# অভিশপ্ত-মহল
# অভিশপ্ত-মহল




ওপরের দক্ষিণের বারান্দায় বসে মানদা সুন্দরীর কেশ চর্চায় ব্যস্ত তার শাশুড়ি মোক্ষদা। যে বয়সে মেয়েরা পুতুল খেলে সেই বয়সেই বিয়ে হয়েছিল মানদার। সে যুগে মেয়েরা ঋতুমতী হবার পূর্বেই বিবাহ সম্পন্ন হত। মানদার ও ব্যতিক্রম হয়নি।
সংসার, সমাজ, সংস্কার এসব কিছু বোঝার আগেই শুরু হয়েছিল তার বিবাহিত জীবন। বিবাহের পর ঋতুমতী হওয়ার আগে পর্যন্ত কিছু দিন পিতৃগৃহে থেকে "নারীত্বের প্রমাণ" নিয়ে তবে স্বামী গৃহে পদার্পণ করেন। আরও পাঁচটি নারীর মতো স্বামীর চাহিদা মেটাতে তাকে উপযুক্ত করে তৈরীতে ব্যস্ত হয়েছিলেন শাশুড়ি মোক্ষদা।
এমনি করেই কেটে গিয়েছিল বেশ কয়েকটি বছর। কিন্তু সন্তান উৎপাদনে ব্যর্থ মানদা দিনের পর দিন অসহায় হয়ে পরেছিল। নাহ্ তার গর্ভে সন্তান আসেনি, বদলে এসেছিল চক্রবর্তী বাড়ির নতুন আর একটি বৌ সরোজিনী। সতীন দেখে মানদা কিন্তু সেদিন ভেঙে পরেনি, তার এই অপমানটাও তার আত্মসম্মানে লাগেনি, উল্টে সে মুক্তির আনন্দে কিঞ্চিৎ হলেও আত্ম তৃপ্তি লাভ করেছিল। সে হয়তোবা মুক্ত হতে চেয়েছিল এই সন্তান উৎপাদনের অত্যাচার থেকে, হয়তো মুক্তি চেয়েছিল সংসার নামক জাঁতাকলের পেষণ থেকে, কিম্বা একটা মিথ্যে বদনামের হাত থেকে। আর তাই হয়তো সে মন থেকে সরোজকে নিজের ছোট বোন বলে মেনে নিয়েছিল।
বালিকা সরোজিনী ও তার এই নিস্পাপ ভালবাসার মধ্যে নিজের ছেড়ে আসা পরিবারকে খুঁজে পেয়েছিল। তাই তারা পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে সংসার ধর্ম শুরু করেছিল।
কিন্তু এরপরও যখন সাত বৎসরাধিক কাল কেটে গেলেও চক্রবর্তী বাড়িতে কোন বংশ প্রদীপ জ্বলল না, তখন মুখে কেউ প্রকাশ না করলেও সবাই অনুমান করেছিল সুরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর জটিল সমস্যার কথা।
এখানেই হয়তো চক্রবর্তী বাড়ির সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত, হয়তো বংশের "শ্রীবৃদ্ধি"ও থেমে যেত, যদি না এর বছর চারেক পর ছোট বৌ সরোজের গর্ভে চক্রবর্তী বাড়ির কলুষিত রক্তের প্রদীপ জ্বলত। তৎকালীন সমাজের নিন্দুকদের বাঁকা দৃষ্টি পরেছিল সুরেন্দ্রনাথের বিপত্নীক পিতা মহেন্দ্রনাথের ওপর। শোনা যায় ওনার যে কিঞ্চিৎ জমিদার সুলভ চরিত্রের দোষ ছিল, তা স্ত্রী বিয়োগান্তে প্রবলভাবে দেখা দেয়, নিন্দুকদের মতে মানদা যে কি ভাবে সেই কামার্ত পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজেকে সেই সময় রক্ষা করেছিল সেটাই আশ্চর্যজনক বিষয়, বা এটাও হতে পারে যে মানদাও নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন না।
সরোজিনীর বোধকরি এই অত্যাচার, অপমান সহ্য মাত্রা অতিক্রম করে যায়। আর তাই হয়তো সে পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার সাথে সাথেই ইহলোক ত্যাগ করেন। সেই সন্তান মানদা সুন্দরীর স্নেহ মমতায় মানুষ হয়। যদিও আদপে কতটা মানুষ হয়েছিল সে ব্যাপারে প্রশ্ন চিহ্ন রয়ে যায়, মানদার কিন্তু সন্তান পালনে কোনরূপ খামতি ছিল না।
এর সুদীর্ঘ বাইশ বছর পর সেই যুবকের সদ্য বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। পুত্রবধূ কল্যাণীকে মানদা কন্যা স্নেহে রাখতেন, তার অন্য আর একটা কারন ছিল, সেটা হল ভয়। মানদা জানে এ বাড়ির পুরুষদের রক্তে অবলা নারীর শরীরের প্রতি পৌরুষত্ব জাহির করার নেশা আছে, আর আছে ঘরে বাইরে সর্বত্র কামুক নজর।পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকেই সে ভীত হয়ে কল্যাণীকে সর্বদা স্নেহের আগলে বেঁধে রাখত।
মানদা সুন্দরীর পিতৃগৃহের পাতানো সই, গঙ্গাজলের বিধবা মেয়ে ননীবালা, বর্তমানে তার কাছে আশ্রিতা। তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটে ছিল, আর ননীবালাও সেই রসে বঞ্চিত ছিল না, যা তথাকথিত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে না পারা, উদার মানসিকতার মানদাকে আকর্ষণ করেছিল। এদিকে যেহেতু কিঞ্চিৎ ইংরেজি শিক্ষা ননীবালার জ্ঞানে ছিল, তাই নিন্দুকদের মতে, ঐ ম্লেচ্ছ ভাষাই তার বৈধব্যের কারণ। সে যাইহোক সংসার জ্ঞানে অতিশয় পটু মানদারও বোধ করি দাবার চালে কিঞ্চিৎ ভুল হয়েছিল। আর তাই সে কল্যাণীকে অতিরিক্ত সুরক্ষিত করতে গিয়ে, ননীবালাকে অরক্ষিত করে ফেলে। যার ফলে ষাটোর্ধ্ব সুরেন্দ্রনাথের নজরে আসে ষোড়শী ননীবালা। যার ফলস্বরূপ মানদা অসহায়ের মতো রুদ্ধ দ্বারের বাইরে থেকে শুনেছিল, শারীরিক ভাবে, সামাজিক ভাবে, দুর্বল নারীর এক করুণ আর্তচিৎকার, " সই মা"।
নাহ্ মানদা সেদিন ননীবালাকে বাঁচাতে পারেনি, সে স্বামীর বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে পারেনি। সে যেটা করেছিল, ঐ অভিশপ্ত পরিবারে আর কোন দিন কোন লম্পট, চরিত্রহীন পুরুষের জন্ম হতে দেয়নি। ঐ অভিশপ্ত মহল পুত্র সন্তানের অভাবে , কালের নিয়মে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
শোনা গিয়েছিল কল্যাণী পর পর দুটি মৃত পুত্র সন্তান জন্ম দেওয়ার পর, দুটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছিল। অথচ সেই সময় আঁতুড়ঘরে মানদা স্বয়ং উপস্থিত থেকেও মৃত্যুর কারণ অজানা থেকে যায়। এভাবেই বিনিষ্ট হয়েছিল একটি অভিশপ্ত রক্তের বংশধারা।