বেঁচে থাক শৈশব
বেঁচে থাক শৈশব
"স্বপ্ন দেখতে এখনো ইচ্ছে করে, স্বপ্নটা বেঁচে থাক-
ফিরে দেখা বড়ো কষ্টের বন্ধু, নতুনকে আজ স্বাগত জানানো যাক।"
হঠাৎ স্বামীর ডাকে চটকা ভাঙে সরমাদেবীর। খেয়েদেয়েই বেরিয়ে পড়েছিলেন ছেলে-বউমার বাড়ির উদ্দেশ্যে। প্রতিদিনের প্রিয় দুপুরের ভাতঘুমটা মিস হয়ে গেছে, তাই বাসেই চোখ বুজে আমেজটুকু নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। যা হতচ্ছাড়া রাস্তা, শান্তিতে চোখ বোজার উপায় আছে নাকি! কোথায় নিশ্চিন্ত হয়ে দিব্যি চোখ বুজবেন আর খুলেই দেখবেন গন্তব্যে চলে এসেছেন, তা না, বাস চলেছে ঘটর ঘটর করতে করতে। একবার এদিকে হেলে তো পরক্ষণেই উলটোদিকে। ডাঙাতেই নৌকাবিহার যেন! তার ওপর আবার মাঝে সাঝেই তাঁর সিটটার নীচের থেকেই ঘুটঘুট আওয়াজ আসতে লাগল। আগেও তো বহুবার বাসে চেপেছেন, এমন তো হয়নি। তবে কি সিটের তলায় কেউ বদমতলবে ঢুকে বসে আছে? ব্যস, যেই না এই কথাটি মাথায় ঢোকা, সরমাদেবী তো ভয়ে কাঠ। স্বামী বসেছিলেন একটু দূরে। একবার সাহস করে ডেকেই ফেললেন,” ওগো শুনছ, আমার সিটটার তলায় কে জানি ঢুকেছে, একটু দেখো না!” চারদিক থেকে খুকখুক হাসির আওয়াজ শুনে বোঝেন প্রশ্নটা বোধহয় করা উচিত হয়নি। দেখেন কর্তা তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকেই। চোখ দিয়েই পারলে ছাই করে দেন। অগত্যা আবার ফুটো বেলুনের মতন চুপসে গিয়ে হেলান দিলেন সিটে। অস্বস্তি লাগছিল। তবে বাসের কন্ডাক্টর ছোকরা ভালো, অবস্থা বুঝে নিজেই এসে বলল, “ও কিছু নয় মাসিমা, পুরোনো বাস তো, মেনটেন করা হয়ে ওঠেনা সব, তাই এই রাস্তায় একটু আওয়াজ করছে। সামনের কালীতলার মোড়টা পেরোতে দিন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।” বুঝলেন সরমাদেবী। বুঝে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তাঁর এই তিল থেকে তাল করার স্বভাবের জন্যেই কতবার যে বর আর ছেলের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। একবার একটা রেস্তোরাঁতে গিয়েছেন খেতে। ছেলের তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে,তার বউয়ের মুখে আবার সাহেবি খাবার ছাড়া কিছু রোচে না। তা সেবার বউমার সাধ জেগেছে, ইন্ডিয়ান কারি খাবে। তা খাবে খাবে, নিজেই কুটনো কুটে বাটনা বেটে চাট্টি মাছের ঝোল কি পাঁচমিশালী তরকারি করে দিতে চেয়েছিলেন সরমাদেবী। হাজার হোক বউমা বলে কথা। ও বাবা, কর্তাকে দিয়ে সকালে বাজার করিয়ে আনলেন, ইচ্ছে, সন্ধ্যেটা হয়ে গেলে সব নিজের হাতে রান্না করবেন। তা সাতটা বাজতে না বাজতেই ছেলে এসে তাড়া দিতে লাগল।
-ও মা, যাবে না নাকি?
-কোথায় যাব রে?
-তোমার বউমাকে ইন্ডিয়ান কারি খাওয়াতে হবে তো। চলো তাড়াতাড়ি না গেলে আবার এই রেস্তোরাঁটায় সিট পাওয়া যায় না।
-অ্যাঁ?
-কি হলো?
-কি বলিস রে তুই অপু? নতুন বউ, তার ইন্ডিয়ান কারি খাবার সাধ হয়েছে, তাকে খাওয়াতে তুই রেস্তোরাঁয় যাবি? আমি আছি কি করতে?
-ওফ মা তুমি কি যে করো না! তোমার ওই ঝাল মশলা খাবার হজম হবে না ওর। নাও তাড়াতাড়ি তৈরি হও তো!
বুঝলেন তর্ক করে লাভ নেই। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তো, বউকে মাথায় তুলে নাচছে তাই। যাইহোক গাঁইগুঁই করতে করতে তৈরি হয়ে কর্তার সঙ্গে এলেন। এসে দেখেন সে এক এলাহি ব্যাপার। ঢোকার দরজায় পাহারায় দাঁড়িয়ে এক পাহারাদার। ইয়াব্বড় গোঁফ, বপুটিও সাইজে মন্দ না। সাজপোশাক দেখলে মনে হয় সোজা যাত্রাপালা থেকে হাজিরা দিতে চলে এসেছে এখানে। তা সে আবার দরজা খুলে দিল তাঁদের জন্যে, পেল্লাই একখানা সেলাম ঠুকে কি আবার বলল বেশ। সরমাদেবী হতভম্ব। থতমত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন দেখে ছেলে এসে হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল তাঁকে। ভিতরে ঢুকে দেখেন, একেবারে অন্য জগৎ। হাল্কা সুরের মূর্ছনা ভেসে আসছে কোথার থেকে, বাতাসে দামী পারফিউমের সুঘ্রাণ। তাঁদের টেবিলে বসিয়ে ছেলে গেল অর্ডার দিতে। কাজ সেরে ফিরে এলে সরমাদেবী আর তাঁর বউমা একযোগে জানতে চাইলেন, “হ্যাঁরে অর্ডার কি করলি?”
একগাল হেসে ছেলের সপ্রতিভ উত্তর, “প্লেন রাইস, ডাল, ড্রামস্টিক কারি, মাস্টার্ড হিলসা, রাবড়ি।” সরমাদেবী হাঁ। হিলসা তো বোঝা গেল না হয় ইলিশ, ড্রামস্টিক আবার কি বস্তু? টিভিতে এত রান্নার শো দেখেন, কস্মিনকালেও তো কোন বাঙালীর হেঁসেলে ওই পদার্থটির নাম শোনেননি! নির্ঘাত কিছু ভুলভাল জিনিস এরা ইন্ডিয়ান বলে চালাতে চাইছে। উঃ মাগো, শেষে এইসব বিদেশি ছাঁইপাশ খেয়ে জাত যাবে? কবভি নেহি। জোর গলায় বললেন ছেলেকে, “ওইসব ড্রামস্টিক-ফিক জানিনা বাপু, শিগ্গিরি পাল্টে আয় অর্ডারটা। শেষকালে কি দিতে কি দেবে.. দেখ না চাট্টি চারাপোনার ঝোল পাওয়া যায় কিনা!” ওমা, দেখেন বউমা তাঁর সামনেই কেমন খিলখিল করে হাসতে শুরু করে দিল। ছেলের মুখ লজ্জায় লাল। “আঃ মা, কি যে করো না তুমি! ড্রামস্টিক মানে সজনেডাঁটা, উফ!”
“অ্যাঁ!” সরমাদেবী আবার অবাক! ড্রামস্টিক মানে সজনেডাঁটা! কর্তার দিকে তাকিয়ে দেখেন, গুম হয়ে বসে আছেন। তাই তো, ঠিকই তো। চুপচাপ থাকাই ভালো। কোন ফ্যাসাদে পড়তে হবে না। কর্তার তাঁর বুদ্ধি আছে। কিন্তু থাকব বললেই থাকার জো আছে? বাঙালী মন না? ছোঁকছোঁক খুঁতখুঁত করবেই। একটু পরে ওয়েটার এসে সার্ভ করে গেল। গরম গরম ধোঁওয়া ওঠা ভাত তরকারিগুলো দেখলেই জিভে জল চলে আসে। কিন্তু একগ্রাস মুখে দিয়েই ভ্রু কুঁচকে গেল তাঁর। এ আবার কি? স্বাদটা কেমন অন্য রকম ঠাহর হচ্ছে! ত্রিশ বছর হলো হেঁসেলের হাল ধরেছেন সরমাদেবী, আজ অবধি পান থেকে চুনটুকু খসেনি। এরই মধ্যে বেশ কটা রান্নার বৈকালিক শোগুলোতে গিয়ে আর পাঁচজনকে শিখিয়েও এসেছেন নিজের কিছু রেসিপি। সেই তিনি খাবারের স্বাদ বিচারে ভুল করবেন? ইম্পসিবল। ছেলেকে বলবেন? আবার যদি হাসতে শুরু করে দেয় তাহলেই হলো। দোনোমোনো করতে করতে বলেই ফেললেন ছেলেকে,
-অ বাবু ।
-হুম বলো?
-এই তরকারিটা তো ঠিক জুতের ঠেকছে না রে। হিং ছাড়াও একটা কিসের গন্ধ পাচ্ছি তো!
যা ভয় পেয়েছিলেন তাই হলো। খেতে খেতে হঠাৎ হাসির দমকে বউমা খেল বিষম, তাকে সামলে ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখেন তার মুখ পাকা টম্যাটোবর্ণে রঞ্জিত। দাঁতের ফাঁক দিয়ে উত্তর এল, “ওটা এদের স্পেশাল ইনগ্রিডিয়েন্ট। ভালো না লাগলে ফেলে দাও, খেতে হবে না।”
বুঝে গেলেন সরমাদেবী। বউয়ের মান রাখতে ছেলে জাতপাত গঙ্গাজলেও বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। অগত্যা বেজার মুখে চুপচাপ গলাকঃধারণ করতে লাগলেন খাবারগুলো।
যাক। সেসব তো পুরোনো কথা। ভাবতে ভাবতে বাসের সিটে লাফাতে লাফাতে চলেছিলেন সরমাদেবী। স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে সবে চোখটা লেগে এসেছে, এমন সময় কর্তার হাঁকডাক চালু ।
“কই গেলে গো, আমাদের নামার স্টপেজ চলে এসেছে।” ভারী রাগ হয় সরমাদেবীর। শান্তিতে যে একটু ভাববেন, তারও জো নেই। তবুও, নামার জন্যে মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। দীর্ঘকাল পরবাসের পর ছেলের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। শহরের দিকে ফ্ল্যাট কিনেছে যাতায়াতের সুবিধা বলে। যাওয়ার আগে নাতি হয়েছিল একটি। সবে নিজের পায়ে চলতে শিখেছে সেই সময় চাকরির সূত্রে বিদেশ যেতে হয়। দীর্ঘ চার বছর পর দেখবেন ওদের। নাতিটাই বা কত বড় হয়েছে কে জানে! ভাবতে ভাবতে দেখেন বাস দাঁড়িয়ে পড়েছে স্টপে।
তড়িঘড়ি করে নেমে সরমা দেবী আবার হাঁ। স্ট্যান্ডের আবার নাম দিয়েছে “ক্ষণিকের অতিথি”। তা একদিক থেকে দেখলে কথাটা ঠিকই। নিজের রুটের বাস ছাড়া অন্য সব রুটের যাত্রীরা ক্ষণিকের অতিথিই তো। মনে মনে ফিকফিক করে হাসতে হাসতে পা বাড়ালেন ছেলের ফ্ল্যাটের দিকে।
ফ্ল্যাটের ডোরবেল বাজানোর পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুলে কে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁদের ওপর। প্রথমটায় আঁতকে উঠলেও খেয়াল করে দেখেন আরে! এ তো তাঁদেরই নাতি। ইশশ কত্ত বড় হয়ে গেছে গো, আদর করতে করতে ঢোকেন। ততক্ষণে ব্যস্তসমস্ত হয়ে বউমা এসে উপস্থিত। “আঃ বাবান, কি হচ্ছেটা কি! এইমাত্র এলেন ওনারা, ঠান্ডা হয়ে বসতে দাও। যাও নিজের রুমে যাও।” মনঃক্ষুণ্ন ছেলেকে রুমের দিকে চালান করে বউমা প্রণাম করতে তৎপর। আটকে দেন শ্বশুরমশাই। “আহাহা, কি হচ্ছেটা কি! ঠিক আছে ঠিক আছে, এই নাও মিষ্টিটা নাও, আর আমাদের একগ্লাস জল দাও দিকিন! কই দাদুভাই কই গেলে?” বলতে বলতে হাঁক পাড়েন কর্তা।
অপসৃয়মান গিন্নি-বউমার দিকে চেয়ে অকারণেই একটু বিষাদের হাসি হাসেন সরমাদেবী। বেচারির বারোমাস বোধহয় জিন্স পরা অভ্যেস, আজ তাঁদের জন্যে শাড়ি পড়েছে, জুত করে উঠতে পারছে না। বাবান ততক্ষণে লাফাতে লাফাতে উপস্থিত। নাতিকে একটু আদর করে ঝটপট উঠে পড়েন সরমাদেবী। রান্নাঘরে গিয়ে বউমার সাথে হাত না লাগালেই নয়!
ওমা! সেখানে গিয়ে ঢুকতে আবার আরেক বিড়ম্বনা। বউমা অপ্রস্তুত লজ্জা লজ্জা মুখে অনবরত “আরে মা আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না..আপনি গিয়ে বসুন না” ইত্যাদি বাঁধা বুলি আওড়ে চলেছে! কি আর করা, গুটিগুটি পায়ে বাইরে গিয়ে নাতির কাছে বসেন। সে তখন দাদুকে স্কুলের গল্প বলতে ব্যস্ত। তা যাক, এইটুকু বয়সেই অন্য ডেপোঁ ছোকরাগুলোর মতন মোবাইলের ভেতর ঢুকে পড়েনি, এটাই রক্ষে। ভাবলেও গা কেমন করে! এই তো সেদিন, তাঁর পাশের বাড়ির বউটা ছেলেকে টিউশনে দিতে যাচ্ছে, দেখেন তারও আবার হাতে একটা মোবাইল। ফিরতি পথে শুধোন, “হ্যাঁ গো ওইটুকু ছেলেকে মোবাইল দিয়েছ যে মিনু?” উত্তর পান, “আসলে মাসিমা অনেক সময় দেরি হয়ে যায় তো ছাড়তে, তাই তখন হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ করে দেয়!” “অ।” দীর্ঘশ্বাস চেপে মনে মনে বলেন, “মরণ!”
খানিক পরে দু’গ্লাস শরবত আনে বউমা, সঙ্গে আবার প্লেটে করে মিষ্টি। কি সর্বনাশ! আঁতকে ওঠেন সরমাদেবী, “নিয়ে যাও, নিয়ে যাও! বলি মারবে নাকি! কর্তা-গিন্নি দু’জনেরই আমাদের হাই সুগার, আর তুমি মিষ্টি এনেছ!” আবার বউমা অপ্রস্তুত। “না না মা, এটা সুগার-ফ্রি মিষ্টি। ছানা থাকলেও চিনি নেই, খেয়ে দেখুন না একটা।” “বলছ?” সন্দিহান চোখে জরিপ করতে করতে একটা মিষ্টির একটুখানি ভেঙ্গে আগে চাখেন সরমাদেবী। খেয়ে দেখেন, বেশ ভালোই। দেখেন, কর্তা গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে তাঁর ইঙ্গিতের জন্যে। ইশারা করতে যা দেরি, হামলে পড়েন প্লেটের ওপর। যেন বহুদিন পর বাঘের শিকার জুটেছে! কান্ড দেখে বউমার আবার হাসি চাপার চেষ্টা। আপ্লুত হন সরমাদেবী। আর যাই হোক, তাঁর ছেলের বউ-ছেলে আজকের মতন অকালপক্ক নাকগলানো টাইপের তো হয়নি। আয়েস করে মিষ্টিটুকু খেয়ে তাড়া লাগান স্বামীকে, “চলো চলো, হাতমুখ ধুয়ে চানটাও সেরে ফেলো! আমি ভাত বাড়ছি।” বলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান। বউমা শশব্যস্ত, ” আঃ মা কি করছেন কি! অদ্দূর থেকে এসছেন, আপনিও একটু জিরিয়ে নিন না!” ” আরে না না বউমা, এ বুড়ির এখনও দম আছে বুঝলে? হুঁ হুঁ বলি এককালে তো সাতবাড়ি সমান লোককে রেঁধেবেড়ে খাইয়েছি নাকি?” বলতে বলতে এগোন সরমাদেবী। রান্নাঘরে ঢুকে সরমাদেবীর আবার হিমশিম খাওয়ার উপক্রম। শহুরে হেঁসেলের ছিরিছন্দ কিচ্ছুটি জানেন না যে! অবিশ্যি নিজের রান্নাঘরে যে একটা দুটো আধুনিক জিনিস নেই তা নয়, তবুও মিক্সার গ্রাইন্ডারের থেকে হামানদিস্তা কি শিলনোড়াই বেশি পছন্দ করেন তিনি। এখানে ঢুকে দেখেন গ্যাসের মাথায় আবার ইয়াব্বড় কি যন্তর লাগানো। শুধোন, “ওটা কি বউমা?” বউমা উত্তর দেয় “কিচেন চিমনি মা। ঘরে তেলমশলার ধোঁয়া এতটুকু রাখে না।”
“তাই নাকি!” বিস্ময় লাগে সরমাদেবীর। তাঁরাও তো রান্না করেছেন উনুনের তাপে পুড়ে, ধোঁয়া শুঁকে, তেলের ছ্যাঁকা খেয়ে। কিছু তো হয়নি, দিব্যি সহ্য করেছেন সে সব। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সরমাদেবী। তাঁদের সময় যদি এসব থাকত!
দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে সবাই একসাথে বসেছেন শোওয়ার ঘরে। বাবানের দাদুর সাথে গল্প এখনও শেষ হয়নি, উৎসাহ নিয়ে কবে কার খাতা চুরি হয়েছিল তার ধারাবিবরণী পেশ করছে। সরমাদেবী চুটিয়ে পরনিন্দা পরচর্চা করছেন বউমার সাথে, এমন সময় ডোরবেলের টুংটাং। “বাপি এসেছে! বাপি এসেছে!” বলতে বলতে খাট থেকে এক লাফে নেমে দৌড় লাগাল বাবান দরজার দিকে। ছেলে খানিক পরেই ঘরে ঢুকে ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম সেরে নিল। বুকে জড়িয়ে ধরেন তাকে। সরমাদেবী চোখের জল লুকোতে লুকোতে বলেন “তোমরা বসো, আমি চা করে আনি।” বউমা আবার ব্যস্ত, “মা আমি আনি আপনি বসুন না!” ” না না আমি যাচ্ছি তো!” বলতে বলতে পা চালান রান্নাঘরের দিকে। তা খানিক পরে চা নিয়ে এসে সবাইকে দেন। ছেলে ততক্ষণে জামা কাপড় ছেড়ে ফুলবাবু সেজে বসছেন। চায়ে এক চুমুক দিয়েই একদম স্থির। কঠিন বাংলায় যাকে বলে স্থানুবৎ। মালতীদেবী জানতে চান, “কিরে কি হল?” ছেলে পালা করে একবার বউ একবার বাবার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলে, “চা-টা খাও, বুঝবে কি হয়েছে।” অবাক হয়ে কাপে সুড়ুৎ করে এক চুমুক দিতেই “অ্যাঃ!” আপনেআপ ছিটকে আসে মুখ থেকে। কি হল? হরি হরি, চিনির জায়গায় নুন দিয়ে ফেলেছেন! বোকার মতন মুখ করে তাকান এর-ওর দিকে। বউমা অবস্থা বেগতিক দেখে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসি চাপতে চাপতে রান্নাঘরে পালায় আরেকবার চা বানাতে। ইতিমধ্যে নাতি এসে কোলে বসেছে। কচি গলায় আবদার, ” ও দিদুন, গল্প বলো!” “কি গল্প শুনবে দাদুভাই?” হেসে জিজ্ঞাসা করেন সরমাদেবী। “রূপকথার গল্প!” হাততালি সহকারে উত্তর দেয় বাবান। ভারী খুশি হন সরমাদেবী। গল্প শোনান। ডালিমকুমার, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীদের গল্প।
ক্রমে দুপুর গড়িয়ে বিকেল পেরোয়। সূয্যি ডুবুডুবু। তাড়াতাড়ি উঠে পড়েন কর্তা-গিন্নি। “বুঝলি অপু, ওবেলার রান্না পড়ে আছে। আর একদিন এসে থাকব’খন।” ব্যস্তসমস্ত হয়ে কাপড় পরতে পরতে বলেন সরমাদেবী। বাড়ি থেকে বাসস্টপ অবধি ছেলে যাবে সঙ্গে। দরজায় দাঁড়ানো নাতির চোখে জল। তাকে আদর করে হাতে শুকতারার সংখ্যা দেন একটা সরমাদেবী। “দাদুভাই, এই বইটা পড়বে। অনেক গল্প পাবে এতে, কেমন?” শুকনো মুখে ঢক করে ঘাড় নাড়ে নাতি। তাই দেখে মৃদু হেসে বাসস্টপের দিকে পা চালান।
যখন নিজেদের বাড়ির সামনে বাসস্টপটায় নামলেন কর্তা-গিন্নি, তখন সন্ধ্যে উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। বাড়ির দিকে পা চালাতে চালাতে ভাবেন তিনি, আর যাই হোক তাঁর নাতি আর পাঁচজনের থেকে আলাদা তো হয়েছে। ওই কচি বয়স থেকেই গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়নি। ওর মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকুক ডালিমকুমার, রাজকন্যে, তেপান্তরের মাঠ, ময়ূরপঙ্খী নাও, ঠাকুমার ঝুলি। যুগের পর যুগ, এভাবেই।
বেঁচে থাকুক শৈশব।