চার্জশীট
চার্জশীট
(ম্যানহাটন প্রোজেক্ট - নামটা সবার জানা। তবু কারোর যদি এখনই মনে না পড়ে, তাঁকে জানাই - এ হলো প্রথম পরমাণু বোমা আবিষ্কারের প্রোজেক্ট। আমেরিকায়, প্রায় হাজার খানেক বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানীর, দিন রাত এক করে, একটাই উদ্দেশ্যে প্রথমবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার - এক যুগান্তকারী প্রোজেক্ট। ১৯৪৫ এর ৬ই এবং ৯ই আগস্ট, জাপানের হিরোশিমা ও নাগাশাকি শহর দুটিতে, যে বোমাবর্ষণ হয়েছিলো - তা এই প্রোজেক্টেরই ফসল। জানেন নিশ্চয়ই - আমেরিকাতেই পরমাণু বোমা আবিস্কৃত হয়, আর সোভিয়েত রাশিয়ায় পাচার হয়ে যায় সেই ফর্মুলা, যার থেকে সহজেই তারাও পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলে। এ ছিলো, এখনও পর্যন্ত এই বিশ্বের - সর্বশ্রেষ্ঠ চরবৃত্তি দ্বারা প্রাপ্ত সাফল্য।
যাই হোক, ঐ প্রোজেক্টের সর্বময় অসামরিক কর্তা ছিলেন - জুলিয়াস রবার্ট ওপেন হাইমার। যিনি সেইসময় খ্যাত হয়েছিলেন 'অ্যাটম বোমার জনক' নামে। কিন্তু তিনিই আবার, পরে ঐ প্রোজেক্টের জন্যই - বিশ্বাসঘাতকতার চার্জশীট পান। তাঁর নামে মামলাও শুরু হয় - ১৯৫৪ সালে। আর তাঁর সেই কলঙ্ক মোচন হয়েছিলো অনেকদিন পরে।
এই ইন্টারভিউটা কাল্পনিক। যে এফবিআই কর্তা, তাঁকে বরাবর সন্দেহ করতেন এবং নিজের সন্দেহের তালিকায়, তাঁকে সর্বদা আগে রাখতেন - সেই কর্ণেল প্যাশের উত্তরসূরী, এডগার হুভারের দ্বারা ডঃ ওপেনহাইমারের ক্রস এগ্জামিনেশন কেমন হতে পারে, সেইটাই এখানে আলোচ্য বিষয়।)
স্থানঃ এ্যাটমিক এনার্জি কমিশন, ওয়াশিংটন, সদর দপ্তরের কনফারেন্স রুম।
সময়ঃ ডিসেম্বর, ১৯৫৩।
কর্ণেল হুভারঃ সুপ্রভাত ডক্টর।
ডঃ ওপেনহাইমারঃ সুপ্রভাত কর্ণেল। আপনি হঠাৎ আমার সাথে, এখানে এসে দেখা করতে চেয়েছেন বলে, জর্জি (জেনারেল মার্শাল) আমায় জানিয়েছিল। কি ব্যাপার বলুন তো?
কর্ণেলঃ ব্যাপারটা খুবই গুরুতর ডক্টর। আপনি কি জানেন - ম্যানহাটন প্রোজেক্টের কাজকর্মে বিস্তর অসঙ্গতি দেখা গেছে। সামরিক স্তরের না হলেও, এফবিআইয়ের চোখে - তা ভয়ঙ্কর অসামরিক অপরাধ।
ডক্টরঃ কিন্তু, জেনারেল গ্রোভস (লেসলী আর গ্রোভস) তো, বরাবরই আমার সাথে থেকেছেন এই প্রোজেক্টে। আমার দ্বারা কৃত কোনো কর্মই তো, তাঁর অজানা নয়!
কর্ণেলঃ আমায় ক্ষমা করবেন ডক্টর। স্বয়ং যুদ্ধসচিব সিমসন সাহেব, ডেকে এই তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিলেন কর্ণেল প্যাশকে। তিনিই এ দায়িত্ব বর্তমানে আমাকে দিয়েছেন। সে বোধ হয় আপনিও জানেন।
ডক্টরঃ ওকে, ঠিক আছে। বলুন, কি জানতে চান?
কর্ণেলঃ আপনি কি জানেন, ম্যানহাটন প্রজেক্টে যাঁরা যুক্ত ছিলেন - তাঁদের সবার জন্য, আগেই এফবিআই থেকে ক্লিয়ারেন্স নেওয়া হয়েছিলো?
ডক্টরঃ হ্যাঁ, সেটাই তো স্বাভাবিক।
কর্ণেলঃ কিন্তু, একজনের জন্য ঐ ক্লিয়ারেন্স নেওয়া হয়নি। যদিও তিনি, সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসীন ছিলেন।
ডক্টরঃ আপনি কি আমাকে ইঙ্গিত করছেন? কিন্তু, জেনারেল গ্রোভস তো সব খবর নিয়েই, আমায় নিয়োগের সুপারিশ করেছিলেন বলে জানতাম।
কর্ণেলঃ তিনি ছিলেন প্লেনিপোটেনশিয়াল মিলিটারী অথোরিটি। তাঁর কাউকে নিয়োগ করার জন্য, ক্লিয়ারেন্সের দরকার পড়তো না। এমনকি, এফবিআই নেগেটিভ রীপোর্ট দিলেও না।
ডক্টরঃ তো, আপনি বলতে চাইছেন - আমার সম্পর্কে এফবিআই নেগেটিভ রীপোর্ট দিয়েছিলো? বিংশ শতকের প্রথমার্ধের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা, রবার্ট জে ওপেনহাইমারকে সন্দেহ?
কর্ণেলঃ আপনি উত্তেজিত হবেন না ডক্টর। ও আপনার স্বভাব না। আপনার বিরুদ্ধে যে সমস্ত নথি এবং সাক্ষ্য প্রমাণ আমাদের কাছে আছে, তা আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না।
ডক্টরঃ তাই? তা আমার বিরুদ্ধে, কি অভিযোগ আপনাদের শুনি?
কর্ণেলঃ আপনি হাভার্ড থেকে গ্রাজুয়েশন করেন, পরে কেমব্রিজ হয়ে গোটেনগেন থেকে ডক্টরেট করেছেন পদার্থবিদ্যায়। এই প্রোজেক্টে যোগ দেবার আগে, বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। আপনার এই বায়োডাটায় - কি বিশেষ গুণ আপনি দেখাতে পারেন, যার জন্য ম্যানহাটন প্রোজেক্টের মত একটা অভূতপূর্ব গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ কর্মশালায়, আপনি অসামরিক সর্বময় কর্তা হতে পারেন? বিশ্ববিশ্রুত কয়েক হাজার বিজ্ঞানী, যাঁদের মধ্যে আবার শ'খানেক জন নোবেলজয়ী, তাঁদের মাথায় চড়ে ছড়ি ঘোরাতে পারেন?
ডক্টরঃ এসবের উত্তর জেনারেল গ্রোভস দিতে পারবেন। তিনিই আমায় নিয়োগপত্র পাইয়ে দিয়েছিলেন। তাঁকেই বরং জিজ্ঞাসা করুন না।
কর্ণেলঃ আপনি কি কমিউনিস্ট?
ডক্টরঃ কমিউনিস্ট ডক্ট্রিন আমায় প্রভাবিত করেছিলো একসময়। আমি কমিউনিস্ট মতাদর্শে একসময় গভীর বিশ্বাস রাখতাম।
কর্ণেলঃ এখন রাখেন না বুঝি?
ডক্টরঃ না, আমি বর্তমানে ডেমোক্রেসীর পূজারী।
কর্ণেলঃ আপনি তো কমিউনিস্ট পার্টীর ফাণ্ডে চাঁদাও দেন, তাই না?
ডক্টরঃ না, এখন দিইনা। আমি একসময় সক্রিয় কমিউনিস্টপন্থী ছিলাম। এসব তখনকার কথা।
কর্ণেলঃ তাই নাকি! আপনার স্ত্রীও শুনেছি ঘোর কমিউনিস্ট। তাঁর প্রাক্তন স্বামী জো ড্যালবার, যিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধে মারা যান, তিনিও তো শুনি কমিউনিস্ট নেতা ও কর্মকর্তা ছিলেন?
ডক্টরঃ হ্যাঁ, কিন্তু সে সব তো অতীত। আমরা সবাই বর্তমানে ডেমোক্রেসীর পূজারী।
কর্ণেলঃ আপনার ভাই ফ্র্যাঙ্ক ও তার স্ত্রী জ্যাকলিন...
ডক্টরঃ তারাও একসময় কমিউনিস্ট ছিলো। ঘোর কমিউনিস্ট। কিন্তু...
কর্ণেলঃ বর্তমানে ডেমোক্রেসীর পূজারী। তাই তো? ঠিক আছে, আপনি, তো পিপলস ওয়ার্লড ম্যাগাজিনেরও সভ্য ছিলেন, ছদ্মনামে সেখানে লেখালিখিও করতেন। আর পিপলস ওয়ার্লডের সভ্যরা কি ডেমোক্রেসিতে বিশ্বাস রাখেন, ডক্টর?
ডক্টরঃ ওসব অতীত। ম্যানহাটনে যোগ দেবার বছর চারেক আগেই, আমি ঐ সদস্যপদ ছেড়ে দিয়েছিলাম। কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ থেকে সরে, ডেমোক্রেসিতে আস্থা ফিরে পেয়েছিলাম।
কর্ণেলঃ আপনার মিস জিম ট্যাটলক কে নিশ্চয়ই মনে আছে? আপনার ছাত্রী ছিলেন বোধ হয়, আর কমিউনিস্ট আন্দোলনরতাও!
ডক্টরঃ হ্যাঁ।
কর্ণেলঃ গত জুন, ১৯৪৩ এ তিনি তাঁর টেলিগ্রাফ হিলের বাড়িতে আত্মহত্যা করেছেন। আপনি জানেন?
ডক্টরঃ হ্যাঁ, জানি।
কর্ণেলঃ তাহলে, আত্মহত্যার কারণটাও নিশ্চয়ই জানেন?
ডক্টরঃ তা কি করে জানবো?
কর্ণেলঃ জানবেন, কারণ, তার আগের দিন ১৩ই জুন রাত্রে, আপনি তার সাথে তার বাড়িতেই ছিলেন। ওখান থেকেই, এয়ারপোর্ট যান। সেখান থেকে ফ্লাইটে সানফ্রান্সিসকো। এর ঠিক পরের দিনই মিস ট্যাটলক আত্মহত্যা করলেন, কেন?
ডক্টরঃ আমি সত্যিই জানিনা - কেন সে, হঠাৎ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলো!
কর্ণেলঃ যার জন্য গিয়েছিলেন সেদিন সানফ্রান্সিসকো, সেই রোজি লোমানিট্জ, লস এ্যালামসে কি করছিলো তখন - আপনার জানা ছিলো?
ডক্টরঃ সবটা সঠিক জানা ছিলো না।
কর্ণেলঃ তবু, তার হয়ে ওকালতি করতে, দৌড়ে গেলেন এফবিআই সদর দফতরে? কি ভেবেছিলেন - জেনারেল গ্রোভসের নাম করে, আপনি তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন?
ডক্টরঃ আমি সেই উদ্দেশ্যে, জেনারেলের নাম নিইনি ওখানে।
কর্ণেলঃ আচ্ছা, তাই? বলুন তো, আপনার কথা অনুযায়ী - কমিউনিস্ট মতাদর্শ থেকে আপনি সরে গিয়েছিলেন, তবু কেন সব কনিউনিস্ট আন্দোলনকারীদের সঙ্গে, ঘুরে ফিরে আপনার নাম আসে?
ডক্টরঃ আমার এ বিষয়ে সত্যিই কিছু বলার নেই।
কর্ণেলঃ আপনি তো এফবিআইকেও ভুল পথে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন! জেনারেল গ্রোভসকে আপনি বলেছিলেন - রাশিয়ান এজেন্ট জর্জ এলটেনটন, পরমাণু বোমা আবিস্কারের সম্পর্কে, তথ্য সংগ্রহের জন্য একজন দালালকে পাঠিয়েছিলো। সে তিনজন বিজ্ঞানীর কাছে গিয়েছিলো প্রস্তাব নিয়ে, কিন্তু তিনজনই নাকচ করেন তার প্রস্তাব। সেই তিন বিজ্ঞানীর মধ্যে, একজন - আপনি। আর দালালটি নাকি - হেকেন শেভেলিয়র। বলুন এই তথ্য মিথ্যা নয়?
ডক্টরঃ শেভেলিয়র দালাল ছিল না।
কর্ণেলঃ তিনজন বিজ্ঞানীর কথাটাও সত্য না। ঠিক তো?
ডক্টরঃ হ্যাঁ।
কর্ণেলঃ তিনি আপনাকে কোন প্রস্তাবও দেননি, শুধু এলটেনটনকে দুজনেই চিনতেন এবং আপনাদের কথোপকথনে হয়তো, তার নাম এসে পড়েছিলো, কোনো কারণে। আপনি সেটাকেই দালালি বানিয়ে বলে - একজন নিরাপরাধ, বিদ্বান ব্যক্তির চরিত্র কালিমালিপ্ত করেছেন। আপনার এ সজ্ঞানে মিথ্যাচার নয়?
ডক্টরঃ হ্যাঁ, তার প্রতি আমি অন্যায় করেছি।
কর্ণেলঃ শুধু, তার প্রতি কেন ডক্টর? আপনি ভেবে দেখুন - অন্যায় করেছেন আপনি আরও অনেকের প্রতিই। ঐ কয়েক হাজার বিজ্ঞানীর, রক্ত জল করা অত পরিশ্রমের ফল, আপনার একার কৃতিত্ব বলে দেশময় প্রচার হয়েছে, আর আপনি তাকে সমর্থন করেছেন। আপনি বিনা দ্বিধায়, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনেরও নিন্দা এবং সমালোচনা করেছেন। আসলে - 'জাতীয় বীর', 'মেডেল অফ মেরিটে'র সম্মান নেবার সময় ভুলে গিয়েছিলেন - এ সম্মান আপনার একার প্রাপ্য নয়, আপনাদের প্রজেক্টের সমস্ত বিজ্ঞানীর হয়ে, আপনি শুধু তা গ্রহণ করেছিলেন। সম্মান তো এত পেলেন, কখনও মনে হলো না - তার কতটুকুর যোগ্য, আপনি হয়ে উঠতে পেরেছেন? তো, সমস্ত সাফল্যের কৃতিত্বের গর্ব - যদি আপনার একার হয়, তবে কৃত ভুলের দায়ভারও আপনারই। এই নিন আপনার বিরুদ্ধে চার্জশীট। অভিযোগ তো অনেক, তবু মনে রাখবেন - আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ বিশ্বাসঘাতকতার। আপনি, বিশ্বাসঘাতক!
ওপেনহাইমার স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন, কর্ণেল হুভার তাঁকে চার্জশীট ধরিয়ে দিয়ে, কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
।সমাপ্ত।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ আমার প্রিয় সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল)