলো। তারপর যে যার পায়ের কাছাকাছি হাছাপাছা শুরু করে দিলো। তারা বুঝলো, জলের উপর হাঁস ধরা ডাঙার মতো সহজ নয়। ইতিমধ্যে হাঁসগুলি তাদের টপকে গিয়ে খানিক দূরে গিয়ে ভুস্ কর ভেসে উঠলো। চারখানা একদম চারদিকে। আবার সকল প্রতিযোগী পাড়ের দিকে মুখ করে উল্টো সাঁতার শুরু করলো। হাঁসগুলো ভালোই ঠকিয়েছে তাদের। পুকুরে ঢিল ফেললে ঢেউ যেমন গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে তেমনিভাবে প্রতিযোগীরা পাড়ের দিকে ছড়িয়ে পড়লো। পাড়ের দিকে কেউ না থাকায় হাঁসেদের পালাতে সুবিধা হলো। কিন্তু পাড় ছাড়িয়ে ডাঙায় উঠে পালাতে পারলো না। পাড়ে দাঁড়ানো দর্শকরা তাদের হৈহৈ করে তাড়িয়ে আবার পুকুরের দিকে পাঠিয়ে দিলো। এক মায়ের অতিরিক্ত আনন্দের আতিশয্যে বছর তিনেকের এক বাচ্চা ছেলে পড়ে গেলো জলে। চোখের সামনে হঠাতই এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে সেই মা, "আমার ছাবাল..." কথাটা উচ্চারণ করে বাকিটুকু শেষ না করে সেখানেই জ্ঞান হারালো। পাশে দাঁড়ানো অন‍্য একটি মেয়ে মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলো বাচ্চাটি আগে বাঁচানো দরকার। সে দ্রুত পুকুরে নেমে পড়ে আঁকুপাঁকু করতে থাকা বাচ্চটির হাত ধরে ফেললো। বাচ্চা গেলো বেঁচে, শুরু হলো বাচ্চার মায়ের শুশ্রূষা। একটু পরে তারও জ্ঞান ফিরলো। জ্ঞান ফিরেই ছেলেকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরো একবার, "আমার ছাবাল..." বলে বাকিটুকু শেষ না করে অজ্ঞান হয়ে গেলো।


       খেলা চালু আছে। এখানে ঘটনাস্থলে একটা জটলা তৈরি হলো। লোকজন অন‍্য জায়গা থেকে সরে এসে ঐ জায়গায় জড়ো হওয়ায়, তার পাশে খানিকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে গেলো। হাঁসেরা অন‍্যান‍্য পাখিদের মতো চটপটে না হলেও কিছু বুদ্ধি নিশ্চয়ই আছে। সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে একটি হাঁস তাড়াতাড়ি ডাঙায় উঠে পড়লো। তারপর দিলো দৌড়। এক প্রতিযোগী তার পিছু ধাওয়া করে ডাঙায় সেটি ধরার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। সেটি ততক্ষণে পাশের একটি ছোট পুকুরে দিয়েছে এক লাফ। বড় পুকুরে রইলো এখন তিনটি হাঁস। যখনই কোনো হাঁস কারো হাতের নাগালের মধ্যে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়, দর্শকরা সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে, "ধর ধর, হয়েছে", "আর একটু জোরে", "ঐ তো রে , ধরে ফ‍্যাল" ইত্যাদি নানান আশা ব‍্যক্ত করে। নাগালের মধ্যে এসেও কোনোমতে সফলতা আসে না, প‍্যাঁক প‍্যাঁক করে ডাক ছেড়ে ডানা ঝাপটা দিয়ে ফাঁকা কোনো জায়গায় তারা কেটে পড়ে। এভাবে গোটা আসর আরো জমে যায়, দর্শকদের উদ্দীপনা তুঙ্গে ওঠে। হাঁসগুলি ধুরন্ধর প্রতিযোগীর সাথেও সমানে টক্কর দিয়ে যাচ্ছে। 


