অসম্পূর্ণা
অসম্পূর্ণা
বৃদ্ধাশ্রমের খাটে শুয়ে থাকা সুষমার ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে যায়, তার মনে হল সে যেন বিশাল দত্ত বাড়ির পালঙ্কে গা এলিয়ে আছে; ঘোর কাটতে বাস্তবে ফেরে। আজ তো প্রায় পাঁচ বছর হল সে এই হেমলতা বৃদ্ধাবাসে চলে এসেছে, তবুও এক একদিন মনে হয়, এখনি কেউ ডেকে উঠবে, "বড়মা ওঠো, কি কি রান্না হবে বল, তুমি বলে না দিলে এ সংসারে কিছুটি হয়?"না- এসব কথার বুদবুদ সব তার অতীতের।
উত্তর কলকাতার বনেদী বাড়িতে যখন সুষমা বউ হয়ে এল, তখন লোক লস্কর নিয়ে দত্ত বাড়ি যেন একটা মেলা।
নিপুণ গৃহস্থালিতে সুষমা সাজিয়ে তুলেছিল তার শশুরবাড়ির সংসার। খিটখিটে মেজাজের মানুষ শাশুড়ি মা বনলতার সঙ্গে মানাতে পরে পরে অন্য বউদের অসুবিধে হলেও, শান্ত -মিষ্টি স্বভাবের সুষমার কোন অসুবিধে হয় নি, বরং ধীরে ধীরে বনলতার প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠেছিল সে; শশুরমশাই হারাধন দত্ত-ও নির্ভর করতেন সুষমার ওপর।
এরপর এক এক করে এল সুষমার পরের দুই জা, রাণু আর সীমা; সংসার বাড়ল, দায়িত্ব-ও বাড়ল, কিন্তু সুষমার আর পুরো সংসারী হওয়া হল না, স্বামী রজতেশের দিল্লি বদলি হলেও তাকে থেকে যেতে হয়েছিল শশুরবাড়িতেই। দীর্ঘ অদর্শনে রজতেশ আসতে আসতে দূরে সরে যায়,
প্রথম প্রথম মাসে একবার বাড়ি আসত, পরে তা কমে ছ-মাসে একবার হয়ে যায়। কানাঘুষোয় শোনা যায় রজতেশ তার অফিসের কোন এক স্টেনোকে বিয়ে করেছে, সুষমার সঙ্গে সব সম্পর্কের ইতি ঘটে, এ ঘটনার দায়ভার, দোষারোপ-ও সুষমার ঘাড়ে এসে পড়ে। বাপের
বাড়ির অবস্থাও সেরকম ছিল না, তাই সেখানে ফিরে যাওয়ারও উপায় ছিল না, অগত্যা রয়ে যায় শশুরবাড়ির
সংসারেই। সংসারের সব কাজে আছে, কিন্তু গুরুত্বহীন একটা নিমিত্তমাত্র হয়ে, যেন থাকলেও চলে না থাকলেও চলে।
মেজ-জা রাণুর কোল আলো করে এল ছোট্ট ঋজু, নবজাতকের দেখভালের দায়িত্ব এসে পড়ল সুষমার ওপর; সুষমার অপূর্ণ মাতৃহৃদয় আঁকড়ে ধরল ঋজুকে,
ওর হাসি-কান্না, হামা দেওয়া, উঠে দাঁড়ানো, আধো বোলে সুষমা তার ঊষর জীবনে কিঞ্চিৎ আলোর রেখা দেখল।
ঋজু যখন একমুখ হাসি নিয়ে সুষমার দিকে তাকায়, তখন নিজেকে মা যশোদা মনে হয় সুষমার। ঋজুও বম্মা বলতে অজ্ঞান, একটু বড় হতে বম্মার কাছে নানারকম টিফিনের ফরমাস, স্কুল থেকে নিয়ে আসা, আঁকার ক্লাসে
নিয়ে যাওয়া। মায়ের কাছে ঘ্যাঁষে না, সারাক্ষণ "বম্মা।"
ছোট-জায়ের কোলে এল অর্ণা, সুষমার কোল আরো জুড়োল, কচিটাকে বড় করতে লেগে পড়ল। ঋজু একটু বড় হতে ওর আলাদা জগৎ হল, স্কুলের উঁচু ক্লাস, পাড়ার ক্লাবে ফুটবল খেলে, বান্ধবীও জুটেছে, বম্মার টান আসতে আসতে ফিকে হয়ে গেল। তবু আসতে যেতে ছেলেটাকে দেখতে পায় এই অনেক। অর্ণার এখনো গায়ে
গায়ে লেপ্টে থাকার বয়স, কিন্তু ছোটজা সীমার আবার একদম পছন্দ নয়, এই গায়ে গায়ে থাকা, ও নিজের শাসনে, শৃঙ্খলে মেয়েকে রাখতে চায়। অর্ণা যেন কিছুটা বুঝতে পারে বম্মার কষ্ট, ও বড় জেঠুকে ওইজন্য সহ্যই করতে পারে না। সুষমা সাংসারিক কাজেই মন দেয়, শশুরমশাই গত হয়েছেন, শাশুড়ি-মাও শয্যাসায়ী, সব দেখভাল তাকেই করতে হয়। একদিন অর্ণা ফেসবুকে বড়জেঠুর ছবি বার করে সুষমাকে দেখায়, সঙ্গে দু-মেয়ে
আর বউ- দিল্লীর হাসিখুশি সংসার; সুষমার আর নতুন করে কান্না পায় না, যা তার সঙ্গে বিশবছর আগে ঘটে গেছে, তাই নিয়ে ভেবে কি লাভ। মেজ দেওর-জা আলাদা ফ্ল্যাট কিনে চলে যায়, ঋজুও সব বন্ধন কাটিয়ে দিব্যি বাবা-মার সঙ্গে চলে যায়, সুষমার নিজের পেটের ছেলে তো আর না, কোন দাবীতে আর আটকে রাখে। অবশ্য পড়তে বা চাকরি করতে সেই তো চলেই যেত, এ তবু এক শহরে থাকছে।
বাড়িটা ফাঁকা লাগে সুষমার,পুরোন কাজের মাসি হরিমতি সেদিন বাসন মাজতে মাজতে বলছিল,-"এ কেমন সধবার জীবন পার করলে গো বড়বউদি, এমন
জীবন শত্তুরেরও না হয়।" সুষমার এমন অবস্থা, তাকে দেখে হরিমতিরও মায়া হচ্ছে, "হায় ভগবান,"- একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সুষমা।
ছোট দেওরের শরীরটা ইদানিং ভাল যাচ্ছে না, অর্ণাকে সাথে নিয়ে ডাক্তার-বদ্যি যাকিছু সুষমাই করছে। সুষমার উৎসাহ ও তাগিদে অর্ণা ভাল গান গায়, এ বছর উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে ও। সীমার নতুন ঝোঁক উঠেছে যে
অর্ণার বিয়ে দিতে হবে, দেওরের শরীর ভাল না, যদি ভালমন্দ একটা কিছু হয়ে যায় তো আফসোসের শেষ থাকবে না। সুষমার আপত্তি মোটে কানে তুলছে না, পেটের মেয়ে নয়, বলে মনে হয় ওকে অসহায় হয়েই থাকতে হবে। সীমার বাপের বাড়ি সম্বন্ধ আনল, এক মাসের মধ্যে মেয়েটাকে পর করেই ছাড়ল।চোখের জলে বিদায় নিল অর্ণা।
বাড়িটা একটা নির্জনপুরী হয়েছে, কদিনের বাড়াবাড়িতে শাশুড়িমা-ও গত হলেন; তিনটে প্রাণী অত বড় বাড়িতে টিমটিম করতে রইল, তবুও এ বাড়ির সঙ্গে অসমাপ্ত গ্রন্থি
বাঁধা রয়েছে, তার না হওয়া সংসারের স্বপ্ন এখানেই সেঁধিয়ে আছে।
মাস খানেক পর মেজদেওর আর দিল্লীর বড়জনের চেষ্টায় বাড়ি বিক্রির প্রস্তাব এল, সীমাও ছোট দেওরকে নিয়ে মেয়ের কাছাকাছি থাকার সিদ্ধান্ত নিল, সুষমার হয়ে বলার তো কেউ নেই; অতএব চোখের সামনে দেখল
তার শেষ আশ্রয়টুকুও বিকিয়ে গেল। যে যার ভাগ নিয়ে সরে পড়ল, করুণা করে কিছু টাকা গচ্ছিতের ব্যবস্থা করে তাকে ফেলে রেখে গেছে, এই হেমলতা বৃদ্ধাবাসে।
বৃদ্ধাবাসের বাকিদের কেউ না কেউ দেখতে আসার থাকলেও তার কাছে আর কে আসে, না আছে ছেলে, না আছে মেয়ে। অগত্যা এখানেই কারো মাসি, কারো পিসী হয়ে বেঁচে আছে, একসময় ভরা সংসারের স্বপ্ন দেখা, বছর ষাটের সুষমা। জীবনের অন্তিম পর্ব অব্দি- এই তার সংসার, এই ছোট্ট খাটটুকুই তার আশ্রয়।