বসিরহাট সংগ্রামপুর কালিবাড়ি
বসিরহাট সংগ্রামপুর কালিবাড়ি
ইচ্ছামতী নদীর তীরে সংগ্রামপুর কালিবাড়ি আজ এক দর্শনীয় স্থান। কিন্তু জানেন কি এর পিছনেও আছে এক প্রচীন ইতিহাস।বসিরহাটের সংগ্রামপুরের কালীমন্দিরটি ছ’শো বছরের পুরনো ইতিহাস আর নানা অলৌকিক ঘটনা সাক্ষী।
লোক কথা অনুযায়ী খুব জাগ্রত দক্ষিণা কালী মা। জনপ্রিয়তা দক্ষিণেশ্বরের কালী মতোই।এই মন্দির নির্মাণ জন্য জমি দিয়েছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন আসলে কৃষ্ণচন্দ্র। নৌবিহার সময় তিনি স্বপ্ন পেয়েছিলেন এখানে মা আছেন জঙ্গলের মধ্যে। এবং তিনি পরে মায়ের মন্দিরটি খুঁজে পান ভঙ্গপ্রায় আবস্হায়।সুপ্রাচীন এই মায়ের মন্দির আসলে প্রাচীন কালে রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল হয়তো । পরবর্তীকালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দ্বারা পুনর্নির্মিত হয়ে, তাঁর উদ্যোগে গ্রাম বাসীদের সহযোগিতায় ,এই কালী মন্দির স্থাপিত হয়। এবং তারও পরবর্তীকালে টাকির জমিদারের আরো সংস্কার করে।
তবে শুরুতে ছিল একটা খড়ের চাল দেওয়া মন্দির। আসলে সংগ্রাম পুর নামটা এসেছে হয়তো প্রতাপদিত্য আর আকবর সংগ্রামের কথা মাথায় রেখেই। আকবর দ্বারা পরাজিত হওয়া। মুসলিমদের প্রভাব বাড়ায়, মন্দিরটি অবহেলা শিকার হয়। তবে কৃষ্ণচন্দ্র রায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করে, সেবায়েত নিয়োজিত করে তো চলে গেলেন। এরপর এক চমৎকার ঘটনা ঘটে। এক মুসলিম ডাকত সরদার এই মন্দির দখল করলো। আর মায়ের পূজা দায়িত্ব নিলেন তিনি। তারপর তিনি নিখোঁজ হওয়ার পর, টাকি জমিদার সূর্যকান্ত এই মন্দির নির্মাণ করেন নতুন করে। তারপর ভক্তদের দানে ও মন্দিরের উন্নয়ন কমিটির সৌজন্যে আজ মন্দির সুনাম এখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এবং এটি একটি স্থাপত্য নিদর্শন হয়ে ওঠেছে।
কথিত আছে মা কালীর সামনে রাখা ঘটটি সংগ্রামপুরের জনৈক এক ব্যক্তির নিয়ে এসেছিলেন। আর এই ঘটকে অবলম্বন করেই এই মন্দির গড়ে ওঠে। কিন্তু অনেকের মত কৃষ্ণচন্দ্র এই ঘটটি পেয়েছিলেন। মন্দিরে মায়ের যে মূর্তিটা রয়েছে, তা কী দিয়ে তৈরি, কেউ জানেন না এখনও। এমনকী কে মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেন, তবে অনুমান করা হয় প্রতাপাদিত্য এর প্রতিষ্ঠাতা।
মন্দিরে নিত্য পুজো ও ভোগও ব্যবস্থা আছে । তবে কালীকে বিভিন্ন দিন বিভিন্ন রকম ভোগ নিবেদন করা হয়। যেমন লুচি, চিঁড়ে, ফল, খিচুড়ি,পায়েস ইত্যাদি। লোক বিশ্বাস অনুযায়ী এই মায়ের পুজো শুরু হলে এক মাইলের মধ্যে অন্য কোন কোনরকম পুজো করার নিদান নেই। লোক কথা অনুযায়ী এক ব্যবসায়ী সেই আদেশকে উপেক্ষা করে মন্দিরের এক মাইলের মধ্যে শ্যামা পূজার আরাধনা করেন। কিন্তু তারপর তিনি সর্বস্বান্ত হন। এখানে মাকে আমিষ ভোগও দেওয়া হয়। যেমন চিংড়ি মাছ ও কচু শাক। পাঁঠা বলি দিয়ে মাকে বলির কাঁচা মাংসও নিবেদন করা হয়। এখানে মায়ের পুজোতে বলি প্রথা চলে আসছে প্রায় ৬০০ বছর ধরে।বলি প্রথা হঠাৎ বন্ধ করে দিলে যদি মা ক্ষুব্ধ হন, যদি গ্রামবাসিদের কোন ক্ষতি হয় , সেই ভাবনাতেই আজও চলে কালী পুজোর দিন পাঁঠা বলির প্রথা।
প্রতাপদিত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু যুক্তি হিসেবে বলতে চাই।রাজা প্রতাপাদিত্যের বংশধর কৃষ্ণদাস রায়চৌধুরী টাকিতে বাস করতে এসেছিলেন। বর্তমান ইছামতি নদীর তখন ছিল যমুনা-ইছামতী। কৃষ্ণদাসের চেষ্টায় টাকি সম্ভ্রান্ত এবং ব্রাহ্মণ পরিবারের বাস শুরু করে। নন্দদুলালের বিগ্রহ স্থাপনের জন্য টাকিতে জালালপুর গ্রামের বেশ নামডাক হয়েছিল। রাজা মানসিংহ প্রতাপাদিত্যের সাম্রাজ্যে আক্রমণ জন্য টাকিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দু’পক্ষের লড়াই হয় বসিরহাটের সংগ্রামপুরে। প্রতাপাদিত্যের সৈন্যদলকে তাড়া করে মানসিংহের বাহিনী। টাকি শ্মশানের পাশ দিয়ে ইছামতী পার হয়ে রক্ষা পায় প্রতাপাদিত্যের দলবল। সেই ইতিহাসকে মনে রেখেই শ্মশান-সংলগ্ন রাস্তার নাম আজ মানসিংহ রোড। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে টাকি কুলেশ্বরী কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা হয়।