জীবন-নদী
জীবন-নদী
সেন গিন্নী চেয়ারে বসে পড়েন, ভাবেন বড্ড নিস্তব্ধ আজ এই ঘর,প্রবল শূন্যতায় ঘিরে আছে এই প্রকাণ্ড বাড়িটা,খুব বেশিই শান্ত চারধার!প্রায় বছর কুড়ির পর এই ঘরে ঢুকলেন তিনি।
দুপুরে দাহ করা হয়েছে সেন সাহেবকে,তাঁর তিপান্ন বছরের সঙ্গী আজ নেই!কিন্তু একটানা তিপান্নটা মাসও কি তাঁরা কাটিয়েছিলেন একসঙ্গে? নিজেকেই প্রশ্ন করেন তিনি।
এই আরামকেদারাটি বড় প্রিয় ছিল সেন সাহেবের।মাত্র এগারো বছর বয়সে, প্রায় জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে,অপরাধ প্রেমের কবিতা পড়া!হাসছেন !আসলে ওনার বাবা ছিলেন অত্যন্ত কঠোর স্বভাবের, ভাবলেন বড় মেয়ে যদি এমন করে,তার আরো দুই ছোটো কন্যা অবশ্যই শিখবে,তাই গোড়া থেকে উপড়ে ফেলায় শ্রেয়!সদ্য ক্লাস সিক্সে উঠা মেয়েটা ,একটু একটু করে সবে বুঝছিলো তার শরীরে পরিবর্তন,কৈশোর থেকে সবে যৌবনে পা দিয়েছিলো মেয়েটা!
সবাই কানাকানি করছিলো ওই মেয়ের গায়ের রঙ বোনদের চেয়ে ঢের কালো ,তাই পালবাবু বুদ্ধিমানের কাজই করলেন,রূপ থাকতে থাকতেই পাত্রস্থ করে,তাছাড়া এত ভালো ঘর হাতছাড়া করা চূড়ান্ত বোকামো। ছোট্ট মাধবীলতার প্রতিবাদ করার মতো সাহস বা বুদ্ধি কোনটাই ছিল না, অতঃপর শুরু হয়ে গেলো তার নতুন জীবন! বাপের বাড়িতে মাকে কখনো কিছু বলতে দেখেননি বাবার মুখের সামনে,কারণ মা ছিল খুবই শান্ত প্রকৃতির এবং এসেছিলেন এক দরিদ্র পরিবার থেকে।
মাধবীলতা বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ী এসে দেখেন শ্বশুরমশাই খুবই গম্ভীর মেজাজের এবং গোঁড়া,ঠিক তার বাবার মতো,কিন্তু শ্বাশুড়ী মা শিক্ষিতা এবং ব্যাক্তিত্ব ময়ী । তাঁর শ্বাশুড়ীমা ছিলেন একমাত্র সন্তান তাই তাঁর বাবার বিশাল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী।তাঁর নির্দেশ বৌমা পড়াশোনা শুরু করবে,অতএব শুরু হলো তাঁর লেখাপড়া, শ্বশুরমশাইয়ের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও।
কিন্তু বাদ সাধলো প্রকৃতি,মাত্র দুবছর যেতে না যেতেই অন্তঃসত্ত্বা হলেন।বছর ষোলোর যুবকের পক্ষে, হয়তো এরবেশি সংযম আশা করা যায় ও না।
প্রথম সন্তান হলো মাত্র তেরো বছর বয়সে।বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার মা হলেন তিনি,শ্বাশুড়ি মায়ের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও। তিনি সামলাতে শুরু করেন বাচ্চাদের ,বৌমাকে প্রায় জোর করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বলেন।এইভাবে বড় দুটি পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পেয়ে স্নাতকের প্রথম বর্ষে পাঠ শুরু করেন,তখন ছেলেরা একজন ছয়, অন্যজন পাঁচ।শ্বাশুড়ী মায়ের হটাৎ শরীর খারাপ,ঘর বাইরে সামলে কঠিন সংগ্রামের মুখে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে স্নাতক হলেন। অবশেষে শ্বাশুড়ী মায়ের অনুপ্রেরণায় প্রবেশ করলেন ইউনিভার্সিটিতে। বাধ সাধলো নিয়তি! নোট আদানপ্রদানের জন্যে পুরুষবন্ধুর সাথে আলোচনা,শ্বশুর মশাই এর কাছে অসভ্যতা ছাড়া কিছু নয় বলে মনে হলো,কোনো ওজর আপত্তি,অনুনয় বিনয় কিছুতেই কাজ হলো না।
অতএব পড়াশোনা পাঠ ঘুচলো।
প্রচণ্ড তাপদাহ তারমধ্যে পয়লা বৈশাখের চাপ শ্বশুরমশাইকে একাই সহ্য করতে হয় প্রত্যেকবারই,কারণ তাঁর ছেলে নাটক,সাহিত্যআলোচনা,বন্ধু বান্ধব নিয়ে ব্যস্ত ,সংসারের প্রতি একেবারেই উদাসীন।শুধু মাস গেলে হাত খরচটির বেলায় যা একটু সজাগ হতেন!কিন্তু তাঁরও তো বয়স বাড়ছে,চাপ সহ্য করতে না পেরে সেরিব্রাল অ্যাটাক হল তাঁর,প্রবল সতর্কতায় তাঁকে বাঁচানো গেলেও ডান দিকটিতে পক্ষাঘাত দেখা দিলো।ব্যবসার ভার এসে পড়লো বৌমার উপর।কারণ নাতিরা পড়াশোনায় ব্যস্ত!আদতে কত যে পড়াশোনা করে , বরং তারচেয়ে আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে বেশি তৎপর।একদিকে ঘরের সবটুকু খেয়াল রাখা ,শ্বশুর শাশুড়ির সেবা,অন্যদিকে ব্যবসার কাজ!কঠিন পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত হতে লাগলো।
তবে তাঁর সুমিষ্ট ব্যাবহার, প্রখর বুদ্ধি,সততা এবং প্রচন্ড পরিশ্রমে বছর দুয়েকের মধ্যেই লাভের পরিমাণ দুগুন হলো।এদিকে তাঁর স্বামীর, স্ত্রীয়ের হাত থেকে অর্থ গ্রহণ করতে পুরুষ হৃদয়ে লাগছিলো,শ্বশুরমশাই ও ভাবছিলেন একজন সামান্য মহিলা হয়ে বৌমার এত উন্নতি মেনে নেওয়া ঠিক নয়, পরে মাথায় চেপে বসতে পারে।তাই নিপুণ হতে অস্ত্র তৈরী করছিলেন, নাতিদের কানে নানারকম বিষ ঢুকিয়ে।
এরই ফলশ্রুতিতে একদিন ভাতৃসম পুরুষ কর্মচারির কাছে মাধবীলতার সামান্য স্বর্ণচাপা নেওয়ার ঘটনাকেও ক্ষমা করা গেলো না। একদিন ঐ ছেলেটি দোকান আসার পথে একটি বুড়ি মাসির কাছে ছোটো একটি স্বর্ণচাপার থোকা নিয়ে এসেছিলো,ভালো লেগে যায় মাধবীলতার,তাই তিনি প্রতিদিন তাকে ফুল আনার কথা বলেনএবং এরজন্যে টাকাও দিয়ে দিতেন।কিন্তু বিশ্বাস করবে কে? এইঘরে তাঁর শ্বাশুড়ীমা ছাড়া আর তো কেউই নেই তার প্রতি আস্থা রাখার মতো!ছেলে বৌমার ( ততদিনে ছেলেরা বিয়ে করে ফেলেছে,এবংপ্রতিদিনই তাদের উৎসব)কাছে এইরকম হেনস্থা সহ্য করতে না পেরে সরে আসেন ব্যবসা থেকে।
সেই থেকে তিনি পড়াশোনা ,লেখালেখি নিয়ে ঘরেই থাকেন।সেখানেও স্বামী র বিরোধিতার সম্মুখীন হলেন,বন্ধ হতে চলেছিলো তাঁর মুক্তির এই পথ,কিন্তু পারেননি।দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মাধবীলতা প্রবলভাবে আঁকরে ছিলেন সাহিত্য জগতকে ,প্রচণ্ড এক জেদ চেপে গিয়েছিলো তাঁর।আজ লেখিকা হিসাবে তাঁর নাম জানে না এমন মানুষ এই বাংলায় নেই।দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর নাম।
দেবী সরস্বতীর সাথে সাথে মা লক্ষ্মীর কৃপাও বর্ষিত হয়ছে তার মাথার উপর।
শুধু আক্ষেপ একটাই শ্বাশুড়ীমা দেখে যেতে পারলেন না এই সাফল্য।
তাঁর প্রচেস্টায় গড়ে ওঠা বিশাল ব্যবসা ছেলেরা উড়িয়ে দিতে শুরু করে ,তখন শ্বশুর মশাই অার সহ্য করতে না পেরে ইহলোক পরিত্যাগ করেন।ছেলেরা সব বিক্রি করে খাচ্ছিলো,কলসির জল তলানিতে ঠেকতে ঠেকতে এখন প্রায় সব শেষ।বসত বাড়ির পিছনের জায়গাটিও বিক্রি করে দিলো শেষমেশ।তবে মাধবীলতা নিউটাউনের দিকে একটি তিন কামরার ফ্ল্যাট কিনে রেখেছেন সবাইকে না জানিয়ে।
ওঁর যা কিছু সবই তো সন্তানদের,তবে একটু কষ্ট করতে পেতে শিখুক ওরা,তাই জানান নি,জীবিত অবস্থায় জানাবেনও না।
বৌমারা বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্যে ঘরেই পার্লার খুলেছে।ছেলেরা তথৈবচ।রোজ রোজ অশান্তি শুনতে পান উপরতলা থেকে।অবশেষে ছেলেরা পার্টির লোক ধরে একটা গুমটি জোগাড় করে ফাস্টফুডের দোকান খোলে,বিক্রিও হচ্ছিলো ভালোই ,ছেলেদের ফিরে পাওয়া দাপট দেখে আন্দাজ করেছিলেন তিনি।
কিন্তু করোনা সব নস্যাৎ করে দিল একনিমেষে,ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলো ছেলে বৌমাদের।সাহায্যের হাতগুলো আগেই বন্ধ হয়েগিয়েছিলো,সঞ্চয় বলতে কিছু নেই।অতএব অগত্যার গতি তাদের কাছে ব্রাত্য এই মা।
আজ যখন মহামারীর প্রকোপ ফেলেছে তাঁর এই বাড়িটিতেও ,তখন একঘরে করে দেওয়া মাকে সবার খুব প্রয়োজন ! হায় রে বিধাতা!
মাধবীলতার অর্থেই ঘরের প্রত্যেকে সেরে উঠেছে করোনা থেকে,শুধু বাঁচানো গেলো না সেন সাহেবকে,বিগত দেড় মাস ধরে যমে মানুষে লড়াই, অতঃপর আজ তিনি দেহত্যাগ করলেন।
মনে মনে ভাবেন মাধবীলতা করোনা নিয়েছে অনেককিছু কিন্তু শিখিয়েছেও অনেক।মানুষ আজ মান ছেড়ে হুশের প্রতি সচেতন।বেশ লাগে যখন মানুষগুলোকে দেখেন দিব্যি মুখোশের উপর মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।আসলে সবাই আমরা আমিতে মগ্ন,প্রকৃতি তাই বদলা নিলো এইভাবে। হয়তো এরও কোথাও প্রয়োজন ছিলো আমাদের লাগাম ছাড়া গতির রাশ টানার, উশৃঙ্খল জীবনকে শৃঙ্খলিত করার।
আসলে নিজের মধ্যেও রাশ টেনে রাখার কৌশল আয়ত্ত করতে হয়,তাহলে আত্ম মর্যাদার জয় হবেই একদিন না একদিন,এটাই সত্য। পরিশ্রম সাহস এবং সংযম ছাড়া সাফল্য আসে না।
হাসেন মনে মনে জীবনের এই নদীর মোহনা অার কত দূর ,কে জানে?