Keya Chatterjee

Drama

3  

Keya Chatterjee

Drama

হুইসেল

হুইসেল

9 mins
6.2K


“একেলে একেলে কাঁহা যা রাহে হো, হমে সাথ লে লো, যাহা যা রহে হো” মেয়েটিকে যতক্ষণ না রাস্তার মোড়ে অদৃশ্য হতে দেখল, রানা ততক্ষণ গানটা হুইসল করতে থাকলো। মেয়েটি বিরক্ত হয়ে একবার তার দিকে শ্যেন দৃষ্টি হেনে রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে গেল। হা হা হা করে হেসে চায়ের ভাঁড়ে তৃপ্তির চুমুক দিলো রানা। বেশ কদিন ধরে তার এটিই একমাত্র বিনোদন। পাড়ার দাদা হিসেবে খ্যাত বা কুখ্যাত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে এলাকার মানুষের মনে ক্ষোভ জমলেও তা আজও উদগীরণ হয়নি। বিল্টুর সাথে সিনেমা নিয়ে কথা বলতে বলতে পা দোলাচ্ছিলো রানা এমন সময় তার সামনে এসে দাঁড়ালেন একজন মহিলা। পরনে সালোয়ার কামিজ, চুলটা পনি টেল করে বাঁধা তবে উস্কো খুস্কো, পায়ে চপ্পল। রানা এক ঝলক তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাচ্ছিল্য ভরে বলল, “বলুন মাসিমা, ভাড়াটে ওঠাতে হবে না ভাসুরকে কেলাতে হবে?”

“এই ঠিকানায় সন্ধে বেলা আসতে হবে। তারপর সেখানেই কাজ বলব খন।”

রানা একটা ধাক্কা খেল যেন, মুখ তুলে তাকাল মহিলার দিকে। প্রসাধন হীন, ভাবুক চেহারা, চোখ দুটো যেন অন্তর অবধি প্রবেশ করার ক্ষমতা রাখে।

“আপনার নাম?” বললো রানা

“সবিতা সেন। ”

রানার হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে হন হন করে হাঁটা লাগলেন তিনি হাউসিং এর দিকে। বিল্টু ফিসফিস করে বলল, “রানা দা বড় পার্টি মনে হচ্ছে। মার্ডার কেস নয়তো? সেসব হলে কিন্তু আমি নেই বলে দিলাম।”

রানা বিরক্ত হয়ে বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে দেখা যাক না কি হয়। ছটার মধ্যে রেডি থাকবি কিন্তু।”

সন্ধে ছটা পনের নাগাদ রানা আর বিল্টু কার্ডে উল্লিখিত ঠিকানায় পৌছল। B1 tower এর চারতলার দু নম্বর ফ্ল্যাট। কলিং বেল টিপতেই দরজা খুললো একটি কুড়ি বাইশ বছরের মেয়ে। পরনে হলুদ তাঁতের শাড়ি, প্রসাধন হীন মুখে কালো টিপটা স্বেচ্ছাচারীর মতো সৌন্দর্য বিস্তার করছে, চোখের কাজল চোখ দুটোকে আরো বুদ্ধিদীপ্ত ও গভীর বানিয়েছে। তার শ্যামলা বর্ণ যেন তাকে আরো উজ্জ্বল করে তুলেছে।

“বলুন কাকে চাইছেন?” মেয়েটির প্রশ্নে সম্বিৎ ফেরে রানার। বুঝতে পারে এতক্ষন সে নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে ছিল মেয়েটির দিকে। নিজেকে সামলে নিয়ে আমতা আমতা করে বলল, “আম…আমায় সবিতা ম্যাডাম ডেকেছেন।”

“কে রে জয়া?” উচ্চস্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সকালের মহিলাটি। এখন তার পরনে একই রকম হলুদ তাঁতের শাড়ি। রানাকে দেখে বললেন, “এসেছেন? খুব খুশি হলাম। বসুন। চা খাবেন তো? জয়া ওদের চা দে।” রানাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে একনাগাড়ে বলে গেলেন সবিতা দেবী আর তার পরেই চলে গেলেন ভেতর ঘরে। বিল্টু সোফায় বসে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল, “ও রানা দা, গুন্ডাকে বাড়িতে ডেকে কেউ খুশি হয় নাকি গো? এ নিশ্চই বিরাট কিছু গন্ডগোলের কেস।”

