জানলে আর জানতে ইচ্ছে করবে না
জানলে আর জানতে ইচ্ছে করবে না


(
আজকের কথাই বলছি । সারাদিন এদিক ওদিক করে দিনের শেষে বাড়ি ফিরলাম, সাথে একটা বিয়ার নিয়ে ঢুকলাম । খাবো, দুটো সিগারেট টানবো তারপর একটা শান্তিতে ঘুম দেবো । বাড়ি ঢুকতেই শুনতে পাচ্ছি বাজি, কলিপটকার আওয়াজ ছাপিয়ে একটা আওয়াজ মিউজিকাল কান্না না চেছানো বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না, ভেসে আসছে। এরকম আওয়াজ আগেও শুনেছি আমার একটা বন্ধু কে ইয়ারকী মেরে তার বিচিতে দু ঘা মেরেছিলাম ও ওরকম ই চেঁচিয়ে ছিল, কিন্তু এই গলা টা মেয়েলী । নিচ তলার দাদার কাছ থেকে জানতে পারলাম পাশের ক্লাবে কোথা থেকে একজন কাকিমা তুলে এনেছে উনি "গান" গাইছেন । আমি বললাম "ওহ আচ্ছা"।
বুঝতে পেরেছিলাম আজ বাড়ীতে থাকলে রাতের মজা টা কখনোই লুটা যাবে না । তাই বিয়ার খানা আমার জলের বোতলে ঢেলে বেড়িয়ে পরলাম । কোথায় যাওয়া যায় ? সব জায়গায় এখন লোকজনের রমরমা, আতশ বাজি আর ইত্যাদির আওয়াজ । কিন্তু একা থাকতে বড্ড ইচ্ছে করছে । না না মন খারাপ, দুঃখ, কষ্ট, বিরহ কিছুই না শুধু নিজেকে সময় দেওয়া । মাঝে মাঝে এমন হয় নিজের সাথে সময় কাটাতে বড্ড ইচ্ছে করে, আর জিনিস টা খুব দরকার ও নিজেকে অনেক নতুন নতুন ভাবে আবিষ্কার করা যায় । নিজের সাথে কথা বলা যায় । শুনতে পাগল পাগল লাগলেও জিনিস টা সত্যি । আমরা মানুষের ভিড়ে থাকতে থাকতে সবাই কে মনে রেখে নিজেকেই ভূলে যাই অথচ যদি আমাদের জীবনে একান্ত নিজস্ব বলে কিছু থাকে তবে সেটা আমাদের নিজস্বতা, আমাদের সত্ত্বা, আর আমি ।
যাইহোক, এই পার্বণের দিনে আমি কোথায় এক টুকরো জায়গা পাবো নিজের মতো করে বসার জন্য ভাবতে ভাবতে মাথায় এলো নিউটাউন বাস স্ট্যান্ড এর কথা । সেদিন বাসে ফেরার সময় একটা সুন্দর জায়গা বেশ নজর কেরেছিল । আশা করি এখন সেখানে আমার মুহূর্তে ভাগ বসানোর জন্য কেউ থাকবে না । হয়ত দু এক জন মানুষ অথবা মানুষ নয় যারা তারা থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু তারা আমায় আমার সাথে মিশতে বাধা দেবে না । হাটতে শুরু করলাম । রাতের রাস্তায় হাটতে আমার দারুন লাগে । নিস্তব্ধতার মধ্যে বেশ একটা আওয়াজ থাকে সেটা বেশ রোমাঞ্চকর, আর সাথে নিয়ন আলো আর সিগারেটের ধোয়া তো আছেই । ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙ দের গৃহযুদ্ধ বেশ জমেছে বোঝাই যাচ্ছে । মাঝখানে আবার এক মাতাল কাকুর সাথে দেখা । গলা অবদি "দাদা" খেয়ে হাওয়ায় ভাসছে কাকু। ওই মুহূর্তে জীবন কে বিশ্লেষণ করার মতো ক্ষমতা উনার থেকে ভালো আর বোধয় কারোর নেই । "যতই ঘুড়ি উড়াও রাতে, লাটাই তো আমার হাতে" মনের আনন্দে গানটা গাইতে গাইতে আমার কাছে আসলো জিজ্ঞেস করলো -
- আগুন হবে নাকি কাকা ?
- হ্যা হ্যা । এই নাও । (বলে ম্যাচ বক্স টা এগিয়ে দিলাম)
- (পকেট থেকে একটা বিড়ির প্যাকেট বের করে একটা বিরি খুলে মুখে দিলো)
- একাই খাবে ? এদিকে একটা দাও । (বলে একটা বিড়ি চেয়ে নিলাম)
একটা ভালো জিনিস জেনে রাখুন এরকম কাকুদের কাছে এলাকার সেরা বিড়ি পাওয়া যায় । দুজনেই একসাথে হাঁটছি । কাকু আবার মনের আনন্দে গান গাইছে । আমি ওনার গানে ফুলস্টপ দেওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম
- বাড়ি কোথায় কাকা ?
- বাড়ি? হবে কোথাও ? জায়গার অভাব আছে নাকি ।
- সে নেই কিন্তু বাড়ি তো আছে একটা যেখানে তুমি প্রতি রাতে ফেরো কাজ সেরে ।
- (খানিকক্ষণ হাসলো) ওটা ? ওটাকে বাড়ি বলে ?
- তো ওটাকে কি বলে ?
- থাকার জায়গা বললে কেমন হয় !
- তাহলে বাড়ি কোনটা ?
- বাড়ি কোনটা ! হুম্ এটাই তো ভাবার বিষয় বাড়ি কোনটা ?
- আমি তো জানি যেখানে আমরা থাকি সেটাই বাড়ি ।
- না না । থাকলেই বাড়ি হয় না কাকা । যেখানে দু তিন টে মানুষ তাদের সুখ দুঃখ ভাগ করে একসাথে থাকে সেটাকে বাড়ি বলে । কেউ রাতে বাড়ি না ফিরলে যেখানে কেউ অপেক্ষা করে থাকে সেটাকে বাড়ি বলে, যেখানে কেউ ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয় আর জিজ্ঞেস করে কেমন কাটলো সেটাকে বাড়ি বলে । বুঝলে কাকা । থাকতে তো পারি স্টেশনেও, স্টেশনকে কি বাড়ি বলতে পারবো ?
কথা গুলো শুনে এক মুহূর্ত থমকে না গিয়ে পারলাম না । কেমন যেনো নিজের কথা ভাবতে শুরু করলাম । মাতাল হলে কি হবে কথা টা কিন্তু মোটেই ভূল বলে নি । আমি আবার একটু উৎসুক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম
- হ্যা সেরকম বাড়িটাই কোথায় তোমার ?
- সেটাই তো জানিনা । নইলে কি তোমার সাথে এখন এখান দিয়ে হাঁটতাম ?
- তাহলে এদিকে কোথায় যাচ্ছো ?
- জানিনা । যেখানে ঠাই পাবো শুয়ে পরবো । রাত কাটলেই হলো ।
- বেশ দারুন কথা বলো কিন্তু কাকা ।
- তাই নাকি ? কি এমন বললাম ?
- কিছু না ।
- (কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো) তুমি কোথায় যাচ্ছো ?
- আমিও জানি না ।
- আরিব্বস । না জানা ভালো জানতো ? জানলে আর জানতে ইচ্ছে করে না ।
- (অবাক হয়ে ই বললাম) মানে ?
- মানে জানলেই আর জানতে ইচ্ছে করবে না । ওই জন্যই তো জানতে নেই ! (বলে হেসে উঠলো) জানা হয়ে গেলেই পুরোনো না জানা অবদি যতো রাজ্যের কৌতুহল ।
আমি আবার থমকে যেতে বাধ্য হলাম । সত্যিই তো জানা হয়ে গেলেই সব কেমন পুরনো হয়ে যায় । কেমন যেনো পরে ফেলা বইএর মতো । জানার আগেই আমাদের যতো কৌতূহল, যতো ভাবনা, যতো গল্প । বেশ একটা আলাদাই মজা পেয়ে গেছি কথোপকথন টায় । আরও এক ফালি কৌতূহল নিয়ে বললাম
- তুমি কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং কাকা ।
- হা হা হা ! এটাই তো না জানতে দেওয়ার মজা ।
- তা ঠিক বলেছো ।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমিই বললাম
- আমি আসলে বেড়িয়ে ছিলাম নিজের সাথে একটু সময় কাটানোর জন্য । বাড়ি (থেমে গেলাম কেমন) মানে থাকার জায়গা টায় থাকতে ভালো লাগছিলো না তাই ।
- হা হা হা । থাকার জায়গায় থাকতে ভালো লাগছে না । হা হা হা।
শুনে আমার ও কেমন হাসি পেয়ে গেল । দুজনেই একসাথে হাসতে শুরু করেছি । হাসতে হাসতে লোকটা হটাৎ কাশতে শুরু করলো । কাশতে কাশতে হটাৎ বসে পরলো । আমি আবার উনাকে ধরে উঠাতে যাচ্ছিলাম উনি আমায় বারণ করে বললো "ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও । আজকে বোধয় থাকার জায়গা এখানেই"। আমি ছেড়ে উঠে দাড়ালাম আর বললাম "আজ তাহলে যাই কাকা । সাবধানে থেকো"
উনিও সম্মতি দিয়ে বললো "হ্যা হ্যাঁ যাও.......শোনো! তোমার নামটা যেনো কি ?"
আমিও উনার মতই একটু হেসে জবাব দিলাম "জানলে আর জানতে ইচ্ছে করবে না" তারপর দুজনেই আবার হাসতে শুরু করলাম আমি হাসতে হাসতেই ঘুড়ে হাটতে শুরু করলাম । ধীরে ধীরে ওই কাকার হাসির আওয়াজ ও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো ।