Sutapa Roy

Tragedy

3  

Sutapa Roy

Tragedy

ছেঁড়া পাতা

ছেঁড়া পাতা

5 mins
312



আসামের তিনসুকিয়া থেকে মাইল পঞ্চাশেক দূরে গুঞ্জন টি এসটেট-এর ম‍্যানেজার হয়ে এল চিরাগ, সাথে চিরাগের স্ত্রী নিধি আর ছেলে আয়স। কলকাতায় আত্মীয় পরিজন ছেড়ে, এই নির্জনপুরীতে এসে ওদের সবারই মন খারাপ, কিন্তু কিছু করারও নেই, চাকরি বড় বালাই। চিরাগ টি-ম‍্যানেজমেন্ট পড়েছিল যখন, তখনই জানত, চায়ের গন্ধ মেখেই বাকী জীবন কাটাতে হবে, বরাত জোরে নিধি যে হাতছাড়া হয় নি, এই রক্ষে। দুজনেই স্কটিশচার্চ কলেজে বটানি অনার্সের স্টুডেন্ট ছিল, অনার্স পাশ করে চিরাগ টি-ম‍্যানেজমেন্ট পড়ল, আর নিধি বি.এড করল। চাকরি পাওয়ার একবছরেরমাথায় চিরাগ নিধিকে আরও আপন করে পেল, চিরবন্ধনে বাঁধা পড়ল তারা, তারপর আয়স এল, দেখতে

দেখতে ওর-ও দুবছর বয়স হয়ে গেল।


এর আগে চিরাগ সিকিমের টেমিটি টি গার্ডেনে ছিল, চা বাগানের সরল, সাধারণ জীবনযাত্রার মধ্যে ও শান্তি খুঁজে পায়, সকলের সঙ্গে সহজভাবে মিশেও যেতে পারে। আসামে যে অঞ্চলে চিরাগ এসেছে সেখানে বহিরাগতদের সঙ্গে স্থানীয় উলফা জনগোষ্ঠীর একটা ঝামেলা চোরাস্রোতের মত চলছে। তবু চাকরি বলে কথা, করতে তো তাকে হবেই; মিশুকে আর আমুদে চিরাগের মানাতে বিশেষ অসুবিধে হল না। চা-বাগানের কাছেই একটা ছোট্ট টিলার ওপর চিরাগের সুন্দর বাংলো, পাশের ঝিলে বাদি হাঁসেরা ঘুরে বেড়ায়, মাছরাঙা আর কোঁচ বক-ও মাঝে মাঝে দেখা যায়। বাগানে চা পাতা তুলতে আসা স্থানীয় মহিলাদের সাজগোজ-ও বেশ ভাল লাগে নিধির।

ওদের ঐ আটপৌড়ে গয়নাগুলোর দিকে তাকিয়ে নিধিভাবে, এ সমস্ত জিনিস কলকাতার শপিং মল থেকে ওরা কত কত টাকা দিয়ে কিনে আনে, এখানকার বাজার থেকে বাড়ি বা আত্মীয়পরিজনদের জন্য গিফ্ট হিসেবে এগুলো কিনে নিয়ে যাবে। ভাবনার ঘোর কাটল সানলির ডাকে, সানলির মা চা-বাগানে কাজ করে, বাগান থেকেই নিধির কাজকর্মের সাহায্যের জন্য সানলিকে পাঠিয়েছে, সারাদিন থাকে, বিকেলে বাড়ি চলে যায়;ছোট্ট আয়সের সঙ্গে ওর খুব ভাব, বছর আঠারোর সানলি আয়সের কাছে নিমেষে বাচ্ছা হয়ে যায়, ওদের ছুটোছুটিতে বাড়ি মাথায় ওঠে।


সেদিন এক অদ্ভুত কান্ড ঘটল, স্থানীয় কোন বিয়ে বাড়িতে মঙ্গল কুলো নিয়ে মেয়ের দল নাচতে নাচতে যাচ্ছিল; নিধি, সানলি আর আয়স ভাল করে দেখবে বলে রেলিং-এর ধারে জমা করা কতকগুলো সার সার ঠেসানো কাঠের গুঁড়ির ওপর উঠেছিল। বিভোর হয়ে ওদের নাচ দেখছিল, হঠাৎ নিধির পায়ের তলার গুঁড়িটা নড়ে উঠল,ও ছিটকে নেমে এল, সানলি আয়সের হাত ধরে একটা হ‍্যাচকা টানে নামিয়ে আনল। নিধির ভয়ার্ত চিৎকারে গেটম‍্যান ছুটে এল, "আরে ও তো অজগর"- নিশ্চলভাবে কাঠের গুঁড়ির ওপরে পড়েছিল, কেউ টের পায় নি। নিধি বারান্দায় আয়সকে জড়িয়ে ধরে

কাঁদছে, " আজ যদি বড়সড় একটা বিপদ ঘটে যেত।"

খবর পেয়ে ফরেস্টের লোকেরা ওটাকে কব্জা করে নিয়ে গেল। রাতে নিধি, চিরাগকে গোটা ঘটনাটা বলতে গিয়েওকাঁদছিল; চা-বাগানের সঙ্গে সহবাস করা সহজ কথা না,এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিপদ লুকিয়ে থাকে।


পরদিন নিধি শোবার ঘরের জানলা থেকে দেখল স্থানীয় কয়েকজন, গেটম‍্যান নন্দ গৌরকে কিসব জিজ্ঞেস করছে, লোকগুলোকে আগে কখনো দেখে নি নিধি। বিদেশ বিভুঁই জায়গা, কি যেন একটা আশঙ্কা দ‍্যাখা দেয় নিধির মনে, তার সবচেয়ে বেশী চিন্তা চিরাগকে নিয়ে।


চিরাগ চা- বাগান থেকে ফিরল, খানিকটা অন‍্যমনস্ক, নিধি খোঁজ করতে যেতেই চিরাগ মেজাজ হারাল, আয়স-ও ছুটে এল, কারণ ও বাবাকে কখনো রাগতে দ‍্যাখে নি। নিধি তাড়াতাড়ি গ্লাসে খাবার জল নিয়ে এল,

ফ‍্যানের স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে আলোটা নিভিয়ে দিল, চিরাগকে একটু একা থাকতে দিল।


খানিক বিশ্রাম নিয়ে চিরাগ নিধির কাছে এল, ওকে না বললেও তো হবে না, নিধির কাছে সমর্পণ ছাড়া তার উপায় কি, ওই তো দরকারে মায়ের মত স্নেহের আশ্রয়-ও

দেয়। চা-বাগানে বাঙালি, বিহারী শ্রমিক কম, স্থানীয় লোকেরাই বেশী, তাও ওরা চায় না অন‍্য কেউ এখানে কাজ করুক; তায় আবার মাথার ওপর একজন বাঙালি  ম‍্যানেজার, চিরাগকেও মেনে নিতে ওদের অসুবিধে হচ্ছে,

চিরাগ কেমন মানুষ, তাই নিয়ে ওদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। বাগান কর্তৃপক্ষ চিরাগকে আশ্বস্ত করছে, বলছে প্রথম প্রথম এরকম হবে, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।নিধি সকালে গেটম‍্যানের কাছে আসা অচেনা লোকগুলোর কথা বলল আর অনুরোধ করল এখানের চাকরি আর করার দরকার নেই, কলকাতায় ফিরে গিয়ে কিছু একটা ভাবা যাবে। চিরাগ কদিন ভাববার সময় চাইল।


এরপর চা-বাগানের পরিস্থিতি কদিন ঠিকই চলল,চান্দু মুড়া আর সুখেন গৌড়, যারা গন্ডগোলে নেতৃত্ব দিচ্ছিল, তারাও কদিন চুপচাপ। সানলি একদিন আব্দার করে নিধি আর আয়সকে ওদের গ্রাম দ‍েখাতে নিয়ে যাবে, আয়স-ও মেতে ওঠে; অগত‍্যা নিধি যায়, কিন্তু গিয়ে ওরমুগ্ধতা কাটতে চায় না। ওকে দেখতে সবাই জড়ো হল,নিধির আবদারে ওরা ওদের বিহু নাচ দ‍্যাখাতে রাজী হল।

কলকাতায় " নৃত‍্যমঞ্জরী"-তে অনেক বছরের তালিম আছে নিধির, সেও ওদের সঙ্গে পা মেলায়, এ নাচ নিধির শরীর, মনকে পুলকিত, শিহরিত করে, জীবনের সব সমস্যা যেন বহুদূরে সরে যায়, সমস্ত প্রাদেশিকতা, বিভেদের বেড়া ভেঙে এক অসীম তরঙ্গে ভেসে যায় সে। আয়সের ডাকে সম্বিত ফেরে, ক্ষিদে বা ঘুম কোন একটা কারণে আয়স বাড়ি ফেরার বায়না ধরে। সবাইকে বিদায় জানিয়ে নিধি বাড়ির পথ ধরে, বাড়ির ঠিক উল্টো দিকের সিগারেটের দোকানটায় আগের ওই অচেনা লোক দুটোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দ‍্যাখে; ওদেরকে না দেখতে পাওয়ার ভান করে আয়সকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়িতে ঢুকে যায়। ঘরে ঢুকে দ‍্যাখে চিরাগ অস্থিরভাবে পায়চারিকরছে, " কি হয়েছে সব ঠিক আছে তো?"- নিধি ঢুকতে ঢুকতে বলল। চিরাগের মুখচোখ লাল, বলল-"আমাকে সুখেন গৌড়-রা সাতদিন সময় দিয়েছে; বলেছে, এর মধ্যে 

জায়গা ছাড়তে, কিন্তু হেড অফিসের মিঃ হ‍্যারিসন বলছেন, এখানেই থাকতে, কিছু হবে না।"


রাতে খাওয়াদাওয়ার পর, নিধি রবি ঠাকুরের গান-"তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা" চালিয়ে দিল, এ গান, চিরাগের বড় প্রিয়, এ গান শুনলে ওর সব খারাপ লাগা কেটে যায়। আয়সকে ঘুম পাড়িয়ে সবে শুতে যাবে,দরজায় টোকা পড়ল, বেল না বাজিয়ে, এভাবে কে ডাকছে? আরে,- সানলির গলা। নিধি দরজা খুললে সানলি হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকে বলল,-" শিগগির তোমরা যা পারো জিনিস নিয়ে বেরিয়ে পড়ো, গ্রামে শুনে এলাম, আজ রাতে তোমাদের বাংলো ওরা জ্বালিয়ে দেবে।" চিরাগের মুখ ফ‍্যাকাসে, নিধিও ভরসা দেবার অবস্থায় নেই। ড্রাইভারকে ডেকে তুলল, হাতের কাছে যা পেল নিয়ে, ঘুমন্ত আয়সকে কোলে তুলে বাংলো ছাড়ল।

সানলি বারবার বলে দিয়েছে, স্থানীয় স্টেশনে না গিয়ে,দুটো স্টেশন পরে গিয়ে ট্রেন ধরতে। সানলির কথামতো ওরা তাই করল, গাড়িতে বসেই ট্রেনের টিকিট বুক করল।

এগিয়ে চলল, একটা বিধ্বস্ত পরিবার, পেছনে পড়ে রইল সব স্মৃতি, সানলি- ওদের গ্রাম, ঘর-গেরস্থালি। চিরাগের মনে একরাশ অভিমান, জাতিবিদ্বেষের কারণে, মানুষের অন্তরাত্মার খবর কেউ রাখল না। সে একা হলে এত সহজে মেনে নিত না, কিন্তু নিধি, আয়স; ওদের সে কিভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দেবে। স্বাধীনতার এতদিন পরেও কি এক হল গোটা ভারত, নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় চিরাগ আর নিধির মনে। ট্রেন চলেছে নিজের শহরের দিকে, জানলায় মাথা এলিয়ে চিরাগ, ঠিক যেন পরাজিত সৈনিক, তবে ফিরছে সে নিজের ঠিকানায়, যেখান থেকে আর তাকে তাড়া খেতে হবে না। চোখ বুজে আসে ক্লান্তিতে, নিধির ভরসার হাত তার কাঁধে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy