জীবনযাপন ( পর্ব - উনবিংশ)
জীবনযাপন ( পর্ব - উনবিংশ)
দীপু যখন বাড়িতে এসে পৌঁছায়, তখন সুজিত সংজ্ঞাহীন অবস্থায় রয়েছে। ওকে কোনো মতে বারান্দায় এনে শুইয়েছে কাজের লোকেদের বলে কয়ে সুমতি। নয়নরা সুজিতের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে কাঁদো কাঁদো মুখে।
" কি রে দীপু ডাক্তার কই? আর বাবাদের দেখতে পেয়েছিস?"
জিজ্ঞেস করল সুমতি।
" মা বাবারা ডাক্তার নিয়ে এক্ষুনি আসছে। চিন্তা করো না।"
সুজিতের চোখে মুখে জল দেওয়া হলেও জ্ঞান ফেরেনি,কারণ গায়ে বেশ জ্বর।
মিনিট পাঁচেকেরমধ্যে অজিত বাড়িতে প্রবেশ করলো, সাথে হাসপাতালের ডাক্তার, যিনি সুজিতকে আগে দেখেছিলেন। সুজিতকে সবাই মিলে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেওয়া হলো। ডাক্তার জ্বর পরীক্ষা করে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে বেশ সাবধানে রাখতে বলে বেড়িয়ে গেলেন।
অয়নরা তিন ভাইবোনে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে অজিত তাদের কাছে এসে মাথায় হাত দিয়ে আদর করতেই এতোক্ষণ পরে নয়ন জেঠানকে জড়িয়ে কেঁদে উঠল। তিনি বুঝতে পারলেন অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে রেখেছিল। আর পারলো না, যতই ছোট হোক তবে অবুঝ না ওরা।
" মা কাঁদে না?"
নয়ন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল "জেঠান বাবা কথা বলছে না কেন?"
তপন ডাক্তার বাবুকে ছাড়তে গিয়েছিল, সে নয়নের শেষ কথাটা শুনে কাছে এসে বললো " বোকা মেয়ে মানুষ ঘুমোলে কি কথা বলতে পারে? "
" বাবা ঘুমিয়ে আছে?" জিজ্ঞেস করল চয়ন।
" তাছাড়া কি?"
সবার চেয়ে অয়ন বড় সে যে কথাগুলো বিশ্বাস করেনি সেটা তার কথায় বোঝা গেল।
" তাহলে ডাক্তারবাবু এসেছিল কেন? ইনজাকশান দিলো কেন? তোমরা আমাদের সত্যি বলছনা আমি জানি।"
তপন নয়নকে কোলে নিয়ে বাকিদের ইশারায় আসতে বলে বাইরের বসার ঘরে নিয়ে এসে বললো " মিথ্যা বলিনি, দেখ তোর বাবার অসুখ করেছে। তাই ডাক্তার এসেছে , আর ডাক্তার এইজন্য ইনজেকশন দিলেন। যাতে তোর বাবা ঘুমিয়ে থাকে। ভেবে দেখ তো কোথায় মিথ্যা বললাম।"
তিন ভাইবোন নিজেদের দিকে চাওয়া চায়ী করে চুপ করে গেল। কি বুঝলো কে জানে, আর কোনো প্রশ্ন করলো না তারা। তপনের গাঁ ঘেঁষে চুপ করে বসে রইলো।তপন এতোদিন ওদের দূর থেকে শুনে অনুভব করেছে ওদের কষ্টগুলো। আর যেন ওদের স্পর্শতে ওদের মনের যন্ত্রণাগুলো ওর মন পর্যন্ত ছুঁয়ে গেল। ওদের অব্যক্ত যন্ত্রণায় কথা হারিয়ে ফেললো সে। ওরা এমন করে নীরবে বসে রইলো যে একটা সুঁই পড়ার শব্দ পর্যন্ত শোনা যাবে। এমন করে কতক্ষণ বসে রয়েছে তা কেউই জানেনা, সময় যেন এই ঘরের বাইরে এসেই থমকে গিয়েছে।
" আরে তোমরা এখানে পিসান? আমি সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি, কতবার এই ঘরের পাশ দিয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি তোমরা রয়েছ।"
তপন তপুর দিকে তাকিয়ে বললো " কেন রে তপু কি হয়েছে? "
তপু বললো "মা তোমাদের ডাকছে যে।"
আর কিছু বলার আগেই যেমন দ্রুত এসেছিল তেমনি করেই চলে গেল সে। তপন ভ্রু কুঞ্চিত করে নয়নকে কোলে তুলে বাকিদের সাথে নিয়ে ভেতরের বাড়িতে এসে ঢুকেই আরও একবার অনুভব করলো প্রতিটি নারীর মধ্যেই একজন মায়ের উপস্থিতি রয়েছে।
" আরে তুমি দাঁড়িয়ে কেন? এসো এদিকে।"
উনার আহ্বানে তপন খাবার ঘরে এসে চোখ কপালে তুলে বলে " এসব কি করেছেন আপনি? এতো কিছু করলেন কখন? "
" কই এতো কিছু, সামান্য তো।"
" একে আপনি সামান্য বলছেন?"
" দেখো তুমি জামাই মানুষ, কই আর তোমাকে জামাই আদর করতে পারছি?"
তপন আর্দ্র গলার বললো " বৌদি আমি কি কেবল জামাই, এটাই পরিচয়, আমি কি এই বাড়ির ছেলে নই।"
" না না, তা কখন বললাম? তুমি এই বাড়ির জামাই হওয়ার আগে থেকেই এই বাড়ির একজন ছিলে। "
" তবে এসব করার কি ছিল? কেন এসব বানাতে গেলেন আজ?"
" না তপন আমি কিছুই বানাইনি, এসব আমার তপুকে দিয়ে সামনের মোদক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে আনিয়েছি। আজ সুজিতকে নিয়ে যা গেল রান্না ঘরে ঢোকার সময় পেলাম কই। লক্ষ্মীটি সামান্য এটুকু খেয়ে নাও।"
তপন এমন স্নেহের ডাক এড়াতে পারলো না। বসে পড়লো।
" তা দাদা আর অপু তপুরা কই?"
"ওরা এসে পড়বে, তপুকে দিয়ে ডাকতে পাঠিয়েছি। তুমি খাও দেখি নিশ্চিন্তমনে। "
এবারে হাত বাড়িয়ে নয়নদের ডেকে বললেন " আয় তোরা খেয়ে নে। "
ওরা মাথা দুলিয়ে না বলাতে কাছে ডেকে বসালেন ওদের সুমতি। তারপর অনেক ভুলিয়ে ভুলিয়ে খাওয়াতে শুরু করলেন। ততক্ষণে অজিতরা চলে এসেছে, এরই ফাঁকে তাদের খাবারগুলো বেড়ে দিয়ে আবার নয়নদের খাওয়াতে শুরু করলেন।
তপনের নিজের অজান্তেই চোখে জল এসে গেল, এই জল কষ্টের নয়, সম্মানের। কেমন করে অন্যের সন্তানকে মাতৃ স্নেহে বুকে টেনে নিতে পারেন একজন নারী। এই ক্ষমতা পুরুষদের নেই, তারা স্ত্রীর মৃত্যুর পরে নিজের সন্তানকে ভুলতে কিছুমাত্র সময় নেয়না। কে বলে নারীরা কুচুটে হয়? সত্যি যদি তারা তাই হতো এই জগতে পুরুষরা কার আশ্রয়তলে বেঁচে থাকতো?
" আরে তপন কিছু খাচ্ছো না যে।"
সুমতির কথায় চমক ভাঙ্গলো। নিজের চোখের জল আড়াল করে বললো " কই খাচ্ছি তো।"
বলে খাবারে মনোনিবেশ করলো সে।
---
"সুজিত, সুজিত "
বাইরের একটা গলা পেয়ে সচকিত হয়ে বিছানায় উঠে বসে অজিত। আজকে খুব পরিশ্রম গিয়েছে। ফোন করে ভেবেছিল হাসপাতালে সব মিটমাট হবে, কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। তাকে হাসপাতালে গিয়ে অঙ্গীকার করে আসতে হয়েছে সুজিতের সব দায়িত্ব তার, সুজিতের কিছু হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবেন না। গাড়িটা সাথে ছিল তাই সুবিধা হয়েছিল, একফাঁকে আরতিকে দেখেও এসেছে সে। উন্নতি এখনো কিছুই হয়নি। যেমনকার তেমনি অবস্থা। তারপর ফিরে সবে খেয়ে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বিছানায় মাথা ঠেঁকিয়েছেন।
বাইরে বেড়িয়ে দেখে আরতির বড় মেসো এসে দাঁড়িয়েছেন সেখানে। অজিত উনাকে দেখে প্রথমে চিনতে না পারলেও মিনিট খানেকের মধ্যে চিনতে পারলেন। আসলে হাতে গুনে কয়েকবার দেখেছে মাত্র।
" আপনি আরতির মেসো মশাই না?"
" হ্যাঁ বাবা ঠিক ধরেছ, তা সুজিতকে ডেকে দাও, আমার কথা আছে ওর সাথে। ওর বাড়ি গিয়ে কাউকে না পেয়ে আশেপাশের তোমার ঠিকানা পেয়ে এসেছি। শুনেছি সে এখানেই রয়েছে। "
" আপনি ভেতরে এসে বসুন।"
"আমি বসতে আসিনি বাবা, ওকে ডেকে দাও আগে।"
অজিত বুঝতে পারলো মানুষটি বেশ ক্ষেপে রয়েছেন।
সুমতি এসে দাঁড়িয়েছিল দরজার কাছে, সে এবারে উত্তর দিলো" মেসোমশাই সুজিত কথা বলার অবস্থায় নেই। শান্ত হয়ে বসেন ঘরে এসে, জল বাতাসা খান, সবটা শুনুন আগে। তারপর না যা সিদ্ধান্ত নেবেন।"
সুমতির গলা শুনে কিছুটা শান্ত হলেন তিনি, ঘরে এসে প্রবেশ করতে করতে বললেন " তা মা তুমি কেমন আছো? "
সুমতি এগিয়ে এসে উনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই অজিতও প্রণাম করলো,
" সুখী হও, দীর্ঘয়ু হোক তোমাদের।"
সুমতি প্রণাম সেরে বললেন " আছি একরকম, ভালো আর কই মেসোমশাই। "
তারপর একটা ছোট শ্বাস ছেড়ে বললেন "কি থেকে যে কি হয়ে গেল।"
তিনি শেষ কথাটা শুনে চুপ করে রইলেন। সুমতি ভেতর বাড়ির দিকে পা বাড়াতে যেতেই একটা কথা কানে এলো সুমতির।
" তা আমার দিদিভাই দাদাভাইরা আছে কোথায়? কতদিন দেখিনি ওদের?"
অজিত বললেন " এখানেই আছে মেসোমশাই, কোথায় আর রাখবো বলেন, ওরা তো আমাদেরও সন্তান। " সে এতোক্ষণ চুপ ছিল। কি সম্বোধন করবে বুঝতে পারছিলনা, স্ত্রী বিষয়টি ঠিক করে দিলো।
" বাবা আমি অনেক পরে খোঁজ পেয়েছি, কি হয়েছিল আমাকে একটু জানাবে? একটু জোরে কথা বলে ফেলেছি। কিছু মনে করোনা বাবা। বয়স হয়েছে তো, আর মেয়েটাকে বড় ভালোবাসি। "
" না না কিছুই মনে করিনি, আপনি আমার বাবার মতো, বলতেই পারেন। তাছাড়া আরতির মতো মেয়েকে কেউ কি ভালো না বেসে পারে মেসোমশাই।"
তারপর ইতস্ততভাবে অজিত বললো "আপনার বাড়িতে তো সুজিত গেছিল, কিছু জানায়নি তখন সে?"
" না কই জানিয়েছেন সে, আমাকে বলো বাবা কি হয়েছে?"
অজিত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো " বিশ্বাস করেন আমি তেমন কিছু জানিনা। এতোটুকু জানি কেউ একজন এসেছিল আরতির পরিচিত, সম্ভবত আরতির মামাবাড়ির কেউ। তারপর কিছু একটা হয়েছিল, তারপর থেকে সে ঘর ছাড়া। খোঁজ অবশ্য পেয়েছি আমরা, তবে মেয়েটার.. " বলে আর বলতে পারলো না অজিত। গলা আর্দ্র হয়ে গেল।
তিনি শুনে চুপ করে রইলেন।" কে এসেছিল?" কেমন একটা সন্দেহ মনের মধ্যে আসছে, আন্দাজটা সত্য হলে বিষয়টি নিয়ে বেশি কিছু না বলাই ভালো। কারণ দোষটা তাদেরও। এবার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে শ্বশুরের শেষ কাজে গিয়ে কানাঘুষোয় কিছু কথা কানে এসেছিল তার। আরতির খোঁজে সুজিতের আশার কথা কানে আসতেই স্ত্রী ভেঙে পড়ে কান্নায়।" তোমাকে বলছিলাম না বেশ কয়েকদিন ধরে মনে হচ্ছে মেয়েটা আমার ভালো নেই। তুমি এখুনি যাও। না না আমিও সাথে যাব।"
তবে অনেক করে শান্ত করে গাড়ি আর বিশ্বস্ত চালককে সাথে নিয়ে এসেছে। ছেলেরা আসতে চাইলেও তিনি রাজি হননি।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে ধরা গলায় বললেন "তা সুজিত কই বাবা?"
সুমতি হাতে খাবার থালা নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন "আর সুজিত মেসোমশাই, আরতি নিখোঁজ হবার পরে থেকে সুজিত কেমন পাগলপারা হয়ে রয়েছে। আপনি হাত ধুয়ে সামান্য কিছু মুখে দিন। আমি সবটা বলছি।"
" না মা এতোকিছু খেতে পারবো না।"
" তা বললে কি হয়? প্রথমবার এলেন। এখন ফলাহার করেন, ভারী কিছু দিলাম না। "
তিনি সুমতির মুখের দিকে স্নেহের চোখে তাকালেন। আর কথা না বাড়িয়ে হাত মুখ ধুয়ে পাত্রখানি হাতে তুলে নিলেন।
" জানো মা আমার খুব কন্যাসন্তানের ইচ্ছে ছিল। আমার আরতি সেই ইচ্ছে পূর্ণ করেছে। "
তারপর একটু দম নিয়ে অস্ফুটে বললেন "সে সবার ইচ্ছে পূর্ণ করে কিন্তু তার জীবন... " বলে আর বলতে পারলেন না।
সুমতি পাশে বসে রইলেন খাবার তদারকি করতে। আর ধীর কন্ঠে এখানকার পরিস্থিতি সবটা ব্যক্ত করতে লাগলেন।
বৃদ্ধমানুষটার চোখের জল কতবার কণায় কণায় পূর্ণ হয়ে অধরকে নোনা করে দিলো তার ইয়াত্তা নেই।
চলবে...
