জীবন যন্ত্রণা পর্ব চার।
জীবন যন্ত্রণা পর্ব চার।
নবীন আবেগ তাড়িত বলে,"নতুন কিছু জীবন দর্শনের বই লিখুন বাবাজী। যা মানুষকে নতুন করে ভাবাবে।পরকালের আগে এ জীবনে নির্ভয়ে আত্মসম্মান আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাথা উচু করে বাঁচার পথ দেখাবে। আপনার কথা আমার খুব ভালো লাগছে। আমার শংকরাচার্য্যের ব্রহ্ম সত্য জগত মিথ্যা, এই বাণী ভীষণ ভাবায়। নির্ভীক সাহসী করে। সত্যের জন্য এ জীবন তুচ্ছ করে লড়তে শেখায়।
ওটা তো বীজ মন্ত্র, এর উপর আর কিছুই হয় না।সব মিথ্যা,আমি তুমি কিছুই নয়।সময় আর শক্তির খেলা। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের রহস্য,বিজ্ঞান যার ব্যাখা করতে এখনও ব্যর্থ।আর সেই কোন যুগে এর ধারনা! আজ থাক পরে এ সব নিয়ে অনেক আলোচনা হবে।তোমার পড়াশোনা কত দুর?
আমি বাবাজী প্লেন বি এস সি, ফিজিক্স ম্যাথ্ আর কেমিস্ট্রি বিষয় ছিল।
তাহলে তুমি কিছু বুঝবে যে,গনিত আর ফিজিক্স এমন দুটো বিষয় ,মহাবিশ্বে তার অজেয় ব্যাপ্তি।এসব বিষয়ে আমাদের জানার আরও অনেক বাকী।
রতন একা বিকালে ঘর মন্দির ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করছিল, নিজের বিবেকে লাগছিল তাই নবীন তাকে সাহায্য করতে গেলে রতন বলল ,
"কাজ না করলে আমার সময় কাটে না। ক্লান্ত না হলে রাতে ঘুম ভালো হবে না। তুমি নতুন অতিথি এখন চুপ চাপ বসে থাকো, আর যদি একদিনেই এই আশ্রমের এক জন ভাবো,নিজের কাজ নিজে খুঁজে নাও।আমার কাজে ভাগ বসিও না।"
নবীন ভাবছিল বিচিত্র মানুষ এই রতন দা।বাবাজী তাদের কথা শুনে হাসছিলেন।নবীনকে ডেকে বললেন
"তুমি কি কাজ চাইছ!"
নবীন লাজুক হেসে বলে, "চুপচাপ বসে থাকতে পারব না বাবাজী।"
"বেশ তো আজ তুমি সকলে ঘুমিয়ে ছিলে, তাই দেখতে পাও নি ,সকাল আটটা থেকে দশটা, এই গ্রামের কিছু ছেলে মেয়েরা এই আশ্রমে পড়তে আসে। আমি পড়াই মন্দির চত্বরে ওরা পরে।বিনা পয়সায় পড়াই।এতে গ্রামের মানুষের কাছে একটা সম্মান ইজ্জত বিশ্বাস ভালোবাসা পাওয়া যায়। তুমি যখন শিক্ষিত,ছেলে মেয়েদের পড়াতে পারবে তো!"
" বাবাজী,আমি একটা সময় প্রাইভেট টিউশনকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলাম,সাত আট বছরের অভিজ্ঞতা আছে ,আমি পড়াব বাবাজী।"
"বেশ কাল থেকেই পড়াবে, আমি পড়াই,আমিও থাকব তবে তুমি সামলাবে। দেখো তোমার মন থেকে এটা ভালো লাগে কি না!"
বিকালে নবীন আশ্রমের চারদিক ঘুরছিল,একাকী তাকে ঘুরতে দেখে, রতন তার সঙ্গ দিয়ে এদিন ওদিক সব দেখাচ্ছিল। নবীন গ্রামে মানুষ।তাদের জমি সম্পত্তি নেই বললেই চলে,তবু চাষ বাসএকটু ধারনা আছে।রতন তো চাষী ঘরের মানুষ। সে ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিল। অন্তত বিঘা তিনেক পুকুর, চার ধারে কত সব সব্জি আর ফলের বাগান, বড় বৃক্ষ নয়,কলা,পেঁপে,কাগজি লেবুর গাছ পুকুরের পশ্চিম উত্তর পাড় জুড়ে নিবিড় সবুজের ঝোঁপ,আর বাকী দক্ষিণ আর পূর্ব পাড়ে লাউ, কুমড়ো, শসা, উচ্ছের মাচা। কি সুন্দর সব ফসল ধরে আছে মাচা থেকে ঝুলে আছে, নানা সাইজ।আবার ভেন্ডি গাছে ফুল ফলে ভরে আছে।জোনার গাছে ভুট্টা ধরেছে।
রতন বলল,এ সব খুব যত্ন করতে হয়,নজর রাখতে হয়।শীতের সময় আবার বেগুন,ফুল কপি বাঁধা কপি, টমেটো, মটোর নানান সব্জি হয়।একপাশে ছোট গোয়াল ঘরে, চারটে দেশী গরু আর বাছুর। শরীর স্বাস্থ্য পুষ্ট চকচকে আর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।
নবীন বলে "এদের সব যত্ন তুমিই করো রতন দা!"
"না একজন মজুর আছে সে নিয়মিত আসে বেতন দি,তবে সে খুব আন্তরিক,গাছে জল সার দেওয়া মাটি খুঁড়ে,গাছের কত যত্ন করে,দুধ দোয়ানো কাজ করে, আবার গোবর গুলে বায়োগ্যাস প্যান্টের ইন লেট চৌবাচ্ছায় ভরে দেয়।প্রতিদিন যত ফসল হয় তুলে নিয়ে যায়।ওর ভাই কে দিয়ে বাজারে বিক্রি করে।"
"বিক্রির টাকায় কী হয়! "
বাবাজী উদার মানুষ বলে টাকার দরকার নেই আশ্রমে তো ধান আলু মুগডাল হয় না।যা আতপ চাল, চিড়ে, আখের গুড় ,আলু, মুগ ডাল বছরে যা লাগে এসব এর বিনিময়ে যোগান দেয়।"
"তোমারা কী এক খাবার দিন দিন খাও!"
"হ্যাঁ ,বাবাজী বলেন সহজ সরল খাও, শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকবে সঙ্গে যোগাসন।"
"রাতেও একই খাবার!"
"না রাতে আতব চালের ভাত আর দুধ, সে দুধ তেমন খাঁটি খীড়ের মত। বিকালে সময় ফল এই বাগানেরই যখন যেমন, আম ,পাকা পেঁপে পেয়ারা কলা জাম সব কিছু গাছ পাকা।অনেক হয়,যে সব ছেলে মেয়েরা সকালে পড়তে আসে তাদের ও দেওয়া হয়।"
"এত দুধ দুজনেই খাও!"
"কেন দই করি ,ছেলে মেয়েদের চিড়ে দই কলা গুড় এসব দিয়ে সকলের টিফিনের ব্যবস্থা থাকে,ওদের এই টিফিন আশ্রমের আয় থেকেই হয়ে যায়।"
নবীন যোগ করে "আবার গরুর গোবরে রান্নার গ্যাস , গাছের জৈব গোবর সার সব হয়ে যায়।"
"হ্যাঁ সবই তো আশ্রমের,বাইরের খরচ বলতে পোষাক পরিচ্ছদ আর রোগ অসুখ, তবে এ অসুখ বিসুখ ওষুধের খরচ আমাদের লাগেই না।বাবাজীর এখনও দুঘন্টা যোগাসন ধ্যান কত কী তিনি করেন। আমিও করি।তুমি করবে।শরীর সুস্থ রাখতে জানো এর কোন বিকল্প নেই। "
অনেক ঘুরে ফিরে ,রতন আশ্রমের ঘরে নিয়ে নবীনকে নিয়ে এল।ফল ধুয়ে পরিস্কার করে কেটে তিনটে পাত্রে সম ভাগ করে নবীনকে একটা আর বাবাজীর ঘরে, উনার বরাদ কাটা ফল একটি পাত্রে দিয়ে এল।নবীন দেখছিল কোন বৈষম্য নেই ! সব সমান।রতন তাদের ঘরে এসে ফল খেতে খেতে বলল ,
"বাবাজী দুপুর থেকে রাত অবধি কত ম্যাগাজিন, বই, মনোযোগ দিয়ে পড়েন ,লেখেন, এই সময় যেন অন্য মানুষ!একা ভাবুক হয়ে থাকেন।তবে সন্ধ্যার সময়ে প্রায়ই গ্রামের মানুষ জন বাবাজীর কাছে আসেন। উনি দীক্ষা বা গুরু মন্ত্র এসবের বিরোধী, তবু এ গ্রামের অনেক মানুষ তাকে গুরুর মত ভক্তি করে, বাবাজী কারোর প্রনাম নেন না। তাদের নানা সব পরামর্শ দেন ।
সনাতন ধর্ম জ্ঞান ,এসব নিয়ে যেমন আলোচনা করেন, আবার করোর কোন পারিবারিক সমস্যা হলে উনি নানা পরামর্শ দেন,ভরসা সাহস দেন।খুব দরিদ্র মানুষ হলে আর্থিক সাহায্য করেন।
সকাল থেকে দুপুর অন্য মানুষ, সকালে দামোদর থেকে স্নান করে পূজো প্রার্থনা, আর আটটার পর সে সব বাচ্চারা আসে তাদের পড়ান।ওদের সাথে চিড়ে ফলার করে খান।দশটার পর যোগাসন তার পর দুপুরের খাবার তার পর জ্ঞান চর্চা পড়াশোনা অনেক রাত অবধি জাগেন। "
সন্ধ্যার নেমে আসছিল, নবীনের এতক্ষণ নজরে আসে নি সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা আলো জ্বলে গেল।মন্দিরে আর রতনের ঘরে আলো খুব জোড়াল নয় কিন্ত বাবাজীর ঘরে আর বারান্দার আলো ভালো জোর।
রতন যেন আজই বাবাজীর ইতিবৃত্ত বলে নিজে পেট খোলস করল।রতন সন্ধ্যার সময় একটু এক মনে হরেকৃষ্ণ নাম সংকীর্তন করে।রান্নার আর কত সময় লাগে! তাই সময় কাটানো বড় সমস্যার হয়।শরীর চর্চা বা বিদ্যাচর্চা, ধর্ম চর্চা ঈশ্বরের নাম গান ভালো সময় কাটে।
নবীন ইতস্তত করে বাবাজীর ঘরে ঢুকল। তিনি বেশ মনোযোগ দিয়ে কিছু যেন পড়েছিলেন।নবীন সমীহ করে তার খাটে না বসে , মেঝেতেই বসে পড়ল। বাবাজীর নজর আসতেই, ইশারায় তার কাছে তক্তাপোসে এসে বসতে বলল।
নবীন খুব সংকোচে তক্তাপোসের একপ্রান্তে এসে বসেছিল।
বাবাজী নিজের পড়াশোনা ছেড়ে নবীনের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললেন,
"তোমার বোধহয় সময় কাটছেনা! তুমিও পারলে পড়াশোনা নিয়ে থাকবে, দেখবে ভালো সময় কাটবে। অনেক জানবে শিখবে, আমার কাছে অনেক বই আছে ,তবে হয় ইংরাজি বা সংস্কৃত বাংলার বই তেমন নেই। একটা বাংলায় ভগবৎ গীতা আছে, ওটাই পড়বে।
"আমি ইংরাজী হয়ত চর্চা করলে আপনার একটু সাহায্য পেলে পড়তে পারব ,তবে সংস্কৃত সেই কবে সেভেন এইটে দুবছর পড়েছি, সব ভুলে গেছি।"
"এত ব্যস্ত হবার কিছু নেই, আগে তুমি তোমার আগামী দিনের জীবন কী ভাবে কাটাবে সিদ্ধান্ত নাও।আমার যা অনুমান তুমি হতাশগ্রস্ত সংসারে তোমার অনীহা , কিন্তু এটা সময়িক না স্থায়ী সেটা বুঝতে তোমার আরও অনেক সময় দরকার।"
"আমি আর সংসারে ফিরব না, আমি স্ত্রীর দ্বারা চরম লাঞ্ছিত অপমানিত হয়েছি।ও সরকারী চাকুরে,বড় অহংকার আমার আয় কম।ইদানিং ওর চারিত্রিক দোষ আচার আচরণে মনে হচ্ছিল,আর কানাঘুষো শুনছিলাম।"
বাবাজী যেন একটু অস্বস্তি হচ্ছিল, যে নেই তার নামে বদনাম নিন্দা শুনতে তার রুচিতে লাগে তাই বললেন
"সবার মনে সমস্যা, সংসারে সুখ কম, তবু তোমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে, আমার কিছু জানার ইচ্ছা নেই।এসবের সমাধান আমার জানাও নেই। আমার জীবনের সমস্যাটাই মেটাতে পারি নেই,আজ তাই এই আশ্রম জীবনে শান্তির খোঁজ করছি। আমার জীবনের ইতিহাস রতন খানিক জানে।"
"আমাকে বলছিল রতন দা।"
"এর মধ্যেই! বাবাজীর খুব হেসে বললেন,
" রতন মানুষটা এতটাই পেটখোলা আসলে ভীষণ সরল। "
"বাবাজী মনে হয় আমি আপনারা চর্চার ব্যঘাত করছি!"
"আরে বসো, যেটা বলছিলাম,জীবন অনন্ত সময়ের আমরা কতটুকু সঠিক তার উপযোগ করি! তোমার সঙ্গে কথা বলে বেশ ভালো লাগছে,তবে তার মানে এই নয়, আশ্রমে থেকে যাও বলছি!সেটা তোমার একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।আরও অনেক সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে নিজের আগামী দিনের পথ ঠিক করবে ,তুমি বলছ তুমি বিবাহিত।দাম্পত্য জীবনের অভিজ্ঞতা আমারও আছে, অল্প সময়ের দুরত্ব বিরহ মনোমালিন্য কোন সমস্যার নয় বরং কখনও তা ভালো । তবে দীর্ঘ বিরহ দুরত্ব, কিন্তু অবিশ্বাস আর অনাস্থা বাড়ায়। সংসারের তালটাই কেটে যায়। ভালো না মন্দ বলছি না, কিন্তু এসব ভাববার বিষয়। তোমার ব্যক্তিগত জীবন কী ভাবে চালিত করবে নিজ সিদ্ধান্ত নাও।তাড়াহুড়ো নয়। "
রাতের খাবার খেয়ে নবীন ভীষণ তৃপ্ত, এমন দেশী গরুর খীরের মত দুধ আর আতব চালের ভাত! যেন অমৃত! রতনের ঘরেই নবীন শুয়েছিল। বড় তক্তাপোসের কোন সমস্যার নয়।মশারী টাঙ্গানো শুধুমাত্র মশার জন্য নয়।ফাঁকা মাঠ, রাতে বিষধর সাপ বা বিছের দেখা মেলে। যদিও তা কদাচিত। কিন্তু গ্রীষ্মের কাল কালবৈশারীর ঝড় বৃষ্টির কারনে দুদিন আগেই এক মস্ত বড় খরিস গোখরার দেখা পেয়েছিল রতন।বাগানের লাউ গাছের মাচায়।তার পর ঝোঁপে কোথায় মিলিয়ে যায়।আরও সব নানা প্রজাতির বিষধর বিষহীন সাপের দেখা মেলে।কাছেই দামোদর আর বন ঝোঁপ পরিবেশ । তবে নেউলের দেখাও মেলে।
নবীন এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে, যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস পেলো, যেন নেউল তাদের সর্প দংশন থেকে রক্ষা করবে।
রতন বলছিল বাবাজী নাকি এসব ভয় পান না।বলেন অনেক দিন তো হল।যেদিন যাবার চলে যাব।আর তো সংসারে পাওয়ার কিছু নেই!দেওয়ার পালা।তাই যত দিন ঈশ্বরের ইচ্ছায় আছি।আমার ব্যক্তিগত কিছুই সুখ চাহিদা নেই, তাই মরনে ভয় কী !"
এই বয়সেই নবীনেরও তাই মনে হচ্ছিল,শুধুমাত্র মেয়ের জন্য মাঝে মধ্যেই মনটা ভীষণ খারাপ লাগছিল। কিন্তু উপায় কী! সক্ষম মায়ের কাছে আছে, সে নিরাপদ থাকবে। এই ভাবে মানসিক দুঃখ আবেগ দমন করছিল। রতন ঘুমিয়ে গেলেও কত সব পুরোন কথা আজ নবীনের মনে পড়ছিল। তপতীর এত পরিবর্তন! দুচোখ জলে ভরে যাচ্ছিল।
গতরাতে প্রায় ধাক্কা মেরে ঘর থেকেই তপতী স্বামী নবীনকে বের করে দিলেও তার ঘুম আসছিল না।মনের দ্বন্দ্ব তাকে বিভ্রান্ত করছিল। নবীন তার গায়ে হাত তোলে নি কোন দিন, এদিনও কোন গায়ের জোর খাটায় নি। একরকম আত্মসমর্পণের মত চরম হীনমন্যতায়, তপতী তাকে ঠেলে ধাক্কাধাক্কি করলে, নীরবে রাতে তপতীর ঘর থেকে বের হয়ে আসে, তার শর্তেও তপতীকে তাকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে ছিল। এটা তার বড় বাড়াবাড়ি! আর তার চরিত্র নিয়ে যা বলেছে ,তপতী নিজ তো জানে!
নতুন ডাক্তার বাবু মোহে আর প্রেমে সে হাবুডুবু!বেকার অযোগ্য নবীনের আর সেই উদ্দাম উন্মত্তা নেই,তাকে কেমন যেন সমীহ করে তৃপ্ত করতে পারে না।কিন্তু এই নতুন ডাক্তারের মধ্যেই সে সুখ খুঁজে পায়।তার মাদকতায় সে যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিল।পাগলের মত এই সম্পর্কে আঘাত আর বাধা তপতীর অসহ্য! সঙ্গে তার শরীরে একক দাবী ! অথচ তৃপ্ত করার ক্ষমতা নেই, স্বামী ফলানো কিন্তু ইনকামের মুরোদ নেই ! বোকা বোকা মুখটা দেখে তপতীর আচমকাই ক্রোধে উন্মাদ হয়েছিল।
এখন মনে হচ্ছিল এতটা না করলেই হত। আজ রাতটা সহ্য করে বলতে পারতাম এবার থেকে তুমি আমার ঘরে নয়, মিষ্টির দোকানে রাতে শোবে। ঘর থেকে বের করে দেওয়া,একজন পরিনত শিক্ষিত মানুষ, স্বামী সম্পর্ক ,এটা না হলেই হত। অনুতপ্ত মনে সে ঘর খুলেছিল। নবীনের প্রতি তার এতটাই ইদানিং অধম ধারনা ছিল, যে নবীন ঘরের বাইরেই নীরবে বসে এখন থাকবে,আর ডাকলেই ঘরে চলে আসবে। কিন্তু ঘর খুলে নবীনের দেখা পেলো না।
বেশী তো চেঁচামেচি হয়নি, বাড়ির সবাই যে যার ঘরে ঘুমোচ্ছিল। তপতী সদরের দিকে গিয়ে দেখে ভিতর থেকে দরজার খিল খোলা! তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেখল বাইরে আছে কীনা! কিন্তু এক দেড় ঘণ্টা অনেকটাই সময়। এতরাতে আর এক মেয়ে মানুষ, বাইরে থাকা ঠিক নয়।দরজার কপাট লাগলেও খিল ভিতর থেকে বন্ধ না করে ঘরে ফিরে এল।মনটা ভীষন তোলপাড় করছিল!
নবীন আবার আত্মহত্যা করবে না তো! কিছু লিখে তার নামে যদি দোষ দেয়! আবার ভাবছিল হয়ত রাতে হেঁটে বর্ধমানে তার পুরোন মেসে গেছে। কতদূর বড়জোর পনের ষোল কিমি!কিন্তু মিষ্টির দোকানের কী হবে! ব্যাঙ্ক লোন! হাজার চিন্তা আর ভাবনায় তার ঘুম আসছিল না।শেষ রাতে বেশ গাড় ঘুমিয়ে ছিল। ভোরের সময় নবীন মেয়েকে তুলে এনে তাকে ঘুম ঘুম ঘোরের মধ্যেই বাথরুম করিয়ে নিয়ে যায়।রাতের শেষে বিছানা ভেজানো এখনও তার অভ্যাস। আজ সেটাই করেছিল।
ভিজে বিছানার শুয়ে মেয়ের ঘুম ভাঙা ও কান্নার শব্দে তপতীর জেগেছিল।মেয়ের বিছানার নিচে অয়েল ক্লথ তাই রক্ষা।
তপতী গতরাতের সব কথা তার বাড়িতে গোপন করেছিল। ন্যাকামীর ভান করে বলে নবীন এক ঘুমের পর দেখছি ঘরে নেই! ঘরের কপাট খুলে বাইরে থেকে টেনে দিয়ে কোথায় যে গেছে কে জানে!
তপতীর মা রেবা বলে তাই তো ভাবছি সদরের দরজার খিল ভিতর থেকে রাতে আমি বন্ধ করেছি স্পষ্ট মনে আছে। হঠাৎ খিল খোলা কেন!
তপতী ন্যাকামী অভিনয় করে বলে, তাই! তাহলে ওকি পালিয়েছে! না হলে লুকিয়ে কেন! আমাকেও কিছুই বলে নি!"
তপতীর মা উদ্বিগ্ন হয়ে বলে
"দেখ তপতী তাড়াতাড়ি দেখ! তোর সব গহনাগুলো আছে তো!"
তপতী বিরক্ত হয় ,বলে
" না না ও আর যাইহোক চোর নয়,আর নেবে কেন!আমার সব জিনিস তো ওরাও!"
"সেকী তাই ভাবে! তবে লুকিয়ে পালাবে কেন!"
"ভাই পরেশ বলে, "দিদি পুলিশকে জানাব!"
তপতীর তখনও ভয় ছিল যদি নবীন আত্মহত্যা করে! আর তার নামে দোষ চাপায়! তাই রেগে বলল,
"রাখ তো তোর পুলিশ। আমার গহনা গাটি সব আলমারীতে, আর তার চাবি আমার কাছে।চাবি কোথায় রাখি ও জানেই না ,আর এসবে ওর লোভ নেই।দুদিন দেখি না , ঠিক ফিরে আসবে! খাবে কী! বাড়ির অবস্থা তো আমার জানা আছে!"
পরেশ বলে
"মিষ্টির দোকান চলবে কী করে!"
"কেন তুই চালাবি!"
"টাকা কে দেবে! ছানা চিনি জ্বালানি কত সব খরচ, এতসব হিসাব একা সম্ভব !"
"কেন তুই তো বলিস জামাই বাবু কিছুই করে না আমি সব করি!"
"আমি কারিগরের কাজ করি ,কিছুই এসব করতে পারব না।"
"তাহলে বেতন নিবি কি করে!"
"এই দোকান বন্ধ থাক, আমি অন্য দোকানে কাজ করব এত সব দ্বায়িত্ব আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়।"
তপতী ভাবছিল দোকান চালানোর ক্ষেত্রে নবীনের ভূমিকা সে যতটা ভায়ের কথা শুনে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাবত সেটা ঠিক নয়।ব্যাঙ্ক লোনের কী হবে! সেই তো জামিনদার আছে!
ভাবছিল বেশ হল,জব্দ আমি হলাম! মেয়ের দ্বায়িত্ব আর দোকানের ঋন মহা সঙ্কটে পড়লাম। দুদিন পর যদি ও না ফেরে জেদ করলে হবে না বর্ধমানের মেস, আর ওর গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নিতে হবে।
এতটাই মানসিক চাপে পড়ে তপতী যেন দিশেহারা!
বিভ্রান্ত হল, যখন মা বাবা ভাইরা তার সমস্যা নিয়ে উদাসীন আর দায়ছাড়া ভাব দেখল। এদের জন্য আমি কতই না নবীনকে কথা শুনিয়েছি। ভাইকে নিয়মিত বেতন দিতে বাধ্য করেছি! আর আজ বলে কী ও না ফিরলে দোকান চলবে না।মা আবার নবীনকে চোর ভাবছে! ছি ছি এদের জন্য আমি ভিন্ন হই নি।মাঝ থেকে মেয়েটা ভুগছে।
ভাবছিল ওর আর কি দোষ! এত অপমানে সে তো পালাতেই পারে! একে তো শ্বশুর বাড়িতে থাকত অস্বস্তি আর সংকোচে ,আর কত সহ্য করবে! আমার জন্য সব সহ্য করলেও আমি ওকে এমন আঘাত করব ভাবেনি।হয়ত তাই পালিয়েছে।ঈশ্বর দেখো,ও যেন আত্মহত্যা না করে।অনুতপ্ত তপসীর আজ মানুষিক পরিস্থিতি ছিল ডীষন অস্থির।
শারীরিক চাহিদার কাম বাসনা অবৈধ প্রেম কোন দিকে যেন নিমিশে অদৃশ্য হয়েছিল।