বৃত্তের বাইরে পর্ব সতেরো
বৃত্তের বাইরে পর্ব সতেরো
পর্ব সতেরো
বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা টোটো করে দুর্গাপুর স্টেশনে চলে এল সম্পাতি । এই স্টেশন বাস সট্যাণ্ড থেকে সকল স্থানে যাতায়াতের বাস পাওয়া যায় ।
টোটো থেকে নেমে চারিদিকে খুব ভালো করে দেখে নিল । তার মা নিশ্চয় শম্ভুদাকে পিছনে লেলিয়ে দিয়েছেন সে কোথায় যাচ্ছে লক্ষ্য করার জন্য ।
সাবধানী সম্পাতি আর ই ( বর্তমান এন আই টি ) কলেজে যাবার মিনিবাসে উঠে পড়ল ইচ্ছে করে । শম্ভুদা যেন জেনে যায় সে কলেজেই যাচ্ছে । কিন্তু চালাকি করে স্টেশন বাজার পেরিয়ে বাস থেকে নেমে পড়ল ।
সিটি সেন্টার, ভিরিঙ্গি, বা আসানসোল যাবার সকল বাস এই পথেই চলে । অপেক্ষা করতে লাগল তেমন কোন গাড়ির জন্য । অল্পকালের মধ্যে পেয়েও গেল ভীড়ে ঠাসা একটা আসানসোলগামী বাস । কোনমতে আড়াআড়ি শরীর রেখে চেপে গেল বাসটায় ।
মিনিট পনের লাগবে সিটি সেন্টারে পৌঁছাতে। এইটুকু সময় কষ্ট হলেও সহ্য করে নিল । সিটী সেন্টারেই রাজদীপ লাহার ' মাঙ্গলিকী' । সকাল এগারোটা বাজে - সম্পাতি জানে দশটায় খুলে যায় প্রতিষ্ঠান ।
সিটি সেন্টারে নেমে হাঁটতে শুরু করল । স্টেট ব্যাঙ্কের এ টি এম কিয়স্ক পেরিয়ে ডানদিকের সরু পথ ধরে এগিয়ে চলল। তারপর এচ ডি এফ সি ব্যাঙ্ক, বিগবাজারের সীমা ছাড়িয়ে ঠিক বামদিকের লেনে ঢুকে পড়ল । সামনেই মাঙ্গলিকী ।
বহু আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন বুকে নিয়ে যখন মাঙ্গলিকীর সম্মুখে এসে দাঁড়াল ; দেখে সাটার বন্ধ । অবাক হয় ; আজ তো সোম বার নয় , তথাপি প্রতিষ্ঠান বন্ধ কেন !
পাশের একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল গত পরশুদিন রাজদীপের বাবা হার্ট অ্যাটাকে গত হয়েছেন । সেই কারণে দোকান বন্ধ আছে ।
বুকের মধ্যে যেন বন্দে ভারত এক্সপ্রেস পেরিয়ে গেল । সর্বনাশ ! এর অর্থ নিশ্চয় তাকেই জড়িয়ে ঘটনাটা ঘটে গেছে । তবুও ভাবল এমন একটা দু: সংবাদ কেন রাজদীপ তাকে দিল না । কতবার ফোন করেছে সে ।
আবার তার মনে হল হয়তো শ্মশানে ছিল ফোনের কথা মনেই পড়েনি । যাই হোক সম্পাতি ভাবল খবর যখন পাওয়া গেল তখন তার বাড়ি গিয়ে দেখা করা উচিৎ।
পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল তার বাবার কথা । মায়ের মুখ । যদি জানতে পারেন তবে এ'রকম বিপদে সেও তো পড়ে যাবে । নিজেকে বড় অসহায় বোধ করল সে । এদিকে সেদিকে দেখে নিয়ে আবার হাঁটতে আরম্ভ করল ।
বিপদ যে কোথায় লুকিয়ে থাকে প্রাণীমাত্রেই তার আন্দাজ করতে পারে না । সম্পাতি বাস স্ট্যাণ্ডে এসে বাড়ি ফেরার মনস্থ করল । রাজদীপের বাড়ি সে জানে । সিটি সেন্টারেই সুনীতি চাটুজ্যে লেনের প্রথমের বাড়িখানা তাদেরই।
যাওয়া ঠিক হবে কি হবে না সিদ্ধান্ত তো একটা নিতেই হয়, কিন্তু এই সময়ে সম্পাতি সে বোধ থেকে বিরত থাকল । বেশী করে বিভূতিভূষণের মুখখানা ভেসে উঠতেই সে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে স্টেশনের বাসে উঠে বসল ।
ন্যাশনাল হাইওয়ে পেরোতে বাস যখন হাইওয়ের উড়ালপুলে উঠছে সম্পাতি পিছন ফিরতেই দেখতে পেল শম্ভুকে । তখনই যেন তার হোশ উড়ে গেল । চোখাচোখি হয়নি । তাই দেখেও না দেখার ভান করে বসে রইল ।
শম্ভুকে নির্দেশ দেওয়া ছিল সম্পাতিকে দূরত্ব রেখে ফলো করার কিন্তু যেহেতু সম্পাতি বাসে করে এসেছে ; শম্ভুর পক্ষে দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়নি । সামনের সিটে সম্পাতিকে দেখতে পাচ্ছে শম্ভু । কোন কথা বলছে না । সম্পাতি আরেক বার পিছন ফিরে চাইল । শম্ভুদাই তো !
না ! কোন ভুল দেখেনি সে । শম্ভু কোন কথা বলছে না দেখে ভয় পেল । সে তো তার যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ দেখে নিয়েছে ! এমনকি পাশের দোকান থেকে রাজদীপের খবর নেওয়া - সব তো শুনেছে নিশ্চয় ।
সম্পাতির পাশের সিটটা খালি হতেই শম্ভু তার সিট ছেড়ে ওই সিটে এসে বসল । চিন্তার রাজ্যে বিচরণরতা সম্পাতি খেয়াল করেনি শম্ভুদা ঠিক তার পাশেই বসে পড়েছে ।
কি মনে করে পিছনের দিকে আরেক বার চেয়ে দেখল । শম্ভুদা নেই । কি ব্যাপার ! এই তো বসেছিল - গেল কোথায়? তবে কি নেমে গেল ! যাক বাবা ভালো হয়েছে।
পাশ থেকে শম্ভু বলল - দিদিমণি ?
সম্পাতি পাশে থাকা শম্ভুকে বলল - ও শম্ভুদা ! তুমি কোথায় গিয়েছিলে ?
- আগে তুমি বল - তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
সম্পাতি রেড-হ্যাণ্ডেড ধরা পড়ে গেছে । শম্ভুদাকে লুকানোর অর্থ বাড়ি গিয়ে শম্ভুদা সব সত্যি ঘটনা বলে দেবে । হয়তো আরও রঙ চড়িয়ে বলবে ।
তার চেয়ে এখানেই একটা রফা করে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে । সম্পাতি জানে শম্ভুর আর্থিক অবস্থা একদমই ভালো নয় । মায়ের পুরাতন শাড়ি, চাদর সবকিছু হাসিমুখে চেয়ে নিয়ে যায় । মাও অনেক সময় দামী কাপড়গুলো দিয়ে দেন ।
তার বাবা বিভূতিষণের অত্যন্ত প্রিয় জন শম্ভুদা । প্রিয়পাত্র হবার কারণ অবশ্যই শম্ভুদার নি:শর্ত আত্মনিবেদন । তাদের পরিবারের প্রতি আনুগত্য এবং নিয়মানুবর্তিতা - এই দ্বিমুখী তিরের ফলায় বাবাকে বিদ্ধ করে রেখেছে শম্ভুদা । বাবার প্রিয় মানেই তো মায়েরও স্নেহভাজন হওয়া । অতএব সম্পাতিও ঠিক করে নিল যেনতেন প্রকারে শম্ভুকে হাত করা ।
হাতের পার্শ খুলে একটা দু'হাজার টাকার নোট বের করে শম্ভুর হাতে দিয়ে বলল - শম্ভুদা ! এটা রাখো । তোমার ছেলেকে একটা সাইকেল কিনে দিও ।
শম্ভু একফোঁটাও অবাক হল না । বুঝতে পারল দিদিমণি ঘুষ দিয়ে তার মুখ বন্ধ করতে চাইছে । ম্যাডাম যে তাকে ফলো করতে নির্দেশ দিয়েছেন সে তো আর এমনি নয়; দস্তুরমত তার নিকট জবাবদিহি চাইবেন ।
অতএব ঘুষ নেওয়া থেকে বিরত থাকাই যুক্তিযুক্ত ভেবে শম্ভু বলল - দিদিমণি! কোথায় গেছিলে বললে না তো?
সম্পাতি বুঝতে পারল একে এভাবে হাত করা যাবে না । তাই কোন রাখঢাক না রেখেই উল্টো শম্ভুকে প্রশ্ন করল - তোমাকে গোয়েন্দাগিরি করতে কে পাঠিয়েছে - মা নাকি বাবা ?
- দেখ দিদিমণি, কেউ তো নিশ্চয় পাঠিয়েছেন, নইলে শুধু শুধু তোমাকে ফলো করতে গেছি কখনও? তবে তুমি কলেজে যাচ্ছ বলে এখানে আসবে লাহা বাবুর সঙ্গে দেখা করতে আমিও ভাবিনি । ম্যাডামকে তো এটা বলতেই হবে । এটা তুমি ঠিক করলে না দিদিমণি । তবে......
- তবে কি শম্ভুদা ?
- আমাকে যদি তোমার মনের কথা বলে দাও তবে ভেবে দেখতে পারি । তার জন্য ঘুষ দেবার প্রয়োজন আছে কি ?
সম্পাতি চিন্তায় পড়ে গেল । শম্ভুদা তার বাবা-মার প্রতি যতখানি দায়িত্বশীল , তার উপর কিয়দংশ থাকলেও ভালো হত ।
বলল - তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি শম্ভুদা !
- অবশ্যই। যতই হোক আমি তোমাদের বাড়ির ড্রাইভার । তোমাদের নুন খাই । কি করে বিশ্বাসভঙ্গ করি বল তো ! বয়সে তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোটো । দাদা বলে ডাকছ আর এখন আমাকেই বিশ্বাস করতে পারছ না ?
- আমি সে কথা বলছি না শম্ভুদা । আসলে আমি রাজদীপকে ভীষণ ভালোবাসি। রাজদীপও তাই । আমরা চাই নিজেদেরকে কাছে পেতে । তাই....
শম্ভু একটু উত্তেজিত হয়ে বলল - তাহলে কাল গোপালপুরে গেছিলে কেন ? জেনেছি তুমিও সেখানে তোমার মত জানিয়ে দিয়েছ । বোনটি ! জীবনটা ছেলেখেলা নয় । আমাকেই দেখ না- আমি আমার ব্যক্তিগত সাধ-আহ্লাদের কথা ভাবিই না । শুধু সংসার করেছি বলে দায়বদ্ধ হয়ে তোমাদের কাছে নিজেকে একরকম বিকিয়ে দিয়েছি ।
সম্পাতি জানে শম্ভুদা জ্ঞান দিতে শুরু করলে আর থামে না । সেইজন্য অঙ্কুরেই তা' বিনাশ করে দিতে অনুরোধ করল সে যেন বাড়িতে বলে দিদিমণি সত্যি সত্যিই কলেজে গেছল ।
শম্ভুর যেন জোঁকের মুখে চুণ পড়ল । বোবার গুড় খাওয়ার মত কিছু বলতে পারল না ।
সম্পাতি বলল - বলবে না তো ?
শম্ভু বলল - আগে বাড়ি চল । তারপর ভেবে দেখব । মিথ্যে বলায় অভ্যস্ত নই তো !
সম্পাতি বুঝে গেল তার আসন্ন বিপদের কথা ।
( চলবে )