গুলাল আবু বকর ‹›

Comedy Others

3  

গুলাল আবু বকর ‹›

Comedy Others

হাসি পেলে হাসুন, কিম্বা...১০

হাসি পেলে হাসুন, কিম্বা...১০

5 mins
192


           ★ সিরিয়ালের ফাঁদে ★

স্বামী যখন কাজ থেকে বাড়ি ফেরেন, এসে প্রায়ই দেখেন, তার স্ত্রী টিভি নামক এক মানুষ-খাদকের সম্মুখে (তবে কে যে কাকে খায়, বলা মুশকিল!) উপবিষ্ট আছেন বা লেপ্টে থাকেন। নিজেকে তার বেচারা মনে হয়, তিনি যে এখন বাড়িতে ফিরেছেন এবং কেমনভাবে ফিরেছেন...তাহা অন্তর্যামী ছাড়া আর কেহ বোধহয় খোঁজখবর রাখেননা।

একদিন এই অসহায় জীবটি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে স্ত্রীর কাছে জানতে চান,

— আচ্ছা, রোজ রোজ কী এমন তুমি দেখো, চোখ ব্যথা করেনা কি?

যাকে উদ্দেশ্য করে এই জিজ্ঞাসা উত্থাপন করা হলো তিনি বিচলিত না হয়ে সগর্বে জবাব দেন,

— তুমি ওসবের কী বুঝবে বলো, এখানে নানারকম রান্নার পদগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে টিভিতে দেখায়, দারুণ দারুণ সব রান্না শেখায়!

জীবটি তখন আবার বেফাঁস মন্তব্য করে ফেলেন,

— হুঁ, সারাদিন বসে বসে শুধু রান্নাই দেখো, কই ভালো কিছু তৈরি করে তো একটা দিন খাওয়াতে পারো না!

একথায় বোধহয় আগুনে ঘি ঢালা হলো। সবাই কিন্তু জানে জেনেশুনে বিষপান করতে নেই, তবুও এই জীবটি তা করলেন।

রাগে অগ্নিশর্মা স্ত্রী’র সমুচিত জবাব বুলেটের মতো বেরিয়ে এসে বিঁধলো,

— ও আচ্ছা, তাই বুঝি! তা তুমি তো গ্রহ নক্ষত্রের নিয়ম মেনে নিয়মিত “কৌন্ বনেগা ক্রোড়পতি” দেখতে, সেই তুমি কেন আজও কেরানী রয়ে গেলে?

উপরের এইটা লেখার অর্থ আজকের যেটি বিষয় সিরিয়াল, তাকে পাশ কাটানো নয়। বরং অন্যপাশ দিয়ে সিরিয়ালের ভেতর ঢোকার একখান চেষ্টা।

       টিভির কিছু জঞ্জালকে যদি সিরিয়াল না বলে ‘সিরিয়াল কিলার’ বলি তাহলে কি সবাই রে রে করে তেড়ে আসবেন নাকি, বিশেষ করে গৃহিণী নারী সম্প্রদায়! এ সন্দেহ আমার মনে থেকেই যাবে। তবে এসব বলার পিছনে একেবারে যুক্তি যে নেই তা নয়। এসব হাবজি-গুবজি সিরিয়াল আমাদের একটু একটু করে হত্যা করছে। বিশেষ করে আমাদের নিরাপরাধ মনকে। ইতিপূর্বে কিছু পারিবারিক আত্মহত্যার ঘটনাও সংবাদমাধ্যমে পাওয়া গেছে, যার পেছনে কিছু সিরিয়ালের নক্সা কাটা আছে। এগুলো ‘কিল’ করছে পারিবারিক বন্ধন, মানসিক সুস্থতা, সামাজিক স্থিরতা। আরো একটু নরম ভাষায় বললে, ক্রমশ কিলিয়ে মারছে...কিল, চড়, ঘুষি খেলে একটা মানুষের যেমনটা অবস্থা হয় আরকি!

       ইতিমধ্যে সমাজ জীবনে সিরিয়ালের প্রভাব নিয়ে কিছু কিছু তথ্য সংগৃহীত হয়েছে ও গবেষণা করা হয়েছে। তাই মনে করার দরকার নেই, আমার এই লেখার সবই বানোয়াট।

স্বামী স্ত্রী'র মানসিক দূরত্ব তৈরির জন্য কিছু সিরিয়ালের আংশিক ভূমিকা আছে। কারণ হলো, দর্শকের মনে বিলাসিতার বাসনা উদগ্র হচ্ছে ও পরবর্তীতে আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু ঘটছে। এটা ঢুকে পড়ছে কিন্তু পিছনের রাস্তা দিয়ে— চেতনে, অবচেতনে, অতি ধীরে ধীরে আবেগের ওপর ভর করে। ক্রমে ক্রমে একসময় এটি সুপ্ত মানসিক অপরাধকে তোল্লাই দিতে থাকে। আমার আপনার মন তখন নীতিবোধের বেড়া ভেঙে ঢুকে পড়ে সম্ভোগনীতিতে।

সুখস্বপ্নের সাথে ছিঁচকান্নার ককটেল মিশিয়ে মুচমুচে গরম করে ঠোঁটে তুলে দেওয়া হয়। চুমুক না দিয়ে যেন উপায় থাকে না! হেঁসেলে, ড্রইংরুমে, বেডরুমে এভাবনার অবারিত যাতায়াত শুরু হয়। ছোটদেরও মাথা চেবানোর হরেক মশালা, রূপকথার পসরা।

       দর্শকদের একটি বড় অংশ মনে করেন বাস্তবজগতে নয়, সিরিয়ালের রঙিন জগতে মানসিকভাবে তাদের বসবাস। মিথ্যে ও অগভীর সম্পর্ক তৈরি করার অ্যাডভেঞ্চার আমাদের মনে সুপ্তভাবে বিদ্যমান থাকে। আর ঐযে ওনারা এখবর বেখবর নন, তাই সুকৌশলে চেষ্টা করেন এই পাবলিককে কিভাবে কী খাওয়ানো যায়! কিছু ক্ষেত্রে ধরেবেঁধে তারা গিলিয়ে দেন। প্রচলিত মূল্যবোধ আলগা করে দিলে তা সুড়সড় করে আপন মনে আপনাআপনি জায়গা করে নেয়।

       বলা চলে আমরা সবাই জীবনযন্ত্রনা ভুলতে চাইছি, কোথাও যেন একটু একটু করে হেরে যাচ্ছি, না পাওয়ার অতৃপ্তিকে তৃপ্ত করতে কল্পতরু হয়ে উঠছে সিরিয়াল, নাটক, সিনেমা প্রভৃতি।

       বর্তমান সামাজিক সমস্যা আমাদেরকে ক্রমশ জর্জরিত করছে বলেই আমরা পালিয়ে বাঁচতে চাইছি গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়ে। চাইছি সেখান থেকে যেন বেরোতে না হয়। যখন সত্যিই বেরিয়ে আসতে হচ্ছে, শুরু হচ্ছে সমস্যা।

সমস্যা এলে তো বেসামাল অবস্থা, উত্তরণের পথ কী তবে একেবারে নেই! ...নিশ্চয়ই আছে, আলবাৎ আছে!

       কার্যত অবনমনের পথ হয় সহজ আর উত্তরণের পথ হয় কঠিন অর্থাৎ নামতে সহজ লাগে আর উঠতে কষ্ট হয়, এ তো এক সাধারণ অভিজ্ঞতা। তাই গাল হাঁ করে দেখতে থাকা প্রচুর সিরিয়ালের কুপ্রভাবে গাড্ডায় পড়ে যাওয়া যায় অতি সহজে। গা ঝেড়ে উঠে বাঁচতে চাইলে কয়েকটি সংযম পদ্ধতি অনুসরণ ও অনুশীলন করা যেতে পারে।

১. নিজের মনকে আগে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, বোঝাতে হবে ভালো ও মন্দের বোধ সম্পর্কে।

২. সিরিয়ালের মন্দ মূল্যবোধ ও বাড়াবাড়ি কথাবার্তার সমালোচনা করতে হবে মনে মনে।

৩. ধর্মীয়ভাবে মূল্যবোধের বিষয়ে পড়াশোনা ও চর্চা করে মোকাবেলা করা যায়।

       গম্ভীর আলোচনা একটু বেশি হয়ে গেলো এই পর্যায়ে। পরিবেশ এখন হাল্কা করা দরকার।

টিভিতে একটি বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে, অনেক দর্শকই আগ্রহ নিয়ে বিজ্ঞাপনটি দেখছেন :

“শীঘ্রই আসছে!

একটি অভিনব দুর্ধর্ষ ডিটেকটিভ টিভি সিরিয়াল।

এখানে ডিটেকটিভের কোনো সহকারী নেই, কোনো প্রশিক্ষিত কুকুর নেই, কোনো বাইনোকুলার নেই, কোনো আতসকাঁচ নেই, নেই কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহের বালাই...

এখানে প্রতিটি রহস্যের সমাধান করা হয়েছে গাণিতিক পদ্ধতিতে, শুধুমাত্র কাগজে অঙ্ক কষে। সবকটি সমাধান করা হয়েছে নিখুঁতভাবে।”

       এই বিজ্ঞাপনটি শেষ হওয়ার পরপরই অন্য একটি বিজ্ঞাপদাতার আরেকটি বিজ্ঞাপন শুরু হয় :

“আমাদের পণ্যগুলি হলো, কলম, কাগজ ও ক্যালকুলেটর। একটি দুর্দান্ত টিভি সিরিয়ালে শুধুমাত্র আমাদের কোম্পানির সামগ্রীগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। গণিতের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আমাদের বিশেষ ছাড় আছে।”

★★

একে তো করোনা পরিস্থিতি তার ওপরে ব্যাঙ্কের ভিতরে থাকা ম্যানেজারের সাক্ষাৎপ্রার্থীদের কেউ বের হয়ে আসছেন না, ফলে ব্যাঙ্কের সামনে ভীড়পূর্ণ একটি লাইন দৃষ্টিগোচর হলো। আমার গন্তব্যস্থল ব্যাঙ্কের অন্দরে হলেও জনসমাগম দেখে ফিরে যাওয়া মনস্থ করলাম। দারোয়ানের সাথে আমার মোটামুটি চেনাজানা আছে। চলে আসার আগে দারোয়ানকে বললাম,

— ব্যাপার কি, আজকে এত বেশি লোকজন কেন?

দারোয়ান ডাইনে বামে একটু দেখে নিয়ে যাতে অন্যকেউ শুনতে না পায় এমনভাবে নিচুগলায় বললো,

— ম্যানেজার সাহেব সাপ্তাহিক একটি টিভি সিরিয়াল মন দিয়ে দেখছেন। সেজন্য কিছু সাক্ষাৎপ্রার্থীকে এখনও বসিয়ে রেখেছেন। প্রকৃত ব্যাপার হলো, সিরিয়ালটি তৈরির জন্য ব্যাঙ্কের এই ব্রাঞ্চ থেকে বহু টাকা ইনভেস্ট করা হয়েছে। সিরিয়ালটি চলবে কিনা তিনি পরখ করে দেখছেন। ভালো না হলে তিনি টাকা ঢালা বন্ধ করে দেবেন।

★★

জনৈক ডাক্তারের চেম্বারে একজন মানুষ তার নিজের চেক আপের জন্য এলো। বাইরে থেকে দেখা যায় শরীর হলুদ হয়ে গেছে।

ডাক্তার রোগীর কাছে শারীরিক অসুবিধার কথা জানতে চাইলেন। রোগী জানালো তেমন উল্লেখযোগ্য অসুবিধা তার হচ্ছে না, শুধু গা হলুদ লাগছে, এই যা। কোনো দুর্বলতা বোধ নেই কিংবা ক্ষুধা কমে যায় নি।

ডাক্তার ক্লিনিক্যালি কোনো সিম্পটম না পেয়ে এটাকে জন্ডিস বলতে পারছেন না। তিনি জানতে চাইলেন,

— আপনি কি অনিয়মিত খাওয়া দাওয়া করেন?

রোগী উত্তর দেয়,

— না, আমি সময়মতো খাই।

— তাহলে খুব বেশি পরিশ্রম করেন কি?

— না, অফিস থেকে ফিরে কোনো অতিরিক্ত কাজ করিনা।

— বাড়িতে অবসরে কি করেন?

— অবসরে বেশিরভাগ সময় টিভিতে বিভিন্ন খবরের চ্যানেল দেখি আর সঙ্গে দু’একটি সিরিয়াল।

ডাক্তারের মুখে এবার মৃদু হাসি দেখা গেলো। মনে হলো তিনি কিছু একটা সিদ্ধান্তে এসেছেন। জোরে একটি শ্বাস টেনে রোগীকে জানালেন,

— ওঃ, এবার ব্যাপারখানা আমার কাছে পরিস্কার হয়েছে। মন দিয়ে শোনেন। মনে হচ্ছে আপনি হলুদ-সংবাদ চ্যানেলগুলো বেশি দেখেন। মানে হলুদ সাংবাদিকতার চ্যানেলগুলো (yellow journalism) আপনার এ অবস্থার জন্য দায়ী। সাথে যে সিরিয়ালটি দেখেন সেটিও হলুদ বলেই মনে হয়। চ্যানেলগুলো পালটে ফেলুন, আশা করি ভালো হয়ে যাবেন।

★★

স্বামী স্ত্রী’র উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের মধ্য হতে আমরা দু’জনের দুটি বিশেষ লাইন আলাদা করে তুলে নিচ্ছি :

স্ত্রী : দেখো বলছি— তুমি যদি ঐ সিরিয়ালের ঐ অভিনেতার চোখ দিয়ে আমাকে দেখতে না পারো তবে বলে দাও... আমি আর একদণ্ড এখানে থাকতে চাই না...।

স্বামী : বেশ তো, আমি সেটা দেখবো। তাহলে তুমি অমুক সিরিয়ালের অমুক নায়িকা পরকীয়ায় যা করেছিলো, সেকথা মনে আছে তোমার? তেমন করে আমার দিকে তাকিয়ে দেখলে না কোনোদিন!

স্ত্রী : নচ্ছার মেয়েটা পরকীয়ায় যা করেছিলো তা তোমার সাথে করতে যাবো কোন্ দুঃখে?


© বিদায়ের সময় এসে গেছে, দেখা হবে পরবর্তী ১১ নং পর্বে। সপ্তাহে একটি লেখা অবশ্যই পাবেন। সেটা কিন্তু এদের publish করার ওপর নির্ভর করছে।

বিঃ দ্রঃ—এরা লেখা পাবলিশ করতে যদি ২/৩ দিন সময় নেন, তবে কি-ই বা করতে পারি!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy