Partha Pratim Guha Neogy

Tragedy Inspirational Others

4.1  

Partha Pratim Guha Neogy

Tragedy Inspirational Others

অধিকার রক্ষার সংগ্রাম

অধিকার রক্ষার সংগ্রাম

5 mins
290


রোজকার মত সকালে চা দিতে গিয়ে আমার স্বামী ইমন আমার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলো। কাগজটা দেখেই আন্দাজ করতে পারছি এটা কি হতে পারে। তবুও ইমন ভনিতা ছেড়ে বলল,

– সাইন করে দিও

– তাহলে কখন বেড়িয়ে যাবো?

– সেটা তোমার ব্যাপার তবে আজ হলেই ভালো হয়।

– ঠিক আছে।


আমাদের বিয়ে হয়েছে ৫ বছর হলো। এই পাঁচ বছর শ্বশুরবাড়ি নামের এই বন্দিশালায় কিভাবে থেকেছি তা আমি জানি। বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হয়েছিল। আমি তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। হঠাৎ হুট করেই বিয়েটা ঠিক করে বাবা। আমাকে যখন বলেছিলেন আমি কোনো প্রতিবাদ করি নি। বাবা-মা এর ভালো মেয়ে হতে চেয়েছিলাম। বিয়ের আগে বাবা বলেছিলেন,

– মা রে অনেক ভালো ছেলে, বেশ ইনকাম তোর খেয়াল রাখবে। কষ্ট পেতে দিবে না। আমার বাবা ছাপোষা মানুষ, চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত। মা-বাবা দুজনের ধারণা ছিল বাবা রিটায়ার্ড করলে আমার জন্য ভালো পাত্র পাওয়া যাবে না। তাই এই সুযোগ ছাড়লেন না। বিয়েটা হয়ে গেলো। ইমন একজন উচ্চশিক্ষিত ছেলে, ভালো মাইনের চাকরি, দেখতে ভালো আর কি চাই একটা মেয়ের। বিয়ের প্রথমে আমার আদর আপ্যায়নের কোনো কমতি ছিল না। আমার শ্বশুর বাড়ি আবার কোনো যৌতুকে বিশ্বাস করেন না, তবে বৌমার সুবিধার্থে উপঢৌকন নিতে দোষ নেই।


হোক না তা দামি ফ্রিজ কিংবা ওয়াশিং মেশিন বা এসি। বাবাকে আমার সুবিধার্থে একটা বড় লিস্টি ধরিয়ে দিলেন। আমার মানা করা স্বত্তেও বাবা অনেকটা ধার দেনা করেই লিস্টির উপঢৌকন গুলো কিনে দিলেন। আমার প্রশ্ন তাদের ছেলের উপার্জন তো খারাপ নয় তবে বাবার কাছে এভাবে নেয়ার কি মানে? বিয়ের পর আমার পড়ালেখা প্রায় বন্ধ। কারন আমার শ্বাশুড়ি মার ধারণা মেয়েদের এতো পড়ে কি হবে!! সে তো সংসার আর বাচ্চা-কাচ্চাই সামলাবে। তাতে এই পড়াই যথেষ্ট।


আমি এবারও কোনো প্রতিবাদ করি নি। আমার সংসার খারাপ তো যাচ্ছিলো না। সকাল থেকে সবার ফরমায়েশ পূরণ করে রাতে বরের মনোরঞ্জন করা, যাকে বরের ভালোবাসা বলে। এভাবেই দিন চলছিল, আমারও কোনো অভিযোগ ছিল না। কিন্তু কেউ কোনোদিন আমি কেমন আছি বা আমার কি কিছু চাই বা আমার দিন কেমন যাচ্ছে তা জিজ্ঞাসা করতো না। আমার স্বামী তার দিন কেমন যাচ্ছে তা জানাতে ভুলতো না,কিন্তু আমার কথা জিজ্ঞেস করাটা প্রয়োজন মনে করতো না।


প্রথম একবছর ভালোই চলছিল কিন্তু বিপত্তি অন্য জায়গায় হল, আমার বাবার পক্ষে আমাকে নতুন করে কিছুই দেয়ার সামর্থ্য নেই। আমার শ্বাশুড়ি মার তাই কথায় কথায় খোঁটা দেওয়াটা একটা দৈনন্দিন কাজ হয়ে গেছিল। আমার বরও আমাকে ছেড়ে কথা বলে না, আমার তখন সব কাজেই কেমন যেন খুঁত । এবারও কোন প্রতিবাদ করতে পারি নি। আমার গা এ যেন গন্ডারের চামড়া, কিচ্ছু যায় আসছে না। একদিন ইমনের সহকর্মীদের আমাদের বাসায় নিমন্ত্রণ ছিল। সারাদিন তাদের খাবার দাবারের খেয়াল করতে যেয়ে আমার নিজের দিকে খেয়াল করি নি। আমার পোশাক খুবই সাধারণ ছিল। ইমনের হাই ক্লাস সোসাইটিতে যা চলে না। যখন তারা ওকে ওর স্ত্রীর কথা জিজ্ঞেস করলো, তখন ও সুন্দর বলে দিল,

– ও ওর বাবার বাসায়,ওর বাবা একটু অসুস্থ।

আমি হতবাক, কি বলা উচিত ছিল আমার জানা নেই। আমি সেদিন ও প্রতিবাদ করি নি।রাতে ইমনকে যখন জিজ্ঞেস করলাম কেন এমনটা করলো, উত্তরে শুনলাম আমি নাকি একটা আনকালচার্ড মেয়ে,আমাকে পরিচয় করিয়ে সে নিজেকে ছোট করতে চায় নি, অথচ এই লোকটার জন্য আমি সকাল থেকে এত খাটাখাটুনি করেছি। আমার ননদের যখন বিয়ে তখন আমাকে আমার শ্বাশুড়ি তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন,

– তোমার বাবা পারেনও বাপু, মেয়ের শ্বশুর বাড়ির সাথে স্ট্যাটাস কিভাবে মানিয়ে চলতে হয়,তাও কি এই বয়সে শিখিয়ে দিতে হবে।

– বাবা তো চাকরি করেন না মা, এই পেনশনের টাকায় যা পেরেছেন এনেছেন।

আমার নম্র গলায় করা প্রতিবাদ যেন শ্বাশুড়ি মার পছন্দ হলো না। অকথ্য ভাষায় কিছু কথা শুনিয়ে দিলেন। তাতেও তিনি থেমে যান নি, ইমনকে বলে সালিশী বসালেন যে আমি তার সাথে বেয়াদবি করেছি। ইমন বিনা কারনে আমাকে মায়ের কাছে ক্ষমা চাওয়ালো। আমি প্রতিবাদ না করে ক্ষমাও চাইলাম, গুরুজন ক্ষতি তো নেই ক্ষমা চাইতে।



সংসার চলছিল ঠিকই তবে ইমন কেন জানি রোজ রাতে দেরী করে বাড়ি আসতো। খেয়ে আসতো বেশিরভাগ। আমি জিজ্ঞেস করলে তার সোজা মুখে উত্তর পাওয়া যেত না। রাতে বারান্দায় ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতো। ঘুমানোর সময় আমার পাশে তাকে পাওয়া বিরল। একদিন মায়ের রুমে যখন সে কথা বলছিল,তখন তার মোবাইলে ফোন আসে। অনেকবার বাজছিল আর কেটে যাচ্ছিল। তাই না পারতে আমি ধরেছিলাম। ফোনের ওপাশের গলাটা আর কিছু কথা শুনে আমার বোঝা হয়ে গেলো এই মানুষটি আর আমাতেই সীমাবদ্ধ নয়। আমার হাতে নিজের ফোন দেখে ইমনের মেজাজ বিগড়ে গেলো। আমার গালে চড় মারতেও সে দ্বিধা করলো না। আমি সেদিন ও প্রতিবাদ করি নি। নাতি নাতনির মুখ দেখবেন বলে আমার শ্বাশুড়ি মার আবদার বেড়েই যাচ্ছিল। আমি তো তাকে বোঝাতে পারছি না যে আপনার ছেলেই আমার নয়, আমি কিভাবে তার সন্তানের মা হব। আমাকে বাঁজা , বন্ধ্যা মেয়েছেলে ইত্যাদি বলে সব সময় কথা শুনাতে থামতেন না। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতাম, প্রতিবাদ তখনও করি নি। কিছুদিনের মধ্যে আমার বরের বিরক্তির কারন হয়ে গেলাম, আমাকে তার যেন দু চোখে সহ্য হচ্ছে না।



আমাকে নানা ভাবে বুঝাচ্ছে যাতে আমি তাকে ছেড়ে দেই, কিন্তু আমি কি করবো, মাটিতে দাঁত চেপে পড়ে রইলাম। ইমনকে এই পরিবর্তনের কারন জিজ্ঞাসা করবো না,লাভ নেই।


শ্বাশুড়ি মার সাথে সে কয়েকদিন ধরে আলাপ আলোচনার পর এই ডিসিশন নিয়েছে হয়তো। আজ আমার কাছ থেকে ডিভোর্স চাইছে ,কারন আমি তাকে সুখী করতে পারছি না। আমি সাইন করে দিলেই সে মুক্ত, সাথে আমিও। আমি আজও কোনো প্রতিবাদ করবো না, আমি বরাবরই শিরদাঁড়াবিহীন একজন নারী। প্রতিবাদ আমি করিনি,করাটা হয়তো আমার দ্বারা হবেও না। মা-বাবা চেয়েছিলেন আমি যেন তাদের নাম না ডুবাই, তাই করেছি। আমি প্রতিবাদ করি নি,হয়তো তাই আজ আমার এই পরিস্থিতি বা পরিণতি। আমি সাইন করে,নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। আমার গন্তব্য অজানা, বাবা-মার কাছে গিয়ে তাদের লজ্জার কারন হতে দিতে পারবো না। তাই আমি নিজের পথটা নিজেই খুঁজছি। আমি শহরের রাস্তায় হেটে যাচ্ছি, অজানায়। জানি না কোথায় গিয়ে এই পথ থামবে।


তবুও এই প্রতিবাদের একটা প্রয়োজন আছে, কারণ একটি সংসার দুজনের সহযোগিতায় চলে - এখানে কেউ কারো ভৃত্য নয়। কিন্তু কেউ যদি একটা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে এই ধরনের ব্যবহার করে তাহলে তার সংশোধনের জন্য প্রতিবাদ করতে হবে শিরদাঁড়া সোজা রেখে। দিন বদলাচ্ছে - এটা প্রমাণিত যে মেয়েরা বাইরের কাজেও সমান দক্ষ পুরুষের মত সর্বক্ষেত্রে। তাই সমান অধিকারের ভিত্তিতেই চলবে সংসার - দুজনেই সমান অংশীদার। এর অন্যথা হলে দোষীকে তার ভুল বোঝানোর জন্য কঠিন হতে হবে অন্যজনকে। সংসার হবে বৈষম্যহীন সেটা লিঙ্গ বৈষম্য বা যাই হোক। যতদিন এই সত্য প্রতিষ্ঠিত না হবে, কারণ এ লড়াই মৌলিক অধিকারের জন্য আর এ লড়াই জিততেই হবে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy