ধ্বংসের শেষ লগ্নে।
ধ্বংসের শেষ লগ্নে।
লোথাল শহরে পরিবার নিয়ে বসবাস করে সাবিত্রী। লোথাল প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার একটি উল্লেখযোগ্য বড়ো শহর৷ খুব পরিকল্পিত শহর লোথাল৷ কৃষিকাজ, ব্যাবসা-বানিজ্য সব দিক থেকেই উন্নত। বন্দরের সাহা্য্যে সুদূর পাশ্চাত্য গড়ে ওঠা শহর গুলির সঙ্গে বানিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে লোথালের মানুষ।
এই শহরের স্বাস্থ্য পরিসেবা ছিল বেশ উন্নত। শহরের মধ্যে ছিল একাধিক স্বস্থ্যকেন্দ্র। এই রকম একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সাবিত্রী ছিল একজন স্বাস্থ্যকর্মী। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ছিল বাড়ি থেকে একটু দুরে। রাত্রে ডিউটি পরলে ওকে থাকতে হতো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সন্ধ্যা নামার আগে বাড়ি থেকে রহনা দিতে হতো।
সাবিত্রীর স্বামী বাড়ির সামনে একটি শিক্ষাকেন্দ্রে নিযুক্ত ছিল শিক্ষাদানের কাজে। পরিবারিক কাজের দেখভাল বেশিরভাগ করতো সত্যবান। আড়াই বছর বয়স ওদের একমাত্র পুত্র নচিকেতা। আড়াই বছর বয়স থেকে নচিকেতা পিতার কোলে চেপে চলে যেত শিক্ষাকেন্দ্রে। শিক্ষাকেন্দ্রের মুক্ত অঙ্গনে আপন মনে খেলতো নচিকেতা। ছুটির পরে পিতার কোলে চেপে ফিরে আসতো বাড়িতে।
হরপ্পা, মোহেনজোদারো, রুপার, সুরকোটা বিভিন্ন শহর থেকে আসছে তখন অনবরত মহামারী সংক্রমনের খবর। লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে কলেরায়। ঠেকাতে পারছে না শহরগুলি সংক্রমণ।শহর গুলিতে মৃতদেহের সৎকার করা যাচ্ছে না সময়ে। ফলে মহামারী নিচ্ছে আরো ভয়ঙ্কর রূপ। শহরকে ঘিরে থাকা গ্রামগুলো মানুষশুণ্য হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে।
লোথাল শহরে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু পরিবারেসংক্রমণ হয়েছে। মূলত, যে সব পরিবারের লোকজন অন্যশহরে ব্যাবসা-বানিজ্য করতে গিয়েছিল সম্প্রতি শহরে ফিরেছে তাদের পরিবার গুলিতে সংক্রমণ ঘটেছে। সবদিক থেকে শহর শীল করে দেওয়া হয়েছে। বাইরে থেকে কোন মানুষকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না শহরে। স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি আসাযাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এখন আর বাড়ি ফিরতে পারে না সাবিত্রী। খবর পাই না স্বামী ও পুত্রের। লোথালেও ধীরে ধীরে বাড়ছে সংক্রমণ। মানুষ মারা যাচ্ছে। সাবিত্রী যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেখানেও উপচে পরছে রোগীতে। মরছে কাতারে কাতারে। সাবিত্রী মনে মনে ভাবছে গ্রাম গুলোর মতোই শহরটাও হয়ে যাবে জনশুণ্য।
একদিন খবর পেল পাশের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি আছে স্বামী ও পুত্র। রাস্তায়, পুকুরে সর্বত্র মৃতদেহ পড়ে আছে। ইচ্ছা থাকলেও যাওয়ার উপায় নেই সাবিত্রীর। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তার মারা যেতে শুরু করেছে। তাই স্বাস্থ্য পরিসেবা দেওয়ার লোক কমছে, রোগী বাড়ছে। বিনা পরিসেবায় মারা যাচ্ছে অর্ধেক মানুষ।
সাবিত্রীর স্বাস্থ্যকেন্দ্র ভরে গেছে মানুষের লাশে। সাবিত্রী ও একজন ডাক্তার বেঁচে আছে, বাকী সব স্বাস্থ্যকর্মী ঢলে পড়েছে মৃত্যুর কোলে।স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসছে না আর রোগী। রাস্তায়, বাড়িতে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আকাশ-বাতাস ভরে গেছে পঁচা লাশের গন্ধে।
আটদিন হোল আজ কোন খবর পাওয়া যায় নি স্বামী ও পুত্রের। নিজেকে আর ধরে রাখতে পরলো না সাবিত্রী। হাও-মাও করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বেড়িয়ে পড়লো রাস্তায় খোঁজ নিতে স্বামী ও পুত্রের। রাস্তায় মৃত, অর্ধমৃত মানুষ ডেঙিয়ে কিছুদুর গিয়ে আর এগোতে পারলো না সাবিত্রী।ফিরে এলো নিজের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ফিরে এসে দেখলো স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একমাত্র জীবিত ডাক্তার কলেরায় আক্রান্ত। ওর বসার রুমে বমি ও পায়খানায় ভেসে যাচ্ছে। কোথায় যাবে ঠিক করতে পারছে না, কি করবে স্থির করতে পারছে না সাবিত্রী।
উদভ্রান্তের মতো লাশ ডেঙিয়ে ডেঙিয়ে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক করার পর কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লো সাবিত্রী । জীবনকে তুচ্ছ করে আজ সে চলেছে প্রিয় জনের খোঁজ নিতে। যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সত্যবান ও নচিকেতা ভর্তি আছে একসময় সেখানে পৌছে গেল সাবিত্রী। সেখানেও শয়ে শয়ে লাশ পড়ে আছে। পঁচা লাশের গন্ধে ভরে আছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কেউ নেই জীবিত কার কাছে খবর নেবে ওদের। স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাজপত্র উল্টেপাল্টে দেখতে থাকলো আদৌ ওরা ভর্তি হয়েছিল, না খবরটা মিথ্যা ছিল। ওরা বাড়িতেই আছে। সাবিত্রী একবার ভাবছে বাড়ি গিয়ে দেখবে। আবার, ভাবছে বাড়ি গিয়ে যদি আর না আসতে পারে তাহলে তো শেষ দেখা দেখতে পাবে না। স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বেড়িয়ে কিছুদুর গিয়ে আবার ফিরে এলো সাবিত্রী।
সাবিত্রী লাশের ভিড়ে খুঁজতে থাকলো সত্যবান ও নচিকেতাকে। অনেকে দুরে দুরে সত্যবান ও নচিকেতার লাশ। মৃত্যুর সময়েও পুত্র বা পিতা কেউ কাউকে কাছে পায়নি। শেষ সময়েও সামনে থাকা কলিজার মুখ পর্যন্ত দেখতে পায়নি ওরা। চিৎকার করে বলে উঠলো পুরানের নচিকেতা মৃত্যুকে জয় করেছিল। তাই আমি শক করে তোমার নাম রেখেছিলাম নচিকেতা। তুমি পারলে না মৃত্যুকে জয় করে আমার কাছে ফিরে আসতে।
সিন্ধু সভ্যতার মৃতের শহর বা লোথালের শেষ জীবিত মানুষ সাবিত্রী পাগল হয়ে রাস্তায় বেড়িয়ে গেল অজানা ঠিকানায়।