জীবনযাত্রা
জীবনযাত্রা




ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বিশালাকার মেল ট্রেনটা এসে দাঁড়ালো মধ্যপ্রদেশের একটা ছোট্ট, অখ্যাত স্টেশনে। মাত্র দু'মিনিট দাঁড়াবে এখানে। তারপর কালো ধোঁয়া ছেড়ে আবার বেরিয়ে যাবে। ট্রেন থেকে ঢাউস ট্রাভেল কিটটা কাঁধে নিয়ে নামলো সুদর্শন এক যুবক। পেশায় অ্যাডভেন্চারিস্ট। ন্যাশানাল জিওগ্রাফিকের সঙ্গে পাক্কা আট বছরের চুক্তি। এখানে এসেছে কাছ থেকে কান্হা রিজার্ভ ফরেস্টের বন্যজীবন ক্যামেরাবন্দী করতে। এমনিতে ভারতে কমই আসা হয়। ঠান্ডার দেশগুলোতেই বছরের অধিকাংশ সময় কাটে।
জন্মসূত্রে নাম হীরেন দত্ত। কিন্তু পেশার জগতে হ্যারি বলেই পরিচিত। হ্যারি ডাট। কাঁধের ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে স্টেশনের একমাত্র চায়ের দোকানটায় এসে ঢুকলো হীরেন। মানিব্যাগ খুলে ডলারের নোটগুলো সরিয়ে দু'টো কুড়ি টাকার নোট টেনে বার করলো। ভারতীয় কুড়ি টাকা।
- এক কাপ চায়ে, বড়া সাইজ কা। অউর সাথ মে স্ন্যাক্স কুছ...
দোকানদার অভ্যস্ত। অবলীলাক্রমে পাঁচ টাকার চা আর দশ টাকার কেক দিয়ে চল্লিশ টাকা নিয়ে নিলো। বললো, "কান্হা যানা হ্যায় সাব ?"
- হাঁ, জিপ মিলেগা কোই, ইয়াহাঁসে ? ... দো হপ্তে কে লিয়ে।
ওদের পরবর্তী কথোপকথন আমাদের চেনা। কিছু মানুষ আছে যারা ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে, কিছু মানুষ আছে যাদের ঘুরেই বেড়াতে হয়। হীরেন দত্তের মধ্যে দু'টো দিকই আছে হয়তো। সেই যে জীবনের ছক পাল্টে গেলো কোনো এক প্রাক-যৌবনে, তারপর থেকে থিতু হওয়াই আর হলো না।
চায়ের দোকানদার ছেলেটি নেপালি। সে তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দীতে জিজ্ঞাসা করছিলো, "সাব, এই যে আজ ইয়াহাঁ কাল ওয়াহাঁ, শুধু ঘুরে ঘুরে কাটানো, আচ্ছা লাগতা হ্যায় ?"
হালকা-নীল রোদচশমাটা চড়িয়ে হ্যারি উত্তর দিলো, এটাই তো জীবন। পৃথিবী ঘুরছে, আর তার সঙ্গে ঘুরছি আমরা সবাই। জীবনটাই একটা চলা, একটা যাত্রা। বুঝলে, লাইফ ইজ আ জার্নি।"
****************************************
বিশাল ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। তালবুড়ির মাঠে এমনিতে বিশাল মেলা বসলেও ভিড় বোঝা যায় না, এত বড়ো আয়তন মাঠের। কিন্তু সেখানেও যেন স্থান সংকুলান আর হচ্ছে না। এতো জমকালো স্টেজে এতো বিশাল স্টারকাস্ট আশেপাশের গ্রাম তো দূর, গোটা মেদিনীপুরেই কোথাও কেউ দেখেনি আগে। মাঠে সন্ধ্যে থেকেই ভিড়ে ভিড়াক্কার। বম্বের দু'জন আর্টিস্ট, সঙ্গে বাংলার চলচ্চিত্রের উজ্জ্বলতম তারকা পরমা - আর তার সঙ্গে পালাকার হলেন স্বয়ং আই-টিভির জনপ্রিয় এক সিরিয়ালের পরিচালক। আই-টিভি এখানে আসে না, কিন্তু খবর ঠিকই ছড়িয়ে পড়ে, বা ছড়ানো হয়।
পালার নাম, বেঁটে স্বামীর অজুহাতে - বউ পালালো বাসররাতে। দমফাটা হাসির তুফানী তরজায় সমাজের অবক্ষয়ের এক অকল্পনীয় সত্য দলিল। অন্তত বিজ্ঞাপন তো তা-ই বলছে। আর টিকিট বিক্রির হারই বলে দিচ্ছে যে পাবলিক খুব খাচ্ছে।
ভিতরে বসে বম্বের একসময়ের ডাকসাইটে অভিনেতা শাওন কুমার একটা ছোট্ট সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন।
- না, না, কে বললো হিন্দী সিনেমায় রোলের অভাব ? আমি যাত্রায় এলাম প্রত্যন্ত অঞ্চলের অগুনতি মানুষের ভালোবাসাকে দাম দিতে। গ্রামবাংলার মানুষের আরো কাছে পৌঁছাতেই আমার অশ্বিনী যাত্রাদলের সঙ্গে গাঁটবন্ধন।
বাংলার চিত্রাভিনেত্রী পরমার মুখেও সেই একই কথার আবর্তন। "আমি শাওনদার সঙ্গে একমত। দেখুন, চলচ্চিত্রের চেয়ে যাত্রায় মানুষের কাছে আসার সুযোগ অনেকটাই বেশী। বাংলার যাত্রার মধ্যে, ইউ নো - প্রাণের ছোঁয়া পাওয়া যায়। আর এই টানটা তো আমার রক্তে ছিলোই।"
বাইরে তখন মাইকে জোর ঘোষণা চলছে - বম্বের মিস্ মোনালিসা গুরুতর অসুস্থতার কারণে আজকের পালায় যোগদান করতে পারছেন না। তার বদলে পালার শুরুতে ও মাঝখানে দুটি বিশেষ নাচের বন্দোবস্ত করা হয়েছে... মিস পায়েল... ও মিস খুশবু... আর এক ঘন্টার মধ্যেই শুরু হতে চলেছে সারা রাত্রিব্যাপী যাত্রাপালা...
অশ্বিনী যাত্রাদলের কর্ণধার ও দুঁদে ব্যবসাদার অশ্বিনী মালাকার তখনও মোবাইলে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মিস্ মোনালিসার সঙ্গে। আসা-যাওয়ার খরচ এবং চুক্তির টাকা ছাড়াও ফ্রীতে নর্থ বেঙ্গল ভিজিট দেওয়া হবে। চুক্তির টাকাও বাড়ানো যেতে পারে কিছুটা। মোনালিসা অবশ্য অন্য অফারের অজুহাতে একদম নিরুত্তাপ। দর আরেকটু বাড়ুক। হিসাব খুব পরিষ্কার। গত মরশুমেও পাঁচ লাখে শো করেছে সে। এবছর দু'দুটো হিট ফিল্ম বাজারে এসেছে তার। এখনো পাঁচেতেই স্টেজে উঠে গেলে মান-সম্মান আর থাকবে ? উঠুক, দর উঠুক আরেকটু।
পাঠক কি বলেন - সবই নাটক! তাই তো ? তবে সুধীজন, পরমার হেয়ার ড্রেসারের কথাটা কিন্তু এখানে প্রণিধানযোগ্য - জীবনটাই তো একটা অভিনয়, একটা যাত্রা। সবই সাজানো। লাইফ ইজ আ প্লে।
****************************************
অরুনাংশু খবরের কাগজ ছেড়ে বাজারের থলিটা নিয়ে বেরোলো। আজ রোববার, তাড়াতাড়ি না গেলে বাজারে ভিড় হয়ে যাবে। হাঁটতে হাঁটতে পুরোনো দিনের কিছু কথা মনে পড়ছিলো অরুনাংশুর। খুব বেশী দিন আগে নয়, এই তো বছর কুড়ি আগে হবে। রবিবার মানে তখন ছিলো অন্যরকম। তখন রবিবার মানে মহাভারতের দিন। সকালবেলা নমো নমো করে পড়া সেরেই টুটুনদের বাড়ি - মহাভারত শুরু হবে। মহাভারত শেষ হলে হয় ক্যারাম, নয়তো গলিতে ক্যাম্বিসের বলে ক্রিকেট। জীবনের কতটা পথ পার হয়ে এসেছে। অরুনাংশু এখন বাবা। পুরো সংসারের দায়িত্ব এখন তার উপর। বাজার করে বাড়িতে ফিরেই রঙের মিস্ত্রির খোঁজে বেরোতে হবে। ক্যাম্বিসের বলের প্রতি কোনো আকর্ষণই নেই আর।
অরুনাংশুর স্ত্রী, মল্লিকা সেন - ঘরের কাজে ব্যস্ত। মল্লিকা সেন আর অরুনাংশু ঘোষ একসঙ্গে সপ্তাহে এই একটা দিনই বাড়িতে থাকে। এই দিনটা অরুনাংশুর ছুটি। কিন্তু মল্লিকার কোনো ছুটি নেই। সারা সপ্তাহের কাজ এই একদিনে। বাড়িঘরদোর গোছানো, রেসিপি দেখে রান্না প্র্যাকটিস, প্রিয়জনদের সঙ্গে ফোনটোন করে রিলেশনশিপ ঠিক রাখা। বাড়ির গৃহিণীদের আবার ছুটি কই ? সারা সপ্তাহ অফিসের কাজ সামলাও, তারপর সপ্তাহের শেষে একটা দিন বাড়িতে থাকলে, তখনও সেই ঘরের কাজ সামলাও। আজ তো আবার হীরেনের ফোন আসবে। দুপুরবেলা। যখন অরুনাংশু বড়ো ঘরে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোবে আর মল্লিকা ড্রয়িংরুমে বসে কিছু একটা বোরিং সিরিয়াল দেখবে। সেই সময় ফোনটা আসবে।
অরুনাংশু জানে না হীরেনের কথা। বলবো-বলবো করেও মল্লিকা আর বলে উঠতে পারেনি। আসলে বলার মতো কিছু নেইও। কিশোরীবেলার স্মৃতি, আজ শুধুই স্মৃতি। হীরেন বাইরে বাইরে ঘোরে, সপ্তাহে একবার শুধু ফোন করে। সাধারণ কথাবার্তাই হয়, কী খবর - কেমন আছো, নতুন জায়গার ছবি পাঠিয়েছি দেখো-। এতো দেশ ঘুরেও মল্লিকাকে ভুলে যেতে পারেনি হীরেন। মল্লিকাও কি পেরেছে ? রবিবার এই ফোনটার জন্য তারও ভিতরে ভিতরে সারা সপ্তাহ একটা অপেক্ষা কি থাকে না ?
****************************************
রঙের মিস্ত্রি ঠিক করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাড়ে এগারোটা বেজে গেলো অরুনাংশুর। ছুটির দিন বাড়িতে না থেকে আড্ডা মারতে বেরোলে মল্লিকা আবার ঝামেলা করে। বড়োই অবুঝ। কিন্তু রাগ হলেও রাগ করতে পারে না অরুনাংশু। তার প্রতি আনুগত্য বা ভালোবাসা থেকেই যে মল্লিকা এটা করে, অরুনাংশু সেটা বোঝে। সপ্তাহে একটা দিন একসঙ্গে কাটাতে চায় আরকি। ভালোমন্দ রান্না হয় এইদিন। মল্লিকা নিজে হাতে রান্না করে তাদের জন্য। কিন্তু অরুনাংশু মুখে ফুটে এটা বলে বোঝাতে পারে না যে সংসার ছাড়াও একজন ছেলের জীবনে আরো কিছু থাকে। পাড়ার ক্লাবেই তিনমাস হয়ে গেলো যাওয়া হয়ে ওঠেনি। রবিবার সকালটা তো এটা সেটা কাজ নিয়েই কাটে। সন্ধ্যেবেলা হয় শপিং নয়তো কোনো সিনেমা। নিজের জন্য কোনো সময়ই নেই জীবনে। ছেলেটাকে মিশনে দিয়ে একটা ঝামেলা অবশ্য কমেছে।
অরুনাংশু স্নান করে যখন ড্রয়িংরুমে ঢুকলো, মল্লিকা মাছের একটা আইটেম বানাতে বানাতে ননদের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলো। ননদ ওর বরের সাথে এখন ছুটিতে উটি গেছে। মল্লিকা শুনছিলো আর ভাবছিলো নিজের কথা। ব্যাংকের চাকরিতে কোনো ছুটি নেই, পারলে রোববারও কাজ করতে বলে। টাকা দেয় ভালোই, অন্তত অরুনাংশুর প্রোফেসারির চেয়ে কম কিছু নয় - কিন্তু যত আপত্তি ওই ছুটিতে। একসঙ্গে দু'জনে কোথাও ঘুরতে যাবে প্ল্যান করেও সব প্ল্যান ভেস্তে গেছে কতবার।
অরুনাংশু একটা সিডি চালালো নতুন কেনা 4K টেলিভিশন সেটটাতে। লাইব্রেরি রুমে থাক থাক বইয়ের পাশে অনেক সিডি রাখা আছে। এগুলো তার পছন্দের কালেকশান। এমনি বিভিন্ন সিনেমা ছাড়াও তাতে আছে বাছাই করা নৃত্যনাট্যের কিছু সিডি। মল্লিকা ঠিক জানে না, এইসব সিডিগুলো কেনার ব্যাপারে একটা বিশেষত্ব আছে। বাংলা চলচ্চিত্রে এখন একটা চেনা মুখ পরমা ঘোষদস্তিদার। অরুনাংশুর কলেজের একই ইয়ারের ছাত্রী। অরুনাংশুর সংগ্রহে তারই সমস্ত সিনেমা এবং নৃত্যনাট্যের সিডি। তারে - ভোলানো গেলো না যে কিছুতেই!
পরমার কোনো দোষ ছিলো না। অরুনাংশই সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছিলো একদিন এক ভুল বোঝাবুঝিতে। এখন ভাবলে হয়তো নিজের ভুল তার চোখে পড়ে। আফসোস হয়। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে। মাঝে বিস্তর সমুদ্র এখন। আকাশ-পাতাল পার্থক্য যেন। অরুনাংশুর তো আর জানার কথা নয় যে পরমাও ভুলতে পারেনি কিছুই।
প্রায় সাড়ে চারশো কিলোমিটার দূরে, এই জনক-জননীর একমাত্র সন্তান, গাছপালায় ঘেরা শান্ত পরিবেশে শিখছে জীবনের প্রথম পাঠ। এই জীবনে সে আসবে, তবে দেরী আছে। যাত্রা তো সবে শুরু। সে হাসবে, কাঁদবে, উঠবে, পড়বে, শিখবে - অথবা হয়তো কিছুই শিখবে না। বড়ো হবে, যোগ দেবে জীবনে। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। সে এক অনন্ত যাত্রা। জীবনযাত্রা। চলার পথেই নাটক। নাটক নিয়েই চলা। এটাই জীবন। একে যাপন করতে হয়।
~ সমাপ্ত