       সাঁতরে সাঁতরে জোর করে নামানো বয়স্ক এক প্রতিযোগীর দম ফুরিয়ে এলো। সে পাড়ের কাছে পৌঁছানোর জন্য আঁকুপাঁকু করতে লাগলো। তার তখন 'ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি' অবস্থা। এটা দেখতে পেয়ে এক পর্যবেক্ষক অন্য একজনকে বললো, "এ্যাই সদু, নেমে গিয়ে ঐ দাদুকে তুলে আন্। দাদুর দ্বারা আর হবে না, ওনার কাদুমাদু অবস্থা।" গোল কদুর মতো চেহারার একজন কালবিলম্ব না করে দাদুর উদ্ধারে তখনই নেমে পড়লো।


       কোনও হাঁসের নাগাল না পেয়ে ছেলেরা ভীষণ মরিয়া চেষ্টায় লেগে গেলো। পুকুরে তখন রীতিমতো হুলস্থুল অবস্থা। পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকদের মধ্যে একজন মন্তব্য করলো, "সাঈদ কাকার পুকুরের মাছ আজ ডাঙায় উঠে যাবে দেখিস্। হাঁস আর ধরা পড়ছে কোথায়, পুকুরের কাদা সব চটকে যাচ্ছে।" তার পাশে দাঁড়ানো আরেকজন বললো, "যা বলেছো, কাকার উচিত ছিলো এদের হাতে পুকুর ছাড়ার আগে মাছগুলো বিক্রি করে দেওয়া।" অন্যদিকে দেখা গেলো এক প্রতিযোগী গফুর সেখের সাথে আরেক প্রতিযোগী বাপির মুখোমুখি ধাক্কা লেগে গেলো। ব‍্যাপারটা ঘটলো এইভাবে ― দু'জনেই জোরেশোরে আসছিলো একই হাঁসের দিকে হাত বাড়িয়ে। যখন তারা খুব কাছাকাছি এসে গেছে এমন সময় চালাক সেই হাঁসটি দিলো আরেক ডুব, তারপর পগার পার। গফুরের নাকে আঘাত লেগে সে চোখে সর্ষে ফুল ফুটতে দেখলো। বাপির লাগলো কপালের মাঝখানে। সেখানে এখন রি রি করছে। তার মনে হলো একটু পরেই হয়তো ছোট একখানা আলু গজিয়ে উঠতে পারে। গফুরের অবস্থা বেশি কাহিল দেখে সে নিজে তাকে পুকুরের ধারে টেনে নিয়ে গেলো। তারপর প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে দু'জনকে ধরাধরি করে তুলে নেওয়া হলো।


       এতসব কাণ্ড দেখে সবচেয়ে আনন্দ পাচ্ছিলো ছোট বাচ্চারা। তারা চেঁচাচ্ছে আর হাসাহাসি করছে প্রাণখুলে। ঘাটের কাছে যেখানে বেশি জটলা হচ্ছে সেখানে বছর তিনেকের এক শিশু তার মায়ের কাছে জানতে চাইলো, "মা, ওরা হাঁস নিয়ে কাড়াকাড়ি করে কেনো?" একথায় কান না দিয়ে শিশুটির মা খেলা দেখায় মত্ত থেকে যায়। বাড়ির মেয়েদের কাছে দিনটা আজ বাড়তি মজা নিয়ে এসেছে। তারা তাই খেলার পুরোপুরি আনন্দ নিতে চায়। বাচ্চাটির প্রশ্ন তাকে মোটেও বিচলিত করেনা। কিন্তু শিশুটি অতি কৌতূহলী মনে হলো। সে আবার জিগ্যেস করে, "মা, এই হাঁস কোথায় ডিম দেয়? পুকুরে?" এবার তার মা তার প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেয়, "পুকুরে কেন, তুই আমাদের খোঁড় দেখিসনি, ওখানে ডিম দেয়।"

"পুকুরে ওরা হাঁস তাড়াচ্ছে কেনো?"

"আরে না, ওরা ডিম নেওয়ার জন্য তাড়াচ্ছে না। ওটা একটা খেলা। হাঁসধরা খেলা।"


"ওরা খেলছে? মা, আমি হাঁস নিয়ে খেলা করবো!" তার মা একথার কি আর জবাব দেবে, শুধু বলে, "ঠিক আছে হাঁস নিয়ে খেলা করিস্, এখন চুপ কর।"


       পুকুরে এখন রয়েছে তিনখানা হাঁস। কোনো এক বাচ্চা, মার্বেল গুলি খেলে যার হাতের টিপ নিখুঁত হয়ে গেছে, পুকুরে একখানা ঢিল ছুড়লো। ধারের দিকে আসতে থাকা একটি হাঁসকে লক্ষ্য করে তার এই ঢিল ছোড়া। অব‍্যর্থ লক্ষ‍্যভেদ। সেখানে তিনবার পাল্টি খেয়ে সেটি তখন নেতিয়ে পড়লো। এক প্রতিযোগী সেদিকেই আসছিলো। তাড়াতাড়ি হাঁসটিকে তুলে নিয়ে ঠোঁঠদুটো ফাঁক করে অনবরত ফুঁ দিতে লাগলো। মুখের মধ্যে একটু জলও দিলো। তারপর ওটাকে নিয়ে এলো কিনারায়। সেখানে সকলে মিলে শুশ্রূষা করার পর একটু ধাতস্থ হলে আয়োজকরা সেটাকে তুলে নিলো। যে বাচ্চাটি ঢিলখানা ছুড়েছিলো সে সুযোগ বুঝে চোঁ-চাঁ দৌড়। যে গতিবেগে সে দৌড়েছিলো, কোথায় গিয়ে যে থেমেছিলো তা জানা যায়নি। তবে ঢিল ছোড়ার কারণটা জানা গেলো অন‍্যভাবে। তার সঙ্গী যে বাচ্চা ওর পাশে দাঁড়িয়েছিলো সে-ই বলেছে। যখন ঝাঁপাঝাঁপি করেও কেউ কোনো হাঁস ধরতে পারছে না, সবাই নাটাপাটা হয়ে চলেছে, এটা ঐ বাচ্চার কেন জানি পছন্দ হয়নি, তাই রাগের বশে এমন কাণ্ড সে ঘটিয়েছে। শিশুমন, কি আর বলা যাবে! তবে এমন মনস্তত্ত্বে সমূহ চিন্তার কারণ আছে, সন্দেহ নেই।


       অপর একটি হাঁসের ক্ষেত্রে যা ঘটলো তা কষ্টদায়ক ও অদ্ভুত। এক্ষেত্রেও দু'জন প্রতিযোগী একইসঙ্গে দু'পাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। বেচারি হাঁস, এক্ষেত্রে প্রাণ রক্ষা করতে পারলেও সম্মান রক্ষা করতে পারলো না। দু'জনই তাকে ধরে ফেললো। কিন্তু কোথায় কি। তাকে নিয়ে টানাটানি করা বৃথা গেলো। শেষমেশ দেখা গেলো, একজনের হাতে এক খাবলা ডানা ছেঁড়া পালক। আরেকজনের হাতে লেজ থেকে উপড়ানো একমুঠো পালক। এই পালক নিয়ে তারা দু'জন, কাছাকাছি থাকা এক পর্যবেক্ষকের কাছে গিয়ে বললো, "এই যে ধরেছি, এই পালকগুলো দেখো।" সেই পর্যবেক্ষক তাদের নির্বুদ্ধিতায় অবাক হয়ে তিরস্কার করে তাদের দু'জনকে বাতিল করে দিলো। এতো পরিশ্রমের ফল যখন মিললো না তখন তাদেরও পুণরায় পুকুরে নামার সমস্ত উৎসাহ নিভে গেলো।


       এদিকে সেই হাঁসটি এই আচমকা নিগ্রহের ঘটনায় ব‍্যথা পেয়ে ডানা ঝাপটিয়ে তুলকালাম জুড়ে দিলো। বোঝা যাচ্ছে সে বড়ই খুন্ন হয়েছে। এ অপমান সে মেনে নিতে পারছে না। তাদের সমাজে ডানা-খসা, লেজ-খসা এই অবস্থায় গেলে কেউ তাকে পাত্তা দেবে কিনা এতে তার ঘোর সন্দেহ হচ্ছে। তার এই করুন পরিণতি দেখে আয়োজকরা মাছধরার গৃহস্থ জাল ফেলে তাকে উঠিয়ে নিলো।


       পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিলো পাশের গ্রামের এক সমাজকর্মী সামাদ হোসেন। সে স্থানীয় 'প্রাণীক্লেশ নিরাময় সমিতি'র গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো তারই গ্রামের অসিত। সে তার পরিচিত অসিতকে বললো, "যা সব চোখে দেখছি আজকাল তা সমাজের পক্ষে বড় মঙ্গলজনক নয়, বুঝলে অসিত। এভাবে নিতান্ত নিরীহ প্রাণীদের হেনস্থা করার যুক্তি খুঁজে পাইনা। এখন দেখো, ঐ হাঁসটি যেভাবে ভীত হয়ে পড়েছিলো এবং সাহায্যের জন্য আবেদন করছিলো তা বোঝার মতো ঘিলু এদের যদি থাকতো!" এটা শুনে অসিত কিছু মন্তব্য করলো না, শুধু "হুঁ" বলে চুপ করে রইলো। সামাদের মনে হলো অসিত তার কথার মর্ম ঠিকমতো উপলব্ধি করেনি বা উপেক্ষা করেছে। তাই অসিতের মনোযোগ আকর্ষণ করে পুণরায় বললো, "আমি মনে করি মানুষ যেমন স্বাধীন থাকে তেমন অন‍্য প্রাণীদের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা দরকার। মানুষ কেন খামোখা তাদের আটকে রাখবে?" অসিত মনে মনে ভাবলো, সামাদের অনুভূতি বড্ড সুক্ষ্ম। তার নিজের এইক্ষেত্রে চুপ থাকলেই ভালো ছিলো, তবু পাড়া-প্রতিবেশী হিসেবে বললো, "দেখো সামাদ, হাঁস মুরগী ছাগল গরু তো বাড়িতে পোষার জন্য। এদের ছেড়ে রাখলে তারা থাকবে কোথায়! শিয়াল কুকুর নেকড়ে এদের খেয়ে শেষ করে ফেলবে।"


সামাদ বলে, "ঠিক আছে, না হয় আমরাই তাদের রাখবো তবে আরো বড় জায়গায় রাখতে হবে।"

অসিত বলে, "ছোট জায়গা যখন তাদের অভ‍্যাস হয়ে গেছে, তখন আর বড় জায়গার প্রয়োজন কেন। তারা নিজেরা তো আর দাবী করছে না, তাই না!"

"মানুষ কি নিষ্ঠুর দেখো! এদেরকে পুষছে আবার পরে তাকেই খেয়ে ফেলছে।" সামাদ বললো।


"শোনো সামাদ, একটা বিষয় বোধহয় ভেবে দেখার আছে। এরা যদি মানুষের কাজে না আসে তবে শুধু শুধু তাদের পুষবে কেন? এভাবে তো এরা বিলুপ্ত হয়ে যাবে একদিন। হাঁস মুরগী ছাগল গরু কুকুর প্রভৃতি যাই বলো না কেন। আমরা তো জ‍্যান্ত শাকসবজি খাচ্ছি, মাছ খাচ্ছি, ডিম সেটাও তো একটি প্রাণীশিশুর পূর্ব অবস্থা। খাওয়ার কাজটি কি আমরা নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে করি নাকি, এটা তো প্রয়োজন। তাহলে তুমি এক কাজ করতে পারো, এবার থেকে এমন জিনিস খাওয়া শুরু করে দাও যেটার আগে কখনো প্রাণ ছিলো না। হাঁটাচলার সময় আমরা কত ছোট ছোট প্রাণী মেরে ফেলি, সুতরাং প্রাণের বড় কি আর ছোট কি!" সবকথা শুনে সামাদ বলে, "তুমি আমার চোখ খুলে দিলে, অসিত। বলছ যখন, ভেবে দেখবো।"


       সাকুল্যে ঘণ্টাখানেক ধরে পুকুরের পাঁক ঘুলিয়ে যখন দইয়ের মতো হলো, তখন সবাই একযোগে পাড়া কাঁপিয়ে হৈচৈ করে উঠলো, একজন প্রতিযোগী নাকি অবশেষে লড়াইয়ের শেষ দেখেছে। সে এটা করেছে এক অভিনব কায়দায়। পরনের লুঙ্গির কাছা খুলে নিয়ে একটা হাঁসকে সে চাপা দিয়ে ধরতে পেরেছে। হাঁসধরার ইতিহাসে অথবা বাজারে প্রচলিত অভিধানের কোথাও লেখা নেই যে লুঙ্গি চাপা দিয়ে হাঁস ধরা যাবে না। অতএব আইনের সাহায্য নিয়েই সে জয়ী হলো। সে-ই প্রথম স্থানাধিকারী। গোল বাঁধলো চতুর্থ হাঁসটি নিয়ে। সেটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভবত কোনো প্রতিযোগী তাকে এক ফাঁকতালে নিয়ে চম্পট দিয়েছে। প্রতিযোগী হয়তো ভেবেছিলো প্রাইজ নেওয়ার থেকে সরাসরি হাঁসটি নেওয়া তার জন্য লাভজনক। এতো লোকজনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে, যে কাজটি সে করেছে তা এককথায় অনবদ্য। তবে যদি কোনোদিন বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায় তাহলে তাকে সারাজীবন 'হাঁসা-চোর' উপাধি গলায় ঝুলিয়ে কাটাতে হবে, এতে সংশয় নেই।


       সন্ধ্যায় যখন সকল খেলার প্রতিযোগীদের পুরস্কার বিতরণ করা হলো, সবশেষে ঘোষণা করা হলো হাঁস ধ‍রায় বিজয়ীর নাম। এ খেলায় সে-ই একমাত্র বিজয়ী। অতএব, তার পুরস্কারকে স্মরণীয় করার জন্য অভিনব কিছু ভাবা হয়েছে, বোঝা গেলো। এলাকার রাজনৈতিক এক সভাপতির হাত দিয়ে তাকে দেওয়া হলো তার ধরা সেই হাঁসটি এবং সংগ্রহ করে আনা হাঁসের এক ডজন টাটকা ডিম। পুরস্কার নেওয়ার সময় হাঁসটি জোরে নড়াচড়া করে উঠলো আর তাতে ঘটলো এক বিপত্তি। ডিমগুলো রাখা ছিলো বাজার-চলতি একটি পলিথিন প‍্যাকেটে। সেখান থেকে একটি ডিম টপকে গিয়ে চেয়ারে উপবিষ্ট বর্তমান অনুষ্ঠানের সভাপতির কাঁধে ওপর পড়ে ভেঙে গেলো। তিনি সহ উপস্থিত বিশিষ্ট ব‍্যক্তিরা পড়ে গেলেন বিষম লজ্জায়। অবশ্য অনুষ্ঠানের আয়োজকদের বিশেষ সৌভাগ্য যে, উপস্থিত সভাস্থলের মধ্যে হাঁসটির নিজস্ব অন্য একপ্রকার অঘটন ঘটানোর যে যোগ‍্যতা ছিলো সেটি সে প্রয়োগ করে দেখেনি। এটা হয়তো আয়োজকদের প্রতি তার করুণা।


       পরদিন সকালে অনেকে দেখলো সেই পুকুরে আস্ত বড় কয়েকটি মাছ ভেসে উঠেছে আরও কিছু মাছ শ্বাস নেওয়ার জন্য লড়াই করছে, অনবরত খাবি খেয়ে চলেছে। ফলে সাঈদ সাহেবের ভালোরকম আর্থিক ক্ষতি হলো। তিনি ভদ্রলোক বলে প্রকাশ‍্যে কিছু বললেন না। তবে এটা জানিয়ে দিতে ভুললেন না, পরের বছর থেকে তিনি আর চ‍্যাংড়াদের হাতে পুকুর ছাড়তে চান না।


               || খেল খতম ||

      



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy