একটি সরস উপাখ্যান
একটি সরস উপাখ্যান
৹ রম্যরচনা ৹
১.
বেশ কিছুদিন হলো মনে মনে ভাবছি সুরারসিক দুনিয়াকে সামনে রেখে একটি রচনা দাঁড় করাবো। ভাবনা ও এই লেখার মাঝখানে অন্যান্য কয়েকটি লেখা কলম থেকে বের হয়ে এলো। সুতরাং মহেন্দ্রক্ষণ কখন আসে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। অবশেষে গ্রীষ্মের এক দ্বিপ্রহরে মাথায় সূর্যের কড়া তাত লেগে মাথাটা কেমন যেন তারকাচিহ্নিত হয়ে পা-দুখানা টলে গেলো। অকস্মাৎ মনে পড়ে গেলো, সুরারসিক বাবুগণ যখন লোড অবস্থায় থাকে তখন ঠিক কেমনভাবে মাথার ভেতর তারাগুলো ঘুরে বেড়ায়, আমার কি তেমন ভাব হলো নাকি!
তবে এটা নিছকই নিজস্ব ভাবনার কথা বললাম, বাস্তবে কি যে হয় তা নিয়ে এরপর কিছু খোঁজখবর সংগ্রহ করে লেখার তাগিদ অনুভব করি। যার ফলশ্রুতিতে বর্তমান রচনাখানি ভূমিষ্ঠ হলো।
জীবনের আঁকেবাঁকে ছোটবেলায় নিজ গ্রামে, পথচলতি রাস্তায়, বড়ো রাস্তার ধারে, বাসে, বাজারে ইত্যাদি নানাস্থানে সুরাপানকারীদের বহু বিচিত্র ভঙ্গি, ভাষা ও করুণ অবস্থা চোখে পড়েছে ও পড়ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা আমাকে কৌতুককর উপাদান সরবরাহ করেছে। সমানভাবে তাদের করুণ দশায়, আমার অন্তর সহানুভূতি প্রকাশ করেছে কম নয়। তথাপি নানা কারণে সুরাপানের পক্ষে সমর্থন আদায়, আমার কাছ থেকে তারা কোনোদিন লাভ করবে না।
সিনেমায় দেখেছি, অনেকে মদ্যপের চরিত্রে অভিনয়ে এতো দক্ষ হন যে সেটা তার মূল অভিনয়কে ছাপিয়ে চলে যায়। তাদের কত আর নাম বলে বিব্রত বোধ করবো! হিন্দি সিনেমার কমেডিয়ান কেষ্টো মুখার্জিকে কোনোদিন ভিন্ন কোনো চরিত্রে অভিনয় করতে দেখিনি। মনে হয়, সত্যি সত্যি লোডিং না হলে তিনি ঐ জুতসই তরল চরিত্র উপহার দিতে পারতেন না। নায়কদের মধ্যে কে মদ্যপ চরিত্রে অভিনয় করেননি সেটা বরং আমার অজানা। কমবেশি সবাই দক্ষ ও সাবলীল। এর মধ্যে মনে দাগ কেটেছে অমিতাভ বচ্চনের 'তরল' চরিত্রগুলি। তাকে এ ব্যাপারে 'শাহেনশা' বলা যায়।
ঝাঁঝালো সেইসব তরল নিয়ে নানাপ্রকার বিচ্ছিন্ন কথাবার্তায় এই লেখা সাজানো। পৃথক পৃথকভাবে মাথা, ধড় বা অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খোঁজার চেষ্টা করলে হতাশ হতে হবে। কারণ তরলে অবগাহন করলে কোনোকিছু আর সরল নিয়মে সামনে আসে না, সব সোজাগুলো তখন কেমন উল্টো মনে হয়। উল্টো কাণ্ড হয়ে যাওয়ার প্রথম কাহিনী দিয়ে মূল আড্ডায় অনুপ্রবেশ করি।
সেটি শুরু করার আগে আর একখানা শেষকথা বলে নিই। প্রচলিত যে কৌতুকগুলো এখানে ব্যবহার করবো তা কোনো না কোনোসময় হয়তো আপনি শুনেছেন বা বলতে পারি, পড়েছেন। আমার কথা হলো প্রচলিত কৌতুকগুলিতে কোনো নির্দিষ্ট লেখকের নাম উল্লেখ থাকেনা। তাহলেও যেখানে প্রয়োজন মনে করবো সংশ্লিষ্ট উৎসের নাম উল্লেখ করে দেবো।
এগল্প এক সরল বন্ধুত্বের, তরল বস্তু নিয়ে জটিল বিপত্তির কাহিনী। একজন শহুরে চাকুরিজীবী যার জন্ম ও বেড়ে ওঠা এক গ্রামে। দীর্ঘ ব্যবধানের পর একবার ঠিক করলেন পুরনো বন্ধুদের সাথে মোলাকাত করতে একদিনের জন্য গ্রামে যাবেন। দেখাসাক্ষাৎ করে রাতের ট্রেনে শহরে ফিরে আসবেন। সেইমতো ছুটির দিন এক বিকেলবেলায় ট্রেনে চাপলেন। গ্রামে গিয়ে তিনজন পুরানো বন্ধুর সাথে প্রচুর গল্পগুজব, আড্ডা দিলেন। পুনর্মিলনী উৎসব হলো, তাতে রঙিন তরলের ফোয়ারা ছুটলো। আড্ডা শেষ হলো রাত এগারোটায়। শহরগামী শেষ ট্রেন ছাড়তে অল্প সময় বাকি। সকলের অবস্থা তখন বেশ টলোমলো। এমতো অবস্থায় চার বন্ধু স্টেশনের দিকে দৌড় দিলেন। সবেমাত্র স্টেশনে পৌঁচেছেন, ট্রেন সিটি দিয়ে বেরোতে শুরু করেছে। এক দৌড়ে ট্রেনে গিয়ে উঠলেন তিনজন, একজন পারলেন না। যিনি শহরে ফিরবেন তিনি প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন আর বিস্মিত হয়ে দেখছেন, যে তিনজন তাকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন তারা চলন্ত ট্রেনের মধ্যে রয়ে গেছে এবং দ্রুতগতিতে সেই ট্রেন গন্তব্যস্থলের দিকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
সাধারণত চড়া মদ্যপানের পর সহজভাবে বিদায় গ্রহণ করা সহজ ব্যাপার নয়। এরূপ কোনো এক মাতাল, সন্ধ্যায় পার্টি শুরু হওয়ার পর মাত্র দু'পেগ গলায় ঢেলে সবার কাছে গিয়ে 'গুড নাইট' 'গুড নাইট' বলে বিদায় চাইতো। এতে অনেকে অবাক হয়ে যেতো। এখন কেবল সন্ধ্যা শুরু হয়েছে, অথচ লোকটি বলে চলেছে গুড নাইট। কৌতুহলী হয়ে কেউ কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বলতো, "পার্টি শেষে যখন বিদায় নেওয়ার পালা আসবে তখন বিদায় চাওয়ার মতো অবস্থায় আমি থাকবো না, তাই আগেভাগে সেই পর্বটা সেরে নিচ্ছি।"
নিয়মিত মদ্যপান অতি ক্ষতিকর এক আসক্তি। যারা এমন করে তারা এর মাধ্যমে নিজের বিবেকের প্রতি অবিচার করে। বিবেককে পীড়িত করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পানকারী মস্তিষ্কে হালকা অনুভূতি লাভের জন্য এমন করে থাকে। দেখা যায়, অনেকে আবার এটা গ্রহণের মধ্যে নানা উপকারিতা খুঁজে বেড়ায়। সন্দেহ নেই এটার মধ্যে স্বল্প উপকারিতা আছে। কিন্তু সেই তুলনায় অপকারিতার মাত্রা বহুগুণ বেশি। যারা এইসব বিষয় নিয়ে জরিপ করেন বা গবেষণা করেন তাদের সেই তথ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরষ্পর বিরোধী। অত্যধিক মদ্যপান মস্তিষ্কের পক্ষে যে ক্ষতিকর, এবিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই।
সাধারণত শীতের দেশের বহু মানুষ নিয়মিত মদ্যপান করে থাকে। এটা তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ফেলেছে। এর জন্য কেউ পাপবোধে ভোগে না। কেউ ভুগলে বরং তাকে নিয়ে হাসাহাসি হতে পারে। ভারতবর্ষে কিংবা মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে এমন ছবি কম দেখা যায়, ঘটনা বরং উল্টো। এসব দেশে মাতাল হলে সামাজিক অবজ্ঞা, তিরস্কার জোটে। সাধারণ মানুষ এগুলোকে ভালোচোখে দেখে না। কোনো কোনো দেশে আবার কড়া সাজা দেওয়া হয়। মাতাল হওয়ার পর বহু মানুষ ঝগড়াঝাঁটি করে। অস্থিরতা তৈরি করে। বাল্যকালে আমি একজনকে জানতাম, যে এক পাঁড় মাতাল। এখন তার তিন ছেলের মধ্যে দু'জন ঐ পদে বহাল আছে। দেখেছি, রোজই মাতাল-পাণ্ডা মদ্যপান করতো। আর সপ্তাহে অন্তত একটা দিন পাড়ার তিনমাথার রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছেতাই ভাষায় বুলি কপচাতো। সে এক একদিন এক একজনকে গালিগালাজ করার জন্য বেছে নিতো। গ্রামে থাকতেন এক জনহিতৈষী, নিরীহ, ধৈর্যশীল ব্যক্তি। তার উদ্দেশ্যে কটুবাক্য ব্যবহার করা তার ফেবারিট ফ্যাশন ছিলো। এছাড়া অন্য নিরীহ লোকেরা বাদ যেতো না। ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ার ভয়ে তারা চুপ থাকতো। মামলা মোকদ্দমায় তার হাতযশ ছিলো, তাই ঘাঁটাতে যেতো না। গ্রামে এটা একপ্রকার অত্যাচারের মতো ছিলো। তার অশ্রাব্য বাক্য থেকে একদা জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু পর্যন্ত ছাড় পাননি। পাড়ায় এসব দৃশ্য দুর্লভ নয়।
মদ গেলার ধাত যাদের বেশ কড়া, তাদের রোজ এর স্বাদ চেখে দেখতে হয়। নতুবা তারা হয়তো স্বাদ ভুলে যাবে। কখনো এর স্বাদ তাদের কাছে বিস্বাদ মনে হয় কিনা, এখনো আমার জানা হয়নি। এমন এক কড়া ধাতের তরল-গ্রাহককে এখন হাজির করছি। জেনে নিই তার কাণ্ডকারখানার ধরন কেমন ছিলো।
এই মদ্যপ রোজই মদ গিলে বাড়ি ফিরতো। সে প্রায়ই এতো বেশি গিলে ফেলতো যে, গায়ের চাদর কিংবা জামা কোথায় যে পড়ে যেতো তার হুঁশ থাকতো না। এভাবে অনেকগুলো জামা ও চাদর হারিয়ে গেলো। ফলে বাড়িতে অশান্তি। একদিন স্ত্রী ভীষণ রেগে গেলে, সে প্রতিজ্ঞা করলো আর কখনো জামা বা চাদর হারিয়ে আসবে না। সেইমতো সেদিন বাড়ি হতে বের হওয়ার সময় নিজের গায়ের চাদর এমনভাবে গিঁট দিয়ে বেঁধে নিলো যাতে তুফান এলেও না খোলে। ঐদিন সে রাত না করে সন্ধ্যে সন্ধ্যে বাড়ি ফিরলো। স্ত্রীকে খুশির খবর দেবে। বাড়িতে ঢোকার সময় স্ত্রীকে শুনিয়ে চেঁচিয়ে বললো, "গিন্নি, এসে দেখে যাও, আজ আমি চাদর হারাইনি। তুমি শুধু শুধু আমাকে বকা দাও। আজ ভালো করে দেখো।" তার গিন্নি এসে সম্মুখের দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। সামলে নিয়ে গালে হাত ঠেকিয়ে বললো, "ও মা, একি! তোমার আজ কি অবস্থা! আজ চাদর হারাওনি ভালো কথা, কিন্তু তোমার লুঙ্গি কোথায়?"
এতক্ষণে সেই তরল-গ্রাহক আরো একটি রহস্য উদ্ধার করতে পারলো। কী কারণে, বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় যখনই কোনো নারীপুরুষ সামনে এসে পড়ছিলো, তারা সবাই কেমন চমকে চমকে উঠছিলো, এখন পরিস্কার হলো।
২.
আমার দেশে বিশেষত আমার রাজ্যে রাস্তার পাশে প্রায়শই কেউ না কেউ পড়ে আছে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে যায়। দেখতে দেখতে চোখ সওয়া হয়ে গেছে। এখন আর অতটা নাড়া দেয়না।
যখন ছোট ছিলাম, ওমন করে পড়ে থাকার মানে তখন বুঝতাম না। ভাবতাম, 'মানুষটা মরে গিয়ে রাস্তার ধারে পড়ে আছে কেন? আর কেন তার প্রতি কেউ ভ্রুক্ষেপ করছে না!' বড়ো অবাক লাগতো ও ফিরে ফিরে তাকাতাম। তখন জানতাম না মদ নামক কিছু পান করে রাস্তায় বা রাস্তার খাতে ওমন বিন্দাস শুয়ে থাকা যায়। নেশা ছুটে গেলে পরে অবশ্য এরা নিজ নিজ সাম্রাজ্যে সগর্বে প্রত্যাবর্তন করে। সেই ছোটবেলায় কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি তাই কেউ কিছু বলে দিয়ে আমার কৌতূহল নিবৃত্ত করেনি। খানিকটা বড়ো হয়ে যখন হাইস্কুলে পড়ছি, স্কুল যাওয়ার পথে একদিন পথচলতি দেখতে পেলাম ভালো শার্টপ্যান্ট পরা একজন 'আপনভোলা' রাস্তার পাশে উল্টে আছে। তার পা দু'খানা রাস্তার উঁচু দিকে ছড়িয়ে, আর মাথার দিক রাস্তার নিচু ঢালের দিকে গড়িয়ে। হাত দুটো 'হ্যান্ডস্ আপ' ভঙ্গিতে পড়ে আছে, গাল অল্প হাঁ করা। একহাতের মুঠোয় ধরা আছে একটি ছোট ব্যাগ, তাতে দোকান থেকে ক্রয় করা কিছু খাবার জাতীয় আছে বলে মনে হলো। মজা দেখতে ইতিমধ্যে আরও দু'একজন সেখানে হাজির। আমার অনুমান সঠিক প্রমাণ করে সেখানে দুটো কুকুর হাজির হলো। রাস্তার কুকুরের কাছে এমন ঘটনা এক মস্ত সুযোগ। মুহূর্তে তাদের একটি, যেটি পুরুষ কুকুর নয়, ব্যাগটি মুখে করে নিয়ে টানাটানি শুরু করলো। এতক্ষণে মনে হলো লোকটির অল্প সেন্স (চেতনা) রয়েছে। সে খানিক নড়েচড়ে উঠলো। কুকুরটা অল্প ঘাবড়ে গেলেও হতোদ্যম হলোনা। টানাটানি চললো। চোখ বোঁজা অবস্থায় লোকটি কথা জড়িয়ে উচ্চারণ করলো, "এ্যাই কে রে, এটা টানিস কেনো, তুই কি আমার বউ?" বলাবাহুল্য কুকুরটি একথায় কর্ণপাত করলো না। সে টান মেরে মুঠো থেকে ব্যাগটি ছিনিয়ে নিয়ে দুটোতে মিলে দৌড় দিলো। আমরা হাঁ করে ঘটনা দেখছি শুধু। অসহায় লোকটি বলে চলেছে, "কি সাহস, হাত থেকে কেড়ে নিলো। নির্ঘাৎ আমার বউ শয়তানি। এ্যাই বউ...দে বলছি...খাবারটা ছোটো খুকির জন্য এনিছি।" এরপর সেখানে কেউ আর অপেক্ষা করেনি, আমিও করিনি। নাটকের ক্লাইম্যাক্স পার হয়ে গেছে। করুণ এইসব পরিণতি দাঁড়িয়ে দেখার মতো শক্ত মন আমার কোনোকালে ছিলনা। ঘটনায় অযথা আমার মন ভারাক্রান্ত হয় এইজন্য যে, আমার তখন করার কিছু থাকে না।
এমন করুণ দৃশ্য আমি একাধিকবার দেখেছি। তার মধ্যে একটি এখন বলি। এটি দেখেছিলাম স্থানীয় বাজারে ঢোকার এক রাস্তার ধারে। অনেকসময় বাজারে ঢোকার ও বেরোনোর একাধিক রাস্তা থাকে। সেদিন বাজারে ঢুকলাম একটি রাস্তা দিয়ে। কাজ সেরে যথারীতি বের হয়ে আসছি অন্য একটি রাস্তা দিয়ে। এখানে চোখে পড়লো সেই দৃশ্য। বয়স খুব বেশি নয়, পঁয়ত্রিশ হবে এমন এক রোগা চেহারার যুবক অধিক পানের জন্য চিৎপটাং হয়ে একধারে পড়ে আছে। দেখি, একটি শাটারবন্ধ ডাক্তারখানার বারান্দায় ঠ্যাং ছড়িয়ে, যেমন থাকে আর কি। একটি আছে নিচু ঢালাই ফেলা রাস্তার কানায় আর অপরটি ডাক্তারখানার বারান্দার ওপর। হামেশা দেখে দেখে এই ব্যাপারটা চোখ-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু যা চোখ-সওয়া হয়নি তাহলো, পাশে বসে আছে একটি নিষ্পাপ শিশুপুত্র। তার হাতে একটি বাজারের থলি ধরা অবস্থায়, যা একদম খালি। একটি বোতামখোলা পুরানো জামা তার রোগাটে চেহারার ওপর বসানো। পরনে ময়লা হাফপ্যান্ট। সে বাবার পাশে বসে আছে, চোখ তার বাবার শরীরের উপর নিবদ্ধ, কখন বাবা হঁশ ফিরে উঠে দাঁড়ায় সেই ভরসায়। আমি হেঁটে ফিরছিলাম। ক্ষণিক থমকে দাঁড়ালাম। কিছু করার জন্য নয়। খানিক দেখবো বলে। ফিরে চলে আসার সময় একটা ভাবনা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো। সকালবেলা অবোধ শিশুটি টিফিন করেছে কি করেনি, আমি জানিনা। এই গুণধর পিতা তার নিজস্ব (অ)খাদ্য গলধঃকরণ করে নিজ পুত্রের সামনে কোন্ আদর্শ তুলে ধরছে ও এই পুত্রের কাছে কোন্ শ্রদ্ধাবোধ সে আশা করে? ছবিটা মনে পড়লে আজও মন ভারাক্রান্ত হয়।
এক গুণধর মাতালপ্রবর রাতের আঁধারে রাস্তার মাঝ বরাবর শুয়ে আছে। রাত্রির নিজস্ব নেশা এখনো শুরু হয়নি তথা গভীর রাত হতে তখনও বাকি। মাতাল সমাজের অপর এক সদস্য সেখান দিয়ে টলে টলে যেতে গিয়ে কিসে যেন ঠোক্কর খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। তারপর সামলে নিয়ে আবার দণ্ডায়মান হলো। সে বলে উঠলো, "এ্যাই কে রে, এখানে জায়গা দখল করেছিস, আমার এলাকায় পড়ে আছিস?" একথা শুনে 'গড়াগড়ি' মাতাল উত্তর দিলো, "শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছি ভাই। কত বড়ো আকাশ রে ভাই! তোর এলাকা মানে?" ঠোক্কর খাওয়া মাতাল একথায় ঠোক্কর না খেয়ে বলে, "তুই সরে যা ভাই। এ রাস্তার মালিক আমি। কালকেই আমি তোর মতো আর একজনের কাছ থেকে খুব সস্তায় কিনলুম।" গড়াগড়ি মাতাল ঘাবড়িয়ে না গিয়ে বললো,"ঠিক আছে ভাই, তুই নিচেরটা নে, আর আমি ওপরেরটা নি। কুছ পরোয়া নেই। আকাশের গায়ে তুই হাত দিবি না কিন্তু। ওটা তোর কাছ থেকে আজকে আমি কিনে নিলুম।" ঠোক্কর খাওয়া মাতাল এবার গড়াগড়ি মাতালের হাত ধরে তোলার চেষ্টা করে। "চল এখন বাড়ি যাই।"
মদ খাওয়ার জন্য মানুষকে সৃষ্টি করা হয়নি। যে মদ খায় এবং যে খায়না, সবাই জানে বা শুনেছে যে, অ্যালকোহল স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। অর্থ ধ্বংস করে। যাদের হয়তো পর্যাপ্ত অর্থ আছে, তাদেরও ধ্বংস হয়, সংসার। সেখানে থাকেনা পারস্পরিক মধুর শ্রদ্ধাবোধ। তারা যে জীবনযাপন করে তা মেকি। বাইরে থাকে চাকচিক্য, জৌলুস - ভিতরে ফাঁপা।
২০২০ সালের মার্চ মাসে, মুম্বাইয়ের এককালের রোমান্টিক হিরো ঋষি কাপুর ট্যুইটারে লিখলেন, "সরকারের উচিত, বৈধ মদের দোকানগুলি সন্ধের পর খুলে দেওয়া। নাহলে কিছু মানুষ অবসাদে ভুগতে পারে।" সবাই জানি, করোনা ভাইরাস আতঙ্কে এসময় দেশে লকডাউন চলছিলো। অতি ধনী ব্যক্তি ঋষি কাপুর আরো লিখলেন, "বৈধভাবে না পেয়ে অনেকেই অবৈধভাবে তা সংগ্রহ করবে।" সাধু কথা। ঘটনা নিশ্চয় এরূপ হয় সন্দেহ নেই। তবে এখান থেকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে এই মদের জন্য তার কত না সামাজিক চিন্তা! বোঝা যায় মদ্যপ ধনী মানুষের ভেতরটা ভরাট নয়। তাছাড়া আরও বোঝা যায়, পয়সা যাদের আছে (কিংবা ক্ষমতা) তারা অনেককিছু পেতে পারে, শুধু তাদের রাস্তা আলাদা। একদা রোমান্টিক হিরো 'ববি' খ্যাত ঋষি কাপুর এই সত্যের দিকে আমাদের ঈঙ্গিত করলেন। এর অল্পদিন পরেই তিনি ধরাধাম ছেড়ে অমৃতলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। শেষ জীবনে 'বোতলের' বন্দীদশা দেখে হয়তো বা তিনি ব্যথিত হয়েছিলেন। যদিও আমরা জানি, তিনি গুরুতর এক অসুখের বিরুদ্ধে কিছুদিন আগে লড়াই করছিলেন।
কোনো এক মাতালের অদ্ভুত এক শখ ছিলো। বড়লোক কিংবা ঐতিহাসিক মানুষদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র সম্পর্কে বেশ একপ্রকার মোহ ছিলো তার। তাই দেশ ঘুরে ঘুরে সে ঐতিহাসিক সামগ্রী দেখে বেড়াতো। একবার বোধহয় তরলের মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে যায়। সেবার ঘটেছিলো এই কেলেঙ্কারি। যাদুঘরে নবাব সিরাজদৌল্লার ব্যবহৃত সামগ্রী দেখতে দেখতে সে কেমন চঞ্চল হয়ে পড়ে। তারপর গিয়ে বসে পড়ে সিরাজদৌল্লার ব্যবহৃত এক চেয়ারে। সেখানকার রক্ষী হাঁ হাঁ উঠলো। বললো, "মশাই করেন কি! ওটা নবাব সিরাজদৌল্লার চেয়ার। বের হয়ে আসুন নইলে আমার চাকরি থাকবেনা।" একথায় মাতালের কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলো না। মাতাল বললো, "অসুবিধা কি? এখন তো খালি পড়ে আছে। সিরাজদৌল্লা এলেই সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে চলে যাবো।"
এমন বিভ্রাট মাতালরা প্রায়ই করে থাকে। অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। একবার একটি মিনিবাসে করে আমি কাজ সেরে বাড়ি ফিরছি। পথিমধ্যে এক স্টপেজ থেকে এক মাতাল বাসে উঠে পড়লো। ওঠার সময় অন্য প্যাসেঞ্জারের ভীড়ে কণ্ডাকটর তাকে যথাযথ খেয়াল করেনি। বাস চলার সাথে সাথে মাতালের দুলুনি শুরু হলো। এবার কাছাকাছি থাকা একজন প্যাসেঞ্জার আপত্তি করলেন। কণ্ডাকটর মাতালকে নামাতে চাইলে সে নামতে অস্বীকার করলো। মাতালের যুক্তি, "তুই নেমে চল, আমিও নামছি। তুই আগে নাম্।" তাকে বিষয়টি বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে দেখে অন্যেরা প্রতিবাদ করে উঠলো। মাতাল তখন অবস্থা বেগতিক দেখে নেমে গেলো, কণ্ডাকটরকে খানিক শাসানি দিয়ে।
এমন বিভ্রাট হয়তো নেশার ঘোরে নিজেদের অজান্তে তারা করে।
পুলিশের মধ্যে কর্তব্যের ভিত্তিতে নানা বিভাগ আছে। যেমন - ট্রাফিক পুলিশ,আবগারি পুলিশ, সশস্ত্র পুলিশ, স্থলপুলিশ, জলপুলিশ ইত্যাদি। আজ এই কাহিনী এমনই একপ্রকার পুলিশের এক্তিয়ার নিয়ে। জলপুলিশ কাজ করেন মূলত নদী, সমুদ্রের কাছাকাছি অংশে।
একবার এক মাতালকে নিয়ে কিছু স্থলপুলিশ জেরবার হলো। তাকে তাড়া করলে সে কেবল, এ গলি সে গলি দিয়ে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে লাগলো। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে মাতাল এক বুদ্ধি আঁটলো। সে রাস্তার ধারে এক বড়ো পুকুরে নেমে পড়লো। মওকা পেয়ে এবার পুলিশ তাকে ধরতে গেলে সে আইন নিয়ে কথা তুললো। বললো, "এখন আমাকে ধরার এক্তিয়ার তোমাদের নেই, আমি এখন জলপুলিশের আন্ডারে।" এমন কাণ্ড আমাদের কাছে হাসির ও তরল মনে হলেও তরল-গ্রাহকের কাছে এটা বাঁচার শেষ চেষ্টা। আইনের কথা সে শুনেছে তবে স্থান-কাল-পাত্র সম্পর্কে তার হয়তো তেমন হুঁশ ছিলোনা।
৩.
অনেকসময় হয় কি, মাতাল ব্যক্তি তার এই মাতাল হওয়ার সপক্ষে যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করে। নানা অজুহাত খাড়া করে থাকে বন্ধুমহলে। আবার পরিস্থিতি যখন তার বিপক্ষে যেতে থাকে তখন সে অসহায় বোধ করে ও আশেপাশে বোঝাতে চায় তার মাতাল হয়ে পড়ার কাহিনী। সহজ একটি উদাহরণ হাতের কাছে আছে।
এক সন্ধ্যায় কোনো এক 'যুক্তিবাদী' মাতাল নিজে গাড়ি চালিয়ে বাড়ির পথে ফিরছিলো। রাস্তায় একটি ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি আটকে গেলো। ড্রাইভার সিটের দিকে খোলা জানালা দিয়ে এক শীর্ণকায় ভিখিরি হাত পাতলো, "বাবু, খাওয়া হয়নি ক'দিন, কিছু দেন।" মাতাল তাকে আপাদমস্তক দেখলো। তারপর ভিখিরির কাছে জানতে চাইলো, "তুমি কি মদ খাও?"
ভিখিরি বললো, "না বাবু।"
"তাহলে সিগারেট খাও?"
"খাইনি বাবু।"
"সেকি! তাহলে নিশ্চয় জুয়া খেলো।"
"না বাবু, তাও খেলিনি।"
"তুমি এখনি আমার গাড়ির পিছনের সীটে বসো।"
"কিন্তু কেন বাবু, আমাকে দশটা টাকা দিলে চলে যেতুম।"
"দরকার আছে, এসে বসো। আমি আমার স্ত্রী'র কাছে আজ প্রমাণ করবো মদ, সিগারেট, জুয়া এসবের ধারেকাছে না গিয়ে একটা মানুষের কি অবস্থা হয়, সে নিজে চোখে দেখবে।"
নিজের পক্ষে অজুহাত জোগাড় করা এমন মাতাল আপন স্ত্রী'র কাছে নিজের বদভ্যাস বৈধ করতে চায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা বাড়িতে গঞ্জনার শিকার হয়ে এমন ছুতো খোঁজে। ঘ্যানঘ্যান করা বা দুষ্ট স্ত্রী'র হাত থেকে এরা পরিত্রাণ চায় বলে, দাবি করে। এরা সত্যসত্যই মানসিকভাবে দুর্বল। নতুবা ভিন্নপথ গ্রহণ না করে তারা এই সহজপথ বেছে নিয়ে বরং সাংসারিক পরিস্থিতি জটিল করে ফেলে।
প্রায় সকল দেশের তরল-গ্রাহকের ভাবভঙ্গির একটা মিল পাওয়া যায়। দেশে দেশে বিভিন্ন কিসিমের বিভিন্ন নামীদামি ব্রান্ড তাদের আকর্ষণের কেন্দ্রস্থল। রসিক সেসব চেখে দেখে। সেসবের মজা তাদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন। তাই মনপসন্দ রঙিন তরল সম্পর্কে যাবতীয় সার্টিফিকেট তাদের কাছে মজুদ থাকে। সহমর্মীদের কাছে তা তারা ব্যাখ্যা করে। আমার ধারণা সবান্ধবে, সগৌরবে সুরাপানের আসর বসানো ঐসব মাতাল বাবুদের সবচেয়ে আকর্ষক বিনোদন। কোনোভাবে সুরাসাগরে ডুব দিয়ে সবাই আচ্ছন্ন হয়, তাই বলে মাতলামি কিন্তু সবার মজ্জাগত নয়। তন্মধ্যে একটি বিশেষ শ্রেণী মাতলামির ভক্ত। এই প্রক্রিয়া তারা বাড়ির ভিতরে বা বাইরে সর্বত্র প্রদর্শন করে থাকে। শুধুমাত্র একছিপি গলায় ঢেলে তারা মাতলামি অভিযান শুরু করতে পারে।
২০১৯ সালের সংবাদ মাধ্যমের এক রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে দেখি, আমেরিকার নিউ ইয়র্কের এক ব্যক্তি হঠাৎ একটা সমস্যার সম্মুখীন হলেন। সেটা ২০১৪ সালের ঘটনা। ৪৬ বছর বয়সী ঐ ব্যক্তিকে পুলিশ একদিন রাস্তায় ধরলো নিয়ম-বহির্ভূত মদ্যপানের অভিযোগে। ব্রেথলাইজার টেষ্টে ধরা হলো তার মদ্যপানের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি। ভদ্রলোক কিন্তু বললেন তিনি আদৌ কোনো নেশার বস্তু নেননি। এইভাবে তিনটি বছর তিনি মাঝেমধ্যে অনুরূপ হেনস্থা হতে থাকেন। এবিষয়ে তার বাড়ির লোকজন পর্যন্ত দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অবশেষে এক চিকিৎসক এই জট কাটাতে সাহায্য করেন। এঘটনার আগে ২০১১ সালে একটি চিকিৎসার জন্য তাকে কিছু অ্যান্টিবায়োটিক নিতে হয়েছিলো। এরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। তার পাকস্থলীতে একপ্রকার ছত্রাক বাসা বাঁধে। সেই ছত্রাক খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা শর্করা খাবারকে অ্যালকোহলে পরিনত করতে থাকে। ফলে তার মধ্যে নেশার লক্ষণ ফুটে ওঠে। এটি অটোব্রিউয়ারি সিনড্রোম নামক একপ্রকার রোগ। যা ২০১৯ সালের নিরিখে বিগত ৩০ বছরে বিশ্বব্যাপী মাত্র ৫ জন রোগী পাওয়া গেছে।
মোদ্দাকথা হলো, মদ্যপান না করেও মাতাল বদনাম হতে পারে। এমন হলে দুঃখের শেষ থাকে না। দুনিয়াতে যুদ্ধবাজ, হত্যাকারী, জুলুমকারী যারা হয় তাদের বেশিরভাগ মদ্যপায়ী। নৃশংস গনহত্যাকারী বলে যাদের নাম সামনে এসেছে সবাই প্রায় মদ্যপ ছিলো। বর্তমান পৃথিবীর দিকে চোখ তুলে তাকালে কিংবা টুক্ করে গুগলে সার্চ দিলে হু হু করে নানা তথ্য বেরিয়ে পড়বে। সুতরাং এইপ্রকার নৃশংস মাতাল, সভ্যতার জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়।
'মাতালের কাণ্ড' বলতে যা বুঝি তার এক মজার উদাহরণ খুঁজে পেয়েছি। আমেরিকার ২৮ তম প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন একবার একটি গল্প শোনালেন। এক আসরে তিনি বললেন, "একদিন এক নৈশভোজে অতি সাধারণ এক ব্যক্তির সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। যিনি তিন তিনটি সম্মানসূচক ডিগ্রির মালিক। পরে এবিষয়ে খোঁজখবর করে আমার এক বন্ধু জানালো, তাকে তৃতীয় ডিগ্রি দেওয়া হয়েছিলো কারণ ইতিপূর্বে তার আরও দুটো ডিগ্রি আছে, সুতরাং তৃতীয়টি দিয়ে তার ডিগ্রিকে ওজনদার করা হয়েছে। দ্বিতীয় ডিগ্রি দেওয়া হয়েছিলো কারণ তার আগে একটি ডিগ্রি আছে তাই এটি দিয়ে মাত্র একটি ডিগ্রিকে ভারী করা হয়েছিলো। আর প্রথম ডিগ্রি দেওয়ার কারণ হলো, বেচারার একটিও ডিগ্রি ছিলো না তাই।"
এটা এইজন্য বললাম যে, "মাতাল" খেতাব পায়নি এমন কোন্ মানুষ এইপ্রকার ডিগ্রি দেবার কাণ্ডকারখানায় নিজেকে জড়াবে!
অনেক মাতাল আছে যারা আগের রাতে কি ঘটেছে সেসব বেমালুম ভুলে যায়। আশেপাশে কি ঘটে তার হদিস তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়না। তেমনই এক ঘটনা বলতে যাচ্ছি। একবার ছোট শহরের একটি বাড়িতে রাতের বেলা ডাকাত পড়লো। ঠিক পাশের বাড়ির প্রতিবেশী ছিলো এক মাতাল। পরদিন ঘটনার তদন্তকারী অফিসার এসে সেই মাতাল প্রতিবেশীকে জিগ্যেস করলেন, "গতরাতে আপনার পাশের বাড়িতে আপনি কোনোরকম আওয়াজ কিছু শুনেছেন?" এখন অবশ্য নেশা তার নেই, একদম স্বাভাবিক। সে উত্তর দিলো, "না স্যার, তেমন কিছু জানিনা। গতরাতে গোলাগুলির শব্দ, চেঁচামেচি আর ওবাড়ির কুকুরের চিৎকারে কিছু শুনতে পাইনি।" তদন্তকারী অফিসার আর কথা বাড়াননি। এরপর তার জানার কিছু বাকি থাকার কথা নয়।
অতিরিক্ত মদ্যপান, পানকারীর জন্য যেমন বিড়ম্বনা তেমন অনেক সময় সঙ্গদানকারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এই ব্যাপারটা খোলসা করি। কোনো একবার আমি একজন মাতালের পাল্লায় পড়ি। রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে বললো, "হেঁটে হিমালয়ে যেতে হাড়ে হিম ধরে যাবে। আমার গাড়িতে ওঠো।" নিমরাজি হয়ে তার গাড়িতে উঠে পড়লাম। ওঠার পর সে বললো, "জানো, আজ আমার ডোজটা একটু বেশি হয়ে গেছে।" একথা শুনে আমি প্রমাদ গুনলাম। গাড়ি কিছুক্ষণ ঠিকঠাক চললো। হঠাৎ দেখি গাড়ির গতি বাড়তে শুরু করেছে। আমি ভয় পেলাম। বললাম, "এটা কী হচ্ছে, এত তাড়াতাড়ি যাবার দরকার কি?" সে জবাব দেয়, "কিছু নয়, রাস্তা ফাঁকা।" আমি বলি, "সে হোক, রাস্তা ফাঁকা তাতে কী। অত জোরে চালানোর দরকার নেই।" উপকারী মাতাল এবার বলে, "দেখো আমি চেষ্টা করছি কমাতে, কিন্তু কেন জানি পারছি না।" কি সাংঘাতিক কথা! আমি ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখি সে অ্যাক্সিলেটরে চাপ কমিয়ে না দিয়ে বাড়িয়ে রেখেছে। উল্টো কাণ্ড যাকে বলে। এবার তাকে থামানোর দায়িত্ব আমাকে নিতে হয়। তরলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তাই বোঝা মুশকিল।
কর্তব্যরত একজন পুলিশ সার্জেন্ট একটি গাড়িকে মাঝরাতে মাঝরাস্তায় দাঁড় করালেন। পুলিশ অফিসার গাড়ির জানালার কাছে মুখ নামিয়ে বললেন, "মশাই ব্যাপারখানা কী! ভুল লেনে গিয়ে কেন গাড়ি ছোটাচ্ছেন? আজ বাড়ি ফিরতে পারবেন তো?" জানালার পাশে যে লোকটি বসেছিলো সে এবার জানালো, "স্যার, ভুল আমার হয়েছে। আজ একটু বেশি গলায় ঢেলে ফেলেছি তাই গাড়ি চালানোর মতো অবস্থায় আমি নেই।" অফিসার বললেন, "বেশ তো। আপনি পাবলিক কারে যেতে পারতেন। তাই বলে আনাড়ি স্ত্রীকে দিয়ে গাড়ি ড্রাইভিং করাবেন?" লোকটি বললো, "না, মানে ওকে আজ থেকে একটু ট্রেনিং দিয়ে নিচ্ছিলাম। ও আমার থেকে খেয়েছে কম।"
এপর্যন্ত লেখালেখির পর স্বীকার করে নিচ্ছি, তরল বড়ই উদ্বায়ী, সুতরাং এইপ্রকার যদি চালিয়ে যেতে থাকি তবে এর তল খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। এমন বহু রঙ্গ বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু এইবার আর নয়, রঙ্গ-তামাশায় ক্ষান্ত দিতে চাই। কারণ যত ঢালা হবে মুহূর্তে উবে যাবে। এই তরলের দাঁড়ি-কমা নেই। ভবিষ্যতে যদি ফাঁকফোকর পাই তবে আরও কিছু সরস উপাখ্যান হাজির করবো। একটি শেষ এবং করুণ কাহিনি বলার ইচ্ছা হচ্ছে তবে তার আগে আমার লেখায় উল্লেখ করা সেই মাতালের অনুকরণে আগেভাগে বিদায় চেয়ে নিচ্ছি কারণ আমার নিজের চোখে দেখা সেই ঘটনা লেখার পর আর বিদায় চাওয়ার সুযোগ পাবো না।
শেষপাতে মিষ্টিমুখ করার মতো কোনো প্রসঙ্গ ছাড়া একটি রঙ্গ এইস্থানে রেখে গেলাম। হ্যারি বলে একজন (হ্যারি পটার নয় কিন্তু) মদ খাওয়ার বারে বসে এত সময় কাটাতো যে তার স্ত্রী এই নিয়ে নিয়ত অভিযোগ করতো। স্ত্রী'র অভিযোগ ছিলো, হ্যারি তাকে অবহেলা করে নিজে ফূর্তি করে বেড়ায়। সেই হ্যারি একদিন ঠিক করলো, স্ত্রীকে সঙ্গে করে ঐ বারে সে নিয়ে যাবে। এই ভেবে যে তাতে হয়তো স্ত্রী খুশি হবে ও অভিযোগ কমাবে। বারে ঢুকে হ্যারি গদগদ ভাবে স্ত্রী'র কাছে জানতে চাইলো, "বলো, কেমন ড্রিঙ্ক তোমার জন্য নেবো, আজ এটা তোমার প্রথম।" তারপর স্ত্রী'র পাশে গিয়ে বসলো। স্ত্রী বললো, "ছাই, আমি কি জানি। তুমি যা নেবে আমাকেও তাই দেবে।"
"তাহলে এক কাজ করুন, দুটো 'বৃদ্ধ সন্ন্যাসী' আমাদের দিন।" পরিবেশনকারীকে হ্যারি অর্ডার দিলো। (ওল্ড মঙ্ক হলো একপ্রকার মদের নাম)।
একচুমুক চেখে দেখে তার স্ত্রী, "ওয়াক থুঃ, হায় ঈশ্বর! আমাকে তাড়াতাড়ি একটু জল দাও।" করতে থাকে। তারপর একটু সামলে উঠে বলে, "এই ভয়ংকর তরল তুমি কিভাবে গেলো?"
হ্যারি বিষন্নতা ভাব করে বলে, "তাহলে তুমিই বলো, আমি কি এখানে ভালো সময় কাটানোর জন্য আসি?"
আবার আগের প্রসঙ্গে যেখানে ছিলাম খেই ধরে সেখানে ফিরে যাই। আমি মফস্বলের যে জায়গায় বাস করছি তার থেকে আধা মাইলের মতো তফাতে একজন খুব দক্ষ টিভি মেকানিক ছিলো। এখন নেই। তখন এলাকার মধ্যে সে-ই সেরা। নাম ছিলো অসিত। সুদর্শন দেখতে। হাসিখুশি মুখ, দেখলে সবার ভালো লাগবে। বাইক নিয়ে যাতায়াত করতো যে সময়, বাইকের সংখ্যা সেসময় এতো পিঁপড়ার মতো ছিলো না। আমি তখন বেশ ছোট। এই সুদর্শন, সদা হাস্যময় টিভি মেকানিক বেশ দু'পয়সা উপার্জন করলো এবং ভালোবেসে বিয়ে সম্পন্ন করলো। যদিও তার ভাগ্যে পাত্রীর অভাব পড়তোনা। প্রায় দু'বছর পর হঠাত একদিন তাকে দেখে চমকে গেলুম। এতো ভালো একটি ছেলে ভ্যানরিক্সার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে আছে, জামার বোতাম কয়েকটা খোলা, আলুথালু। ভ্যানরিক্সা চলে যাচ্ছে বড়রাস্তা ধরে তার বাড়ির দিকে। স্বাভাবিকভাবে নিজ জ্ঞানমতে ব্যাপারটা অনুমান করলুম কিন্তু কৌতূহল নিবৃত্ত হলো না। পরিণতির কারণ অস্পষ্ট। পরে লোকমুখে যা শুনেছিলাম তা আমাকে অবাক করেনি ঠিকই তবে কষ্ট হয়েছিলো। সাংসারিক আবর্ত তাকে অল্পবয়সে হারিয়ে দিয়েছিলো। বিস্তারিত সেসব কথা বলার প্রয়োজন এখানে নেই।
© এবার নটে গাছটি মুড়ালো ...
N.B. প্রোফাইলে গিয়ে সার্চ করে আরও গল্প পড়ুন।