জাহ্নবী
জাহ্নবী
জাহ্নবের এ বছর খুব মন খারাপ, প্রতি বছর পঞ্চমী থেকে ষষ্ঠী পাড়ার পূজো প্যান্ডেলের মাইক ওরই হাতে থাকে। এ বছর করোনা আর হাইকোর্টের যুগপৎ আক্রমণে পূজো প্যান্ডেল ভোঁভা, যেটুকু মাইকের ব্যবহার হবে তা ঠাকুরমশাইয়ের পূজোপাঠের, যা সবাই বাড়ি থেকে শুনবে আর সেইমতো অঞ্জলি দেবে। ওতে তো জাহ্নবের ক্যারিশমা দেখানোর কিছু নেই, বাড়িতেও থাকতে পারে নি, অগত্যা পূজোপ্যান্ডেলে মুখভার করে বসে আছে। ঠাকুরমশাই গুণময় চাটুজ্যে ওদিকে বলে চলেছেন-"এতে গন্ধে পুষ্পে, দুর্গায়ৈ নমঃ।"
জাহ্নবের কানে তখন ভাসছে পাঁচবছর আগের এক ঝলমলে পূজোমন্ডপের মঞ্চ থেকে ভেসে আসা তার নিজের কন্ঠ-"আপনারা আর একটু ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করুন, আজকের মঞ্চের প্রধান আকর্ষণ কথাকলি মিত্রের সুকন্ঠ আপনারা এখনি শুনতে পাবেন। শিল্পী সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই, গত পাঁচবছর উনি দূরদর্শনের এক পরিচিত মুখ।" সম্বিৎ ফিরল পূজো কমিটির সেক্রেটারী প্রদীপ দত্তের ডাকে-" কি জাহ্নবদা কেমন আছেন? সাহস করে তবু তো এলেন, নইলে যে একা কতদিক সামলাই, তা আপনি আছেন তো খানিকক্ষণ?"- জাহ্নব মাথা নেড়ে সম্মতি জানানোয়ে উনি দ্রুত পায়ে অন্য কাজে চলে গেলেন। জাহ্নবের এখন অখন্ড অবসর, কলেজ বন্ধ, ছাত্রছাত্রীরাও পূজোর কটা দিন পড়তে আসবে না। একসময়ের দাপুটে বাচিক শিল্পীর কন্ঠ এখন সারাবছর ছাত্রছাত্রীরাই শোনে, তা অবশ্য কবিতায় পাখা মেলে না,ঘুরে বেড়ায় ইতিহাসের অলি গলিতে সাল, তারিখের তকমা গায়ে নিয়ে। ফাঁকা প্যান্ডেলে স্মৃতিরা ঠেলা দিচ্ছে জাহ্নবকে, ভরপেট জলখাবার খাওয়ার দরুন পেটেও ইঁদুরের ডনবৈঠকের সম্ভাবনা নেই। এক নীলাম্বরী সামনে দিয়ে পেরোতে মনে পড়ল, কথার প্রিয় রঙও ছিল নীল।
হ্যাঁ মঞ্চের দাপুটে শিল্পী কথাকলি মিত্র অাস্তে আস্তে জাহ্নবের কথা হয়ে উঠেছিল। প্রথম যেদিন জাহ্নবের ঘোষণা মতো কথাকলি স্টেজে উঠেছিল তখন ওর কাছে জাহ্নব সাধারন ঘোষক ছাড়া কিছুই ছিল না। যদি সেদিন অমন ঘটনাটা ঘটে না যেত তাহলে জাহ্নব আর কথাকলির ইতিহাস হোত অন্য। সেদিন কথাকলি সবে একটা গান শেষ করে দর্শকদের বায়না মতো আর একটা গান ধরতে যাবে, তখনই সবশুদ্ধু ভেঙে পড়ল স্টেজটা। জাহ্নব ছুটে কথাকলিকে বার করে আনতে পেরেছিল, দুজনের আঘাত লাগলেও তা সামলে উঠতে বেশী সময় লাগে নি। তবে জীবন বাঁচানোর ঝুঁকিটা নেওয়াতে কথাকলি ধীরে ধীরে জাহ্নবের কথা হয়ে উঠেছিল। তবে সেই ঝুঁকি নেওয়া অতো সহজ হয় নি, জাহ্নবের ফাস্ট এডে মিটলেও, কথাকলি টানা দশদিন ভর্তি ছিল নার্সিংহোমে। সেইসময় জাহ্নব, মিত্র পরিবারের কাছের আর ভরসার মানুষ হয়ে উঠেছিল। কথাকলিও মানুষটার মধ্যে নিজের বাবাকে আবিষ্কার করেছিল, একই রকম দায়িত্ববোধ। হাসপাতালের কেবিনে রোগক্লিষ্ট অবস্থায় প্রাণ পাওয়ার কৃতজ্ঞতায় কথার মন ভরে উঠেছিল। "জাহ্নবদা-ও জাহ্নবদা কি এতো ভাবছেন বলুন তো, অ্যা- এ বছরটা যা গেল না, এরকম পূজো বাপের জন্মে দেখি নি, আপনি কি নিরিবিলিতে এমনটি বসার সুযোগ পেতেন।"-পাড়ার জগাইয়ের ডাকে চেতন ভাঙে। ও স্থানীয় ইলেকট্রিসিয়ান, কখন কি লাগে, আশেপাশেই থাকছে। জাহ্নব বলে-"ফাঁকা প্যান্ডেলে আর কি করব ভাই, এই নিজের মনে বসে আছি।" জগাই এবার পাশেতে গুছিয়ে বসে কথা শুরু করল-"সেবার পূজোর জলসায় কি কান্ডখানা হয়েছিল জাহ্নবদা মনে আছে, কথাকলি ম্যাডামের প্রাণটাই তো চলে যাচ্ছিল, আপনি ঠিকসময় গিয়ে.."- "হ্যাঁ হ্যাঁ- মনে আছে, এতদিন পরে সেসব কথা মনে করে কি লাভ? এ বারের পূজোটাও তো সেরকম ভাল কাটছে না।"-এই বলে জগাইকে থামিয়ে ওকে অন্য কাজে পাঠিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে মনে হয় ওই দুর্ঘটনা শেষ অবধি ঐ দিনেই থেমে থাকে নি, তার জীবনটাকেও তছনছ করে দিয়েছে। কথাকলি সেরে ওঠার পর বাচিক শিল্পী হিসেবে জাহ্নবকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। কথার যেখানেই অনুষ্ঠান থাকত উদ্যোক্তাদের বলে জাহ্নবের নামও ঢুকিয়ে দিত। এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে জাহ্নব বলেছিল-"এই ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না কথা, আমাকে নিজের চেষ্টায় বাড়তে দাও।" কথা ঘাড় নাড়িয়ে বলেছিল-"প্রত্যেক শিল্পীরই শুরুর জীবনটায় এটুকু সাহায্যের দরকার হয়।" অনেক সময় কবিতা, গান মিলিয়ে থাকত তাদের উপস্থাপনা, যার রিহার্সাল হতো কথাদের
বাড়িতেই। ওই সব রিহার্সালে যন্ত্রানুসঙ্গ-ও থাকত। বেশ কেটেছিল দিনগুলো হাওয়ায় ভেসে। এক মঞ্চ থেকে আরেক মঞ্চে তিনটে বছর পার। জাহ্নবের বাড়িতে এই এন্টারটেনমেন্টের জীবনের বাইরে একটা সরকারি চাকরি পাওয়ার চাপও ছিল। দায়সারা গোছের করে জাহ্নব দিয়েছিল কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা, ভাল রেজাল্ট আর দেওয়া পরীক্ষায় কলেজের চাকরিটা হয়েই গেল জাহ্নবের। পাশাপাশি কথার সঙ্গে অনুষ্ঠানও চলছিল, গাড়িতে টানা কলকাতা থেকে মফস্বলে অনুষ্ঠান করতে যাওয়া। জাহ্নবের মনে কথাকে কেন্দ্র করে সংসারী হওয়ার ইচ্ছেটাও প্রবল হচ্ছিল। গোল বাঁধল মুম্বাইয়ের এক সিনেমা প্রডিউসারের কথার গান পছন্দ হয়ে যাওয়ায়। উচ্চাশার ঘোর লাগা চোখে একদিন কথা কলকাতার পাত্তারি গুটিয়ে মুম্বাই চলে গেল। হ্যাঁ এয়ারপোর্টে গেছিল জাহ্নব, কথাও যোগাযোগ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রথম কিছুদিন ভিডিও কল, তারপর ফোন কল, তারপর অনিয়মিত ফোন কল, শেষে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল যোগাযোগ। মাঝে একবার জাহ্নব শেষ চেষ্টা হিসেবে মুম্বাই গেছিল, কিন্তু কথার ব্যস্ত সিডিউলে দেখা করার সুযোগই হয় নি। তারপর থেকে চলছে জাহ্নবের স্মৃতি রোমন্থন আর আত্মকথন। তাও অন্যান্য বছরে প্যান্ডেলে হইচইয়ের মধ্যে ভুলে থাকে, এবারে নির্জন প্যান্ডেলে ওরা কয়েকজন কর্মকর্তা। কমিটির সেক্রেটারী প্রদীপ দত্ত জাহ্নবের সামনে এসে একটা চেয়ার টেনে বসল। "শুনেছেন জাহ্নবদা-অরূপ বাংলা থেকে শারদ অর্ঘ্য সম্মান প্রতিযোগিতার জন্য কয়েকজন সেলিব্রিটি সন্ধ্যেবেলায় আমাদের প্যান্ডেলে আসবে। ফাঁকা হলেও একটু কিছু,যেমন ফুলের তোড়া নিয়ে আমাদের রেডি থাকতে হবে।"অগত্যা সন্ধ্যেবেলায় সাদা নিভাঁজ ধুতি, পাঞ্জাবী পরে জাহ্নব প্যান্ডেলে আসে।
অপেক্ষা করতে থাকে কর্মকর্তাদের সঙ্গে, একটা অল্টো এসে থামল, গোটা দলের সঙ্গে লাল গরদ পরে ও কে?
কথাকলি মিত্র। জাহ্নবকে দেখে কথা এদিকেই এগিয়ে আসে, বাকীরা প্রতিমা দর্শনে। কথা বলতে থাকে-"মুম্বাইয়ের জীবন কত টাফ তুমি বললে বিশ্বাস করবে না, পরপর ফ্লপ অ্যালবামে চাপ এমনিই বাড়ছিল তার সঙ্গে রোগের আবহ, লক ডাউন, আর পারলাম না। কিছু দিন হল ফিরেছি, লজ্জায় তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি নি। আজকে এই শারদ অর্ঘ্যের ডাকে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেরে স্রেফ তোমার সঙ্গে দেখা হবে ভেবে চলে এলাম,"-জাহ্নব চুপ করে থাকে। কথা হঠাৎ বলে ওঠে-"ভাব না আমি একটা ভাঙা প্যান্ডেলে আবার চাপা পড়েছি।"- জাহ্নব আর থাকতে পারে না, বলে ওঠে-"কথার ডাকে তার জাহ্নব আবার ছুটে যাবে।"
এইসময় কলেজের এক ছাত্র ওদের দেখে এগিয়ে এসে বলে-"স্যার ম্যাডাম বুঝি?"বলেই কথাকে ঝুপ করে একটা প্রণাম করে ফেলে। দুজনের আরক্ত মুখে নতুন প্রতিশ্রুতির রঙ লাগে।