বিহিত
বিহিত
জঙ্গলে আজ একটা অলিখিত সভা বসেছে,- অলিখিত এ কারণে, পশুরাজ যাকে ঘোষণার দায়িত্ব দিয়েছিল সেই জাম্বুমান মহুয়া বন দিয়ে যেতে গিয়ে মহুয়ারস খেয়ে জঙ্গলেই গাঢ় নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। শেষে পশুরাজহাতের কাছে ছোট নেংটিকে পেয়ে তাকেই ধরিয়েছে পয়গাম, ফলে যা হবার তাই হয়েছে, অনেকেই ঠিকমতো খবর না পেয়ে আসতে পারে নি। সঠিক সংখ্যার অনুপাতে ভোটাভুটি না হওয়ায় তা বিধিসম্মত কিনা তাই নিয়ে সামান্য উত্তেজনা দেখা গেলেও বিষয়টা গুরুগম্ভীর।
তাই সবার মুখ থমথমে,-গতমাসে বনে দাবানলের আগুন ছড়ানোয় ওদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে। পশুরাজেরদুই ভাই,হাতি দাদার দুই দিদি, ভালুক ভাইয়ের চার বোন,বাঘ মামার তিন বন্ধু,-এ ছাড়াও আরও অনেকে মারা পড়েছে। সভার প্রথমে মৃত পশু ভাইবোনেদের জন্য একমিনিট নীরবতা পালন করা হল, আলোচ্য বিষয়টা জরুরী
হওয়ায় বিধিমত সভা বসে গেল। আগুনের ফুলকি প্রথম কে কিভাবে দেখেছিল তাদেরকে একে একে ডাকা হল। প্রথমে শুঁড় দুলিয়ে এল মোটা হাতি,বলল-"তখন আমি জল কেলি করছিলাম, বনের শেষপ্রান্তে যে শালের জঙ্গলটা আছে ওখান থেকে দেখলাম ফুলকিগুলো উঠে ছড়িয়ে পড়ল।"এবারে লম্বা গলা হেলিয়ে এল বড় জিরাফ,-হাঁক ছেড়ে বলল-"আমিই তো লম্বা পায়ে দৌড়ে সবাইকে খবর দিলাম, তার আগেই অনেকের গায়ে আগুন ধরে গেছিল।" চিকণ হরিণ বলল-"ওই শালের জঙ্গলে আমি কয়েকজন মানুষকে দেখেছিলাম,-ওরা মনে হয় ওখানে রান্নাবান্না করছিল।"পশুরাজ মাথা নেড়েবলল-"ওই মানুষই তো যত নষ্টের গোড়া, কী যে ভাবে নিজেদেরকে, পৃথিবীতে যেন শুধু ওরাই থাকবে।"
এতসবের মধ্যে ভালুক ভায়া গম্ভীরভাবে বলল-"ওই মানুষগুলো তো জঙ্গলে গাছ কেটে কাঠ চুরি করতে আসে।"-এতক্ষণে বাঘমামা গর্জন করে উঠল-"গাছ যে কত উপকারী, তা কি ওরা জানে না?একদিন কটাকে সাবাড় করে মজা দেখাব।"শেয়াল বলে উঠল-"ওরা তো তোমাকেও রেয়াত করে না, পিটিয়ে মেরে দেয়।" নেংটিসুযোগ পেয়ে বলল-"আমি মাটির তলায় লুকিয়ে সব দেখেছি, মানুষগুলো ইচ্ছে করে জঙ্গলে আগুন লাগিয়েছে, জঙ্গল শেষের বড় রাস্তায় অনেক যন্ত্রপাতি জড়ো করেছে, এখানে কিছু বানাবে মনে হয়, জঙ্গল আর রাখবে না।" পশুরাজ সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল-"জঙ্গল আর রাখবে না মানে কী, আমরা কি ওদের অনুমতি নিয়ে জঙ্গলে বাস করছি?"-সকলে সমস্বরে বলে ওঠে "না"-পশুরাজ আবার বলতে শুরু করে-"পৃথিবীতে আমরা ওদের অনেক আগে এসেছি, এখন এভাবে আমাদের জায়গা দখল করলে চলবে, সব জঙ্গল যদি দখল হয়ে যায় আমরা যাব কোথায়?"সবাই বলল,-"তাহলে কী করা যায়?" ভালুক বলল-"ওরা যাতে জঙ্গলে ঢুকতে না পারে তার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করতে হবে।" নতুন কোন উপায় বাতলানোর সম্ভাবনায় সবাই শেয়ালকে এগিয়ে দিল। শেয়ালও হুক্কা হুয়া ডাক ছেড়ে পশুরাজের কাছাকাছি এসে বসে বলল-"হনুমানরা বেলগাছের শক্ত বেল নিয়ে জঙ্গলে মানুষকে ঢুকতে দেখলেই গাছের ওপর থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারবে, তাতেও যদি কাজ না হয় হাতিরা শুঁড়ে করে আছড়াবে, এরপর থাকবে বুনো মোষ, গন্ডার- ওরা শিঙের খেলা দেখাবে।
তারপর থাকবে ভালুক, নেকড়ে, বাঘ আর সবশেষে পশুরাজ।" পশুরাজ কেশর ঝাঁকিয়ে বলল-"এতে মানুষের গুলিতে কেউ কেউ মারা পড়তে পারে, যারা মারাপড়বে তারা শহীদের মর্যাদা পাবে। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবগুলো গৃহীত হল ও সেইমতো পরদিন থেকেই জঙ্গল পাহারায় নেমে পড়ল ওই জঙ্গলের পুরো পশুসমাজ। ওদের শুভকামনা জানাতেই হয়, কারণ ওদের দাবীগুলো নেহাৎ অন্যায্য নয়।