“এতই যখন ভয় তখন এ লাইনে এসেছিলি কেন? আর ঘুরবি না আমার সাথে বলে দিলাম।” রানার গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বিল্টু একটু মুষড়ে পড়ল।

ইতি মধ্যে তাদের জন্য ট্রে এর উপর চা বিস্কুট সাজিয়ে আনল জয়া। সবিতা দেবী তাকে ডেকেও নিলেন সঙ্গে সঙ্গে। জয়া ভেতর ঘরে চলে গেলে রানা আর বিল্টু নিঃশব্দে চা বিস্কুটে মগ্ন হলো। মিনিটখানেক পরেই জয়া তাদের ডেকে নিল সেই ঘরে। ঘরে ঢুকেই বিল্টুর সাথে রানাও বিস্মিত হয়ে গেল। ঘরটা মোটামুটি বড়। দুদিকে জানলা আর লাগোয়া একটা ব্যালকনি। কোনো আসবাব পত্র নেই বড় ঘরের একপাশে হারমোনিয়াম, কীবোর্ড রাখা তার পাশেই দুজন মহিলা বসে গিটার আর বেহালা হাতে। নিচে বসে আছেন আরেকজন মহিলা তবলা নিয়ে। সবিতা সেন একটা যন্ত্র নিয়ে খুটখাট করছিলেন। রানাকে দেখে হেসে বললেন, “আসুন। আপনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু বুঝতে পারছেন না। সংক্ষেপে তবে বলি। আমরা কজন সংগীতপ্রেমী মিলে একটি মিউজিক গ্রূপ বানিয়েছি। “সংগীতম” আমাদের গ্রূপের নাম। পুরোটাই মহিলা পরিচালিত। আজ আমাদের একটা গানের রেকর্ডিং আছে। কিছু পুরাতন বাংলা গান আর কি। আপনি সকালে চায়ের দোকানে বসে সিটি বাজাচ্ছিলেন। শুনেই আমার strike করল যদি একটা হুইসেল এড করা যায় গানে তবে দারুন হয়। খুব সুরে হুইসেল করছিলেন আপনি, I must say.. তাই আপনাকে ডেকে নিলাম। এটা মাইক্রোফোন এখানে আপনি হুইসেল করবেন। আমি বলে দেব, ঘাবড়াবার কিছু নেই। রেকর্ডিং হয়ে গেলেই ব্যাস ছুটি।” সবিতা দেবী এবার থামলেন। রানা মন্ত্রমুগ্ধের মতো এতক্ষন শুনছিল সব। মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সিটি মারতে হবে মাইক হাতে! মহিলা কি পাগল নাকি! এতদিন রানা চৌধুরীকে সবাই চিনে এসেছে গুন্ডা হিসেবে। মারপিট, তোলা আদায়, হুমকি দেওয়া এইসবের জন্যই সে বিখ্যাত। আজ এতগুলো মেয়ের সামনে সে বসে বসে সিটি বাজাবে! কিছুক্ষন স্তম্ভিত হয়ে রানা বললো, “বাথরুমটা কোন দিকে?” একটি মেয়ে তাকে নিয়ে গেল বাথরুমের দিকে। বাথরুমে ঢুকেই একটা সিগারেট ধরালো রানা। এতটা নার্ভাস তার কখনো লাগেনা এর আগে। এরকম সম্ভ্রম, সম্মান সে এর আগে পায়নি কোথাও। রানা মানেই বোমা, রানা মানেই ডাকাতি, রানা মানেই গুন্ডাগিরি। আর আজ রানা মনে সিটি! ছি রানা ছি! বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোজা সেই ঘরে গেল রানা। মুখের উপর বলে দেবে সে এসব ন্যাকামি সে পারবে না। রেকর্ডিং সে করবে না। ঘরে ঢুকেই শুনতে পেল সমবেত সংগীত। “ও আকাশ সোনা সোনা, এ মাটি সবুজ সবুজ....” সবিতা দেবী সকলকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, “এই তো রানা বাবু এসে গেছেন। আপনি ঠিক এই লয়ে হুইসেলটা শুরু করবেন।” বলে তিনি গাইতে লাগলেন। রানার বুকটা কেমন মুচড়ে উঠলো। চোখটা জ্বালা করে উঠল। মা এর কথা মনে পড়ছে কেন এখন। গানটা যেন মর্মভেদী। এক লহমায় সব অন্ধকার হয়ে গেল। সব অহংকার, জেদ, হিংসা ম্লান হয়ে গেল। রানা নিঃশব্দে চেয়ারে গিয়ে বসল। সবিতা দেবীর নির্দেশ মতো তিন জায়গায় হুইসেলের পার্ট দিল রানা। তারপর একটা গান পুরোটাই হুইসেল করল। কি এক জাদুবলে সন্ধেটা যেন এক অন্য মাত্রা পেয়ে গেল। কোথায় সেই বদমেজাজি, অহংকারী, খল রানা। সে যেন চার বছর আগের সেই কলেজের নিষ্পাপ ছেলেটি।

খানিকটা বিমোহিত হয়ে টলতে টলতেই বাড়ি পৌছল রানা। আজ সন্ধের ঘোরটা যেন কাটতেই চাইছে না। বাড়ি ফিরে দেখল সারা বাড়িটাই অন্ধকারে মোড়া। সকলে খেয়ে শুয়ে পড়েছে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত প্রায় এগারোটা। শুয়ে পড়ারই কথা। সকালে উঠে সবারই ব্যস্ততার শেষ নেই। দাদা প্রাইভেট ব্যাংকের বড় অফিসার, বৌদি শিক্ষিকা, ভাইঝিটা ক্লাস ফোরে উঠেছে। পরশুনার চাপ বেড়েছে। সময় নেই তারও। বাবা সদ্য ছমাস হল তার কেরানির চাকরি থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছেন। রানা বাড়ি না ফিরলে শুধু এই একটা লোকের চোখেই ঘুম আসেনা। আজও তার অন্যথা হলো না। গেট টা খুলেতেই বাইরের আলো জ্বলে উঠল। রানা বুঝল বাবা ঘুমাননি। “এত রাত অব্দি জাগো কেন বাবা? শরীর খারাপ করবে যে!”

“বাবা ঘুমিয়ে পড়েছেন রানা। বাবার শরীর ভালো নেই।” বৌদির কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলো রানা। বহুদিন পর বৌদি তার জন্য অপেক্ষারত। “কি হয়েছে বাবার?” বলল রানা। “জ্বর।” চিত্রা সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে তালা খুলে দিলো। টেবিলে খাবার বাড়তে বাড়তে বললো, “তোমার সাথে কিছু কথা আছে। বসো।” বৌদির এমন ঠান্ডা ও দৃঢ় কণ্ঠস্বরে রানা বিস্মিত হয়ে পড়ল। কি এমন কথা থাকতে পারে তার সাথে বৌদির। রাজনৈতিক পার্টির সাথে হাত মিলিয়ে পাড়ার দাদা হওয়ার পর থেকে বৌদি প্রায় বছরখানেক হল তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। দাদার সাথে তাও মাসে একবার দুবার সংসার খরচ নিয়ে ঝগড়া হয়। কিন্তু ভাইঝি আর বৌদির সাথে দেখাও হয়না প্রায়। আজ কি এমন দরকার পড়ল বৌদির যে নিজে এসে কথা বলছে! রানা বিস্ময় চেপে রেখে বলল, “হ্যাঁ বলো?” খাবারের থালা এগিয়ে দিয়ে চিত্রা বলল, “তুমি বেকারত্বের সমস্যায় ভুগছ আমরা জানি। উপার্জন না করতে পেরে দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে গেছ, ডিপ্রেশন এসেছে। চাকরি বৃত্তি আর চাকুরীজীবিদের প্রতি ঘৃণা এসেছে। সব কিছু সহানুভূতির সাথে মেনে নিলাম। গুন্ডাগিরি শুরু করলে তাও কিছু বলিনি আমরা। কিন্তু এখন ইভ টিসিং! ছি রানা! বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের দেখে তুমি হুইসেল করছ! কাল ও পাড়ার একটা মেয়েকে আজ আমার ছাত্রীকে! সে আর তার মা বাড়ি এসে যা নয় তা বলে গেলেন। কি পাও এসব করে? আমারও তো একটা মেয়ে আছে রানা। আমি কি তোমায় বিশ্বাস করতে পারি? ” রানা আঁতকে উঠল। “কি বলছো বৌদি! তিন্নি আমার ভাইঝি।” কথাটা বলেই স্তব্ধ হলো সে। এরপরের উত্তরটা অবশ্যম্ভাবী। বাকিরাও তো কারুর না কারুর মেয়ে, বোন, ভাইঝি, বোনঝি। চিত্রা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রানার দিকে। তার দৃষ্টি বড্ড ধারালো ঠেকল রানার চোখে। মাথা নামিয়ে নিল সে। চিত্রা চলে গেলে খাবার টেবিলে একাই বসে রইল রানা। মায়ের সহাস্য ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, “হুইসেল করা কি খুব খারাপ মা?”

একমাস পর….

বিশ্বকর্মা পুজোর জন্য অটো স্ট্যান্ডের পান্ডালে কাজে হাত লাগাচ্ছে রানা। ফলের ঝুড়ি, ফুলের প্যাকেট, ধুপ, মোমবাতি, ঠাকুরের হাতে ঘুড়ি, পুরোহিতের দক্ষিনা সব রানার দায়িত্ব। পুজো কাটলে ঠেক বসানো হবে বলে চারটে বোতলও আছে। যদিও বেশ কদিন ওসব খেতে ইচ্ছে করছেনা ওর। কেন এই পরিবর্তন বুঝতে পারছে না রানা। টিউব লাইট টা ঠিক করতে করতে বিল্টুর ডাকে পিছন ফিরতেই চোখাচুখি হলো জয়ার সাথে। সেই সহাস্য মুখ। চোখে গভীরতা। নিমেষে অস্থির পরিবেশটা নরম আলোয় ভরে গেল। পাখিরা ডেকে উঠল দূর দিগন্তে। ঝর্নার কল কল ধ্বনি শোনা গেল যেন। “রানাদা উনি তোমায় কিছু দিতে এসেছেন।” বিল্টুর কথায় সম্বিৎ ফেরে রানার। “দিতে? হ্যাঁ বলুন না।” জয়া নিঃশব্দে একটি সিডি ধরিয়ে দেয় রানার হাতে। “একবার শুনে দেখুন।” জয়ার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই বিল্টু ছোঁ মেরে তুলে নিল সিডিটা। আর সিডি প্লেয়ারে চালিয়ে দিল। সবাই শুনল সংগীতম গ্রূপের গানের সাথে রানার হুইসেল। সোৎসাহ করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠল প্যান্ডেল।

“ধন্যবাদ শব্দটা খুব ছোট। তবু আপনাদের গ্রূপকে, সবিতা ম্যাডাম কে আমার অশেষ ধন্যবাদ জানাবেন। এই সিডিটা আমার জীবনের অন্যতম এসেট।” জয়াকে রিক্সা স্ট্যান্ডের দিকে এগোতে এগোতে বলল রানা। “ধন্যবাদ টা নিজেই দিয়ে দিন না। আপনাকে তো আসতেই হবে পরশু।” জয়া ভ্রূ নাচিয়ে বলে উঠল।

“পরশু? পরশু কি হবে?”

“সিডিটা রিলিজ হবে। আপনাকে আসতেই হবে। পারফর্ম করতে হবে।”

“আ-আমি। আমি স-স্টেজে দাঁড়িয়ে কিছু করতে পারবো না। ক্ষেপেছেন নাকি মসাই!”

“আসতে আপনাকে হবেই। আর আমি জানি আপনি আসবেন। সন্ধে ৬টা। নন্দন। আসি।” প্রায় আদেশ দিয়েই রিক্সা চেপে মিলিয়ে গেল জয়া। জোর খাটাল? হতেও পারে।

সিডি প্রকাশের দিন নন্দন চত্বরে ঘোরাফেরা করতে লাগল রানা। সিগারেটের পর সিগারেট। পরীক্ষাতেও হয়তো এতটা টেনশন হয়নি তার। এখনো সংগীতম গ্রূপ পৌঁছয়েনি। ওদের আসার আগেই রানা এসে হাজির। হঠাৎ পিঠে পরম মমত্বে ভরা স্পর্শ। পিছন ফিরে রানা দেখলো সবিতা দেবী দাঁড়িয়ে। হেসে বললেন, “আমি জানতাম আপনি আসবেন। আসুন পাঞ্জাবিটা পরে নিন।”

“পাঞ্জাবি?”

“আমাদের গ্রূপের ইউনিফর্ম।”

রানা দেখল সবিতা দেবীর হাতে একটি কলকা করা হলুদ পাঞ্জাবি। যেমন টা সবিতা দেবী পরে আছেন অবিকল একই রকম। মানুষটা যেন একদিনের পরিচয়েই রানার থেকেও রানাকে বেশি করে চিনে ফেলেছেন।

মঞ্চে ওঠার আগে পার্স খুলে একবার মায়ের ছবিটা দেখল রানা। চোখটা কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। বাবা তার অসামাজিক কাজ মেনে নিতে পারেননি তবু রানার জন্য জেগে থাকেন ভোর রাত পর্যন্ত। প্রায় বছর দুয়েক কথা হয়নি বাবার সাথে। রানা রোজই চেষ্টা করে বাবার সাথে কথা বলার কিন্তু বিকাশ বাবু রোজই ছেলে বাড়ি ফেরার পর ছেলেকে খাবার টেবিলে বসতে দেখেন, তারপর একটি কথারও উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে চলে যান। রানা জানে বাবা আজও তার জন্য জেগে থাকবেন। চোখটা এবার ভিজে গেল। রানার স্মৃতির জাল ছিঁড়ল মঞ্চের আহবানে। “এখন স্টেজে আসছেন সংগীতম গ্রূপের কলাকুশলীরা এবং তাদের নবতম সদস্য রণদীপ চৌধুরী।” সঞ্চালকের আহবান শোনা গেল। “রণদীপ,রণদীপ” নামটা যেন বহুযুগ পর কানে এল। এই নামটা যে আছে তা তার মনেই ছিল না। মনে মনে হেসে ফেলল রানা। আর বসে থাকার সময় নেই এবার মঞ্চে উঠতে হবে। পর্দা ঠেলে মঞ্চে উঠল সংগীতম গ্রূপ। শুরু হলো সংগীত লহরী। গানে, সুরে, গল্পে জীবনের এক অভাবনীয় সন্ধ্যা উপহার পেল রানা। তার হুইসলে করতালিতে ভরে উঠল হল। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলতে লাগল রেওয়াজ ছাড়া এমন হুইসেল দেওয়া ভগবান প্রদত্ত ক্ষমতা। এরপর এল সিডি প্রকাশের সময়। প্রত্যেক কলাকুশলীর হাতে একটি করে সিডি। সিডিটির মোড়ক উন্মোচন করলেন এক বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী। তিনি রানার কাছে এসে তার পিঠ চাপড়ে দিলেন। সব কিছুই যেন স্বপ্ন রানার কাছে। এসব কি আদৌ সত্যি। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে সে।

অনুষ্ঠানের পর সকলে সকলকে বিদায় জানানোর পালা । কিন্তু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা রানাকে। ফোন করলেও ফোন তোলে না সে। নিরুপায় হয়ে সকলে ফিরে চলল নিজ বাসায়। জয়া বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে রইল বাস স্ট্যান্ডে। তাকে চমকে দিয়ে উদ্ভিদের মতো তার পাশে এসে দাঁড়াল রানা। “একি কোথায় ছিলেন এতক্ষন? সবাই আপনাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান আর আপনি..” জয়ার কথা শেষ হল না আলো আঁধারিতে সে দেখল রানার চোখ লাল। “আপনি কাঁদছেন?” জোয়ার সুর নরম হয়ে এল। “আজকের দিনটা কোনোদিন ভুলবোনা আমি জয়া দেবী। আপনারা আমায় যা দিলেন তা ভোলার নয়। তার কণা মাত্রও আপনাদের ফেরত দিতে পারব না হয়তো। কিন্তু আজকের পর থেকে ঐ নরক কি আমায় ছাড়বে?” বলল রানা।

“আপনি ছাড়তে চাইলে নিশ্চই পারবেন । আমি- না মানে আমরা তো আছিই আপনার বন্ধু।” জয়ার শেষ ক’টা কথায় নির্ভরতা পেল রানা।

বাস থেকে নেমে দুজনেই দুজনের গন্তব্যের দিকে হাঁটা লাগল। বাড়ির গেট অবধি পৌঁছেই অবাক হওয়ার পালা রানার। কি শুনছে সে! হ্যাঁ ঠিক, সংগীতমের গান। ঘরে হুড়মুড় করে ঢুকল সে। ইজি চেয়ারে বসে বাবা, আর সোফায় ভাগাভাগি করে বসে দাদা বৌদি। ভাইঝিটা লাফিয়ে কোলে উঠে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিল কাকার গালে। সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোথা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ছ্যাৎ করে উঠল রানার বুকটা। ওরা কি তবে অনুষ্ঠানে গেছিল? সিডি প্লেয়ারে বেজে চলেছে একের পর এক গান। রানা নিঃশব্দে বাবার কাছে গিয়ে কোলে মাথা রাখল। ফুঁপিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন, “হুইসেল করা খুব খারাপ নয় রে বাবা!”

সমাপ্ত--


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama