Apurba Kr Chakrabarty

Abstract Romance Tragedy

4.0  

Apurba Kr Chakrabarty

Abstract Romance Tragedy

আত্মজা

আত্মজা

15 mins
181


 তার রূপ,বুদ্ধিদীপ্ত মুখ কলেজে সব ছেলেদের নজর কাড়ত।তবে তার মুখোরা স্বভাব বেপরোয়া মনোভাব অন্য সহপাঠীরা একটু সমঝে চলত।অভীকে সে ভালোবেসেছিল একটাই কারণ, ছেলেটার বাবা যদিও খ্যাতনামা ডাক্তার, স্ত্রী রোগবিশেষজ্ঞ, মন্ত ধনী, আবার রাজনৈতিক ভাবে সরাসরি না জড়িত থাকলেও সে সময় ক্ষমতাসীন দলের বড় বড় নেতাদের তিনি খুব ঘনিষ্ঠ। তার শর্তেও অভি ছিল ভীষণ সহজ সরল।আর রাগী মেজাজী অন্তরা কারনে অকারনেই রেগে যায়, নিজের মেজাজে চলতে সে ভালোবাসে।বেপরোয়া মনোভাব মুখোরা এসব জেনেও অভি তাকে খুব ভালোবেসেছিল।এটা তার সারল্য আর সাদাসিদে ঘরোয়া মানসিকতার জন্য।

মাঝে মধ্যে,অভীকে সে কটাক্ষ করে ধনীর দুলাল।সোনার চমচ মুখে জন্মেছ , তবুও এত হাড় কৃপন কেন! একটু সমাজের গরীবদের বিষয়ে দরদী হতে পরামর্শ দিতো।বলত বাবার তো টাকার হিসাব নেই!

ছুরি ধরলেই হাজার হাজার টাকা,গাড়ি বাড়ি আর ব্লাক মানির হিসাব নেই,মেকী বাম পন্থী নেতাদের সাথে এত উনার ঘনিষ্ঠতা এ তো দ্বিচারিতা!

অভী রাগত না,খুব হাসত,বলত এটাও একটা আর্ট, বাবার ভিতর আর বাইরেটা সম্পূর্ণ আলাদা। ঐ সব নেতাদের কিন্তু বাবা মনে প্রানে পছন্দ করেন না।তাই নিশ্চিত জেতা সিটে এম এল এ টিকিট অফার দিলেও স্বেচ্ছায় এই অফার ফিরিয়েছেন।কোন দিন সরাসরি রাজনীতিতে আসেন নি।


যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে,একটু কুটনীতি জানতে হয়।নিজের নিরাপত্তা আর কিছু তৎক্ষনিক সুবিধা নিতে সারমেয়দের একটু উৎছিষ্ট খাবার মাঝে মধ্যে ছুড়তে হয়।তারা তখন আর ঘেউ ঘেউ করে না,কামড়ে দেবে বা আক্রমন করবে সে ভয় থাকে না।কাছে আসে,লেজ নাড়ে। সন্তুষ্ট হয়, প্রিয় প্রভুর জন্য যান লড়িয়ে দেয়।

অভীর বাবার মস্ত নার্সিংহোম, একটি প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল,গঙ্গার ধারে চল্লিশ বিঘার ফার্ম হাউস,আর শহরের উপকন্ঠে অনেক জমি কিনে কত টাকার যে মালিক নিজেই জানেন না।কিন্তু ভীষণ মিতব্যায়ী বাড়ি গাড়ি পোষাক অতি সাধারণ মানের, কোন বিলাসিতা নেই।মানুষকে বুঝতেই দেন না এত তার সম্পদ। তিনটে ছেলে মেয়েদের অতি সাধারণ ভাবেই মানুষ করেছেন। বাংলা মিডিয়াম সরকারী স্কুলে তাদের পড়াশোনা।

বড় ছেলে সৌভীক কানপুর আই আই টি থেকে বিটেক করে আমেরিকায় থাকে।এক শেতাঙ্গ মেয়ে বিয়ে করে ওখানেই স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর মেঝ মেয়ে, দেবযানী, কলকাতার এক কলেজে পড়ায়। বর ও কলেজ পড়ায়।ছোট অভীক, সে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় থেকেই অন্তরার সাথে প্রেম ও পরে বিয়ে করে।

অভীক বাবার মতই গাইনো স্পেশালিস্ট আর অন্তরা চেস্ট স্পেশালিস্ট।অভীর বাবা বিজয় বাবু গ্রামের মানুষ, ঐ গ্রামে অনেক তার অবদান।গরীব তিনটে গ্রামের মেধাবী দরিদ্র ছেলেকে এই মুহূর্তেই নিজের খরচে পড়াচ্ছেন। গ্রামের একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করতে, আর রাস্তার উন্নয়নে অনেক করেছেন। গ্রামের মানুষদের প্রায় বিনা পয়সায় চিকিৎসা পরিষেবা দেন।

এত সব শোনার পর অন্তরা লজ্জিত, নিজের সবজান্তা মনোভাব ত্যাগ করে।অভীককে জীবনের সঙ্গী করতে মনস্থির করেছিল।নিজের যোগ্যতা না পাটির সুপারিশ বা অনুকুল্যে বিজয় বাবু মেয়েকে কলেজে ঢুকালেন কীনা তেমন জানা না গেলেও, পুত্র বধুকে জোরাল সুপারিশে তার প্রথম পোস্টিং বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হয়েছিল অন্তরা জানে। চুপ করে এই সুযোগ গ্রহন করলেও সে ভীষণ দ্বায়িত্ববোধ আর দরদ নিয়ে তার নিজের কর্তব্য পালন করে।যেন ক্ষেত্রে বিশেষে বেশী! মনে হয় শ্বশুরের দ্বারা অনুপ্রাণিত।

অভী কিন্তু এখনও তার পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত আছে। ডিগ্রির বাড়ানোর তার বড় শখ।কলকাতা পন্ডিচেরি পাঞ্জাব,উত্তারাখন্ড কত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কত সব ডিগ্রি যে অর্জন করল,এবার ফরেন যাবার সখ,অন্তরা এসবের খবর রাখে না।


নিষ্ঠাভরে আউট ডোরে সে রোগী দেখে সপ্তাহে দুদিন। রোগীদের ভিড় সেদিন যেন বেশী হয়।দুর্বল অসুস্থ মানুষদের চিকিৎসার সাথে আলাপচারিতা জমিয়ে জেনে নেয় তার আর্থিক অবস্থা।

একবারে হতদরিদ্র পেসেন্ট মনে হলে তাকে বলে,আউট ডোর ডিউটির পর তার অফিস রুমে দেখা করতে।সেখানে খুব দরদ দিয়ে ওদের কথা শোনে।হাসপাতালে ওষুধ ট্যাবলেট যদি অমিল থাকে বা দেওয়ার সমস্যা থাকে, চিরকুট লিখে পাঠায়, তার শ্বশুরের নার্সিংহোমের সংলগ্ন শ্বশুরের নিজস্ব মস্ত মেডিসিন সপে। অন্তরার চিরকুট দেখলেই কর্মীরা যা তার প্রেসক্রাইব করা মেডিসিন ওষুধ ট্যাবলেট সব দিয়ে দেয়।

অন্তরা তার বিল নিজের বেতন থেকেই দিয়ে দেয়।শ্বশুর চাইলেও তার ব্যবসার ক্ষতি হতে দেয় না।কিন্তু শ্বশুরের গোপন নির্দেশে মেডিসিনের দাম নগন্য রেখে সেই বিল,মাস শেষে অন্তরার কাছে পাঠায়।অন্তরা এত সব হিসাব বোঝে না।

অন্তরার বাপের বাড়ির অবস্থা সচ্ছল হলেও ধনী বলতে যা বোঝায় তা নয়।শ্বশুর মস্ত ধনী, তিন বছরের তার পুত্রের,সব দ্বায়িত্ব শ্বশুরের। স্বামী বসন্তের কোকিলের মত কোন পারিবারিক দায় দায়িত্ব ঝক্কিতে নেই।অন্তরা মাঝে মাঝে স্বামীর কাছে যায়,এখন নৈনিতালে, ভালো স্কলারশিপ পায় সে, সবটাই ফোটায়।মাঝে মধ্যে অভী বাড়ি আসে।তবু তাদের দাম্পত্য জীবনে দুরত্ব আর বিরহ বেশী।

অন্তরার এমন বিরহ জীবন ভালো লাগে না।তবে এসব স্বামীকে বলে নিজেকে খাটো করে না। মাঝে মাঝেই স্বামীর সাথে দেখা হলে,তাই সোহাগ মিলন চেয়েও তার রাগে ক্ষোভে যেন অভী ভয়ে জড়সড় থাকে।


"এত টাকা খাবে কে! যৌবনটা উপভোগ করতে শিখলে না।কেবল ডিগ্রি লম্বা করো! বাবার নখের যোগ্যতা তোমার নেই।"


কত যে ভর্ৎসনা আর কটাক্ষ করে তার হিসাব নেই। অভী যখন থাকে না অন্তরায মনটা বড্ড খারাপ করে, বেচারা বড় নিরীহ,যা বলি সহ্য করে,কোন উত্তর বা প্রতিবাদ করে না। রাতটা ভীষণ সে অভীক কে মিস করে, তবে দিনে নানা ব্যস্ততায় কেটে যায়।

সেদিন এক বয়স্কলোক, দীন দরিদ্র জীর্ণ পোষাক শীর্ন শরীর,জটাধারী মুখে ভর্তি পাকা গোঁফ দাড়ি এক রোগী তার কাছে এদিন এসেছিল, হার্টের সমস্যা, চোখ দুটো ফ্যাকাশে ,যেন রক্ত শূন্যতায় ভুগছে। অন্তরা তার চিকিৎসা সংক্রান্ত দেখভাল করে তার স্বভাব বশত জিজ্ঞেস করে ,


"আপনার বাড়ি কোথায়!"


"ঠিক নেই।"


"সে কি ! থাকেন কোথায় !"


"এখন এই শহরেই আছি,তা প্রায় একবছর হল। "


"আরে বাবা রাতে থাকেন কোথায় ,শোওয়া বিশ্রাম খাওয়া থাকার কথা বলছি।"


"ঠিক নেই, কোন দিন কোন পূর্ব পরিচিতদের বাড়িতে বা কোন আশ্রমে আশ্রয় পেলে থাকি, আবার রেল স্টেশনের সামনে অনেকেই শোয় আমিও মাঝে মধ্যেই শুয়ে ঘুমাই। এখন দুমাস স্টেশন চত্বরেই আছি।

" বৃষ্টি পড়লে বা খুব শীতে !"


"রেলের সেডে মধ্যে ঢুকে যাই, একটু সমস্যা হয় গাদাগাদি হয়ে যায়।তবে অসুবিধার কিছু নেই। "


"ঘুম আসে! মশা খায় না! "


"চাদর ঢাকা দিয়ে শুই, হাওয়া বয়,বহু মানুষ শোয়।ঘুমের সমস্যা হয় না।আগে মাঝে মাঝেই পাহাড়ে বা তীর্থেস্থলে তীর্থেস্থলে খুব ঘুরে বেড়াতাম এখন শরীর খারাপ ,শক্তি নেই, তাই মনে সাহস পাই না।"


"আত্মীয়স্বজন আছেন!"


"আমি সন্ন্যাসী মানুষ,আত্মীয়স্বজন আমার নেই। "


"আপনার নাম হৃদয়ানন্দ স্বামী বয়স চৌষট্টি বাড়ি বর্ধমান, কিন্তু আপনার পদবী কী !"


"সন্ন্যাসীদের পদবী থাকে না ম্যাডাম।"


আপনি এই প্রেসক্রসশনটা নিয়ে সামনে লাইনে যান দেখুন কী কী ওষুধ পান,সব পাবেন না হয়ত।দুটোর পর আমার চেম্বারে যাবেন,ওষুধ ট্যাবলেট পেতে কিছু সমস্যা হলে আমি দেখছি কী করা যায়।"


"আপনার প্রাইভেট চেম্বার ম্যাডাম! কিন্তু আমার যে টাকা নেই! "


"প্রাইভেট চেম্বার নয়, এই হাসপাতালেই, আমার অফিস রুমে আসুন।"


"আপনি ম্যাডাম গরীবদের অনেক সাহায্য করেন, একজনের কাছে আপনার কথা শুনে এলাম।ও আমার মতই ভবঘুরে ভিখারী বলতে পারেন।আপনার খুব নাম করছিল,আমি তাই ভরসা করে এলাম। আপনার কাছে দেখাব ইচ্ছা ছিল। "

অন্তরা একটু হাসল, বলল,

"ঠিক আছে,আপনি যেন অবশ্যই আমার সাথে দেখা করবেন।"

কী মনে হল এক স্টাফ কে ডেকে অন্তরা বললেন,  

 "এই ভদ্রলোককে আমার চেম্বারে দুটোর পর আমি যখন বসব নিয়ে যাবেন। পালিয়ে যেন না যায় ।"


গ্রুপ ডি পাল বাবু ডাক্তার অন্তরা ম্যাডামের ভীষণ অনুগত। অনেক আর্থিক মদত পায়।পাল বলল ,

"লোকটি কে ম্যাডাম !"


"সন্ন্যাসী বলছেন! গায়ে গেরুয়া,মাথায় জটা গোঁফ দাড়ি ,বাড়ী ঘর নেই। " 


"ম্যাডাম এখন কত সব যে ভিখারীদের ডেক হয়।"


"সে যাই হোক, ওকে নজরে রাখুন আমি এখন ব্যস্ত ওকে কেমন যেন রহস্য লাগছে, খুব যেন খুব চেনা চেনা ! "

পাল বাবু নিশ্চিত করলেন,

 "ঠিক আছে ম্যাডাম ওকে নজরে রাখছি। ঠিক সময়ে আপনার চেম্বারে নিয়ে যাব।"


অন্তরার বয়স একত্রিশ দেখে মনে হয় না,হাল্কা শরীর,নিয়মিত যোগাসন করে।দেখে মনে হয় বেশ কম, ছাত্রী ছাত্রী লাগে।রোগী দেখার বাইরে ভীষণ ব্যক্তিত্ব, কম কথা বলে। অধস্থন কর্মীদের সে খুব প্রিয়।তাদের যথেষ্ট সম্মান ইজ্জত দিয়ে কথা বলে।

এসি রুমে অন্তরা বসে অফিস সংক্রান্ত কিছু কাজ করছিল একমনে, পাল বাবু ডাকল,


" ম্যাডাম এই ভদ্রলোক তো আর থাকতে চাইছে না বলছে ওর এক পূর্ব পরিচিতের বাড়িতে খেতে যাবে দেরী হলে সমস্যা।"


"বেশ উনাকে ডাকুন।"


ঘরে ঢুকে হৃদয়ানন্দ স্বামী বলে,

 "আপনার ঘরটা কি ঠান্ডা।"


"অসুবিধা হচ্ছে !"


"না আমি সবেতেই অভ্যস্ত। গরমের দিন তো,এ সি থেকে বের হলেই গা জ্বালা করবে, তবে এসব সহ্য করা কোন সমস্যা নেই আমার।"

" ত্যাগী সন্ন্যাসী মানুষ তো!" অন্তরা রসীকতা করল না সত্যি সিরিয়াসভাবে বলল কে জানে!

"হ্যাঁ ম্যাডাম তীব্র শীতের সময়ও হিমালয়ে বরফ জমা পাহাড়ের খোলা গায়ে থেকেছি।নাগা সন্ন্যাসী হবার শখ ছিল। খুব কষ্টের, পারি নেই। তখন বয়স কম ছিল। তাই ভাবি ওদের কথা, কী অসীম ত্যাগ আর ক্ষমতা।"


"আপনি এখন কী সন্ন্যাসী!"


"ভেকধারী ভিখারী সন্ন্যাসী বলতে পারেন।"


"আপনার নাম কী হৃদয় ব্যানার্জি!"


"খানিক চমকে ওঠে হৃদয়ানন্দ স্বামী বলে,

" সন্ন্যাস নেবার আগে আমার পদবী ব্যানার্জি ছিল আপনি জানলেন কী করে।"


"আমি গনৎকার নই, তবে গোয়েন্দাদের মত আমার নজর সবাই বলে। আপনার জীর্ণ শীর্ন রুগ্ন মুখেও একটা কাটা দাগ বাম গালে,বোধহয় বাল্যকালে কেটে গেছিল বেশ গভীর হয়ে ,আর আপনার তীব্র ফর্সা গায়ের রং,ডানভ্রুর শেষটা বড় কোন অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল বাল্যের কাটা দাগ,আর ভ্রুরুর লোম ভালো গজায়নি,গলার মাঝে বড় তিল।আরো আছে।

"কিন্তু আমি তো বহুদিন সন্নাসী ,আমার এমন সব চিহ্ন কে বলল,কোথায় দেখলেন?"


"আপনার আর সুভদ্রার বড় বাঁধানো ছবিটা দেওয়ালে টাঙ্গানো আছে সুভদ্রার ঘরে,খুব নিরক্ষন করে দেখেছি যে ! সুভদ্রাকে নিশ্চয়ই চেনেন !"

খানিক চুপ থেকে সন্ন্যাসী বলে ," চললাম ম্যাডাম। আমার সমন্ধে আপনি হয়ত উনার কাছে অনেক কিছু জেনেছেন, তবে আমি এমন নই।" 

হৃদয়ানন্দ স্বামী উঠে পড়েছিল ঘর থেকে বের হতে যাবে।

অন্তরা আবেগ তাড়িত হয়ে বলে,


"আপনি পালাবেন না। আমার অনেক কিছুই আপনার কাছে জানার আছে প্লীজ। আর সুভদ্রা আপনার  বিরুদ্ধে কিছুই বলেনি, বরং ও ভীষণ অনুতপ্ত ছিল।চোখের জল ফেলত ,কিন্তু আপনার বিষয়ে নীরব থাকত।সুভদ্রার বৌদির অনেক কিছুই আপনার বিষয়ে আমাকে বলেছে।"


"সুভদ্রার দাদার বৌ!"


"ঠিক তাই, আপনার সন্তান কটি?"


"আমার তো কোন ছেলে মেয়ে নেই। "


"যখন গৃহ ত্যাগ করে সংসার থেকে চলে গেলেন আপনার স্ত্রী গর্ভবতী ছিল, আপনি জানতেন!"


"না আমার এ বিষয়ে কোন ধারনা নেই।"


"আপনার স্ত্রী তখন দু মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, তার এক কন্যা সন্তান হয় ,আপনি তাকে সন্তান হিসাবে মানবেন!"


"আমি মানার কে! যার কোন দ্বায়িত্ব নি নেই ,দেখি নেই ,আমার মানা না মানার কোন মুল্য নেই।"


"কিন্তু আপনার স্ত্রীর গর্ভের বাচ্চাটা আপনার না হয়ে অন্য মানুষের হতেই পারে!"


"মা তো সন্তানের পিতা কে জানে!এমন তো অনেক হয় ,জন্মগত বাবা আর সামাজিক পচিচয়ে বাবা পৃথক হয়। মা যা বলে সেটাই মান্যতা দেওয়া হয়। এমন কত উদাহরণ আপনি নেবেন!"


"এই সভ্য যুগে এ আপনি কি বলছেন! এখন তো জেনেটিক বাবা জিন বিশ্লেষণ করে সনাক্ত করা যায়। তা ছাড়া অনেক সন্তান বাবার মত হুবহু দেখতে হয়, নেচার হয়। মা কী বলল,সেটাই কী সব!"


"আমি এসব নিয়ে ভাবি না।সন্ন্যাস নিয়ে সংসারের জটিল সমস্যায় যেতে চাই না।"


"সুভদ্রা বলেছে,আপনার সন্তানের দেহগত গঠন রং মুখচোখ আর মানসিক দিক একমত ।"


"সুভদ্রা কী বলল, আমার কী! আমার কিছু যায় আসে না।"


"কিন্তু আমার অনেক কিছু যায় আসে!"


"ঠিক বুঝলাম না।"


"হৃদয় ব্যানার্জী আমার বাবা,আমার জেনেটিক ফাদার, যদি হৃদয়ানন্দ স্বামী তা অস্বীকার করে জেনেটিক পরীক্ষা করতে পারে,আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো।"


হৃদয়ানন্দ স্বামী অনেকক্ষণ মাথা নামিয়ে বসেছিল। ডক্টর অন্তরা বলল, 

"আপনার কিছু বক্তব্য আছে?"


"আমার তো কিছুই নেই নিঃস্ব, আমার পিতৃ স্বীকৃতি আপনার কী লাভ হবে! বরং কলঙ্ক। এক ভিখারী ভেকধারী সাধুর কন্যা লোকে অবজ্ঞা করবে।"


"আমার টাকার চাহিদা নেই। আর আপনার পরিচয়ে আমার পরিচয় নয়।আমার নিজস্ব পরিচিত আছে।মনের আত্মতৃপ্তি,জন্ম স্বীকৃতি আর জন্ম দাতাকে দেখা ভীষণ আকাঙ্খা ছিল। সবার বাবার আদর ভালোবাসা পায় আমি বঞ্চিত। তবু --"


হৃদয়ানন্দ স্বামীর চোখে জল,বলে,

 "আমি আপনার যদি অধম জন্মদাতা হইও, সন্তান যে স্ত্রীর গর্ভে জন্মেছে তাই জানতাম না।তাই আমি সন্ন্যাসী বেশে বেশ তৃপ্ত ছিলাম, আজ নিজেকে ভীষণ নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে। আপনি আমাকে পিতা হিসাবে ধিক্কার দিতেই পারেন। "


"আপনি কোন অন্যায় পথে যান নি। বুদ্ধদেব তো সন্তান ছেড়ে সন্ন্যাস নিয়ে গৃহ ত্যাগী , তাঁকে কেউ তো সন্তানের প্রতি অবহেলার জন্য দায়ী করে না। আর আমি যত টুকু শুনেছি, আপনাকে লাঞ্ছিত করে মারধর করে শ্বশুর বাড়ি থেকে দুর করা হয়।আপনি গরীবের সন্তান ,আমার মামার বাড়িতে কাজ করতেন। আমার মা শারীরিক প্রতিবন্ধী, তিনি আপনার রূপে প্রেমে মোহগ্রস্থ হয়, দাদুর কাছে বায়না করে বলে,আপনাকে বিয়ে করতে চায় । দাদু আপনার সম্মতি পেলে বিয়ে হয়।

আমার মামার এটা পছন্দ ছিল না।মায়ের বিয়ে হবে তার চিন্তায় ছিল না।সম্পত্তি ভাগ হবে মেনে নিতে পারেনি।আপনি সরল মনে বাড়ি ষোল সতের বছরের পরিচালিকাকে ভালোবাসতেন বোনের চোখে।চক্রান্ত করে আপনার সাথে তার নোংরা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রমাণ করেছিল মামা।টাকার লোভে ঐ পরিচালিকা চুপ ছিল।মা বড়লোকের মেয়ে দম্ভ অহংকার একটু বেশী,রূপসী নয় পা দুটো পোলিও তে বাঁকা, দুর্বল, লাঠি দিয়ে কোন মত এঁকে বেঁকে চলত।

মানসিক হীনমনত্যা আর অর্থের অহংকার , দাদা ইন্ধনে পাগল হয়ে,চরিত্র হীন লমপট ষোল বছরের দাসীর সাথে নোংরামী এমন স্বামীকে সহ্য করতে পারেনি। তাই তোমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে বলেছিল। মামা সেই সুযোগ খুজছিল, তোমাকে সেদিন বেদম মারধর করে বাড়ী থেকেই দুর করে দেয়।তোমার কথা সেদিন কেউ বিশ্বাস করেনি।তুমি দুঃখে যন্ত্রণায়, সেদিন বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিলে।"


অন্তরা অনেকক্ষণ চুপ থাকে।


হৃদয়ানন্দ স্বামী নীরবে ভাবলেশহীন মনে মাথাহেঁট করে বসেছিল।


অন্তরা বলে " তুমি নির্দোষ এটা দুদিন পর জানা গেল ঐ পরিচালিকার বাবা, সর্পঘাতে মারা গেল ও কাঁদতে কাঁদতে সব কথা প্রকাশ্যে বলল , তুমি তাকে ভগ্নির চোখে দেখতে। বন্ধ ঘরে অটকে তোমাদের কেচ্ছা কান্ড পরিকল্পিত সাজানো।সেদিন পরিচালিকা নীরব কান্নাকাটি করেছিল, আর মামার কাছে অনেক টাকা পেয়ে বাড়ির কাজ ছেড়ে পালিয়েছিল। তোমার নির্দোষ প্রমাণে কোন উপায় ছিল না,এক মা যদি তোমাকে সমর্থন করত বা বিশ্বাস রাখত। মা তা করেনি,দাদার মিছে দরদ আর ছলনায়, ক্ষোভ অভিমানে তোমাকে সন্দেহবশত চরম ঘৃনা করেছিল।

সব সত্য প্রকাশিত হলে দাদু ভীষণ রেগে আর্দ্ধেক সম্পত্তি মায়ের নামে করে দিয়েছিল, তোমার বাড়ি ছুটে গেছিল, তারা কিছুই জানত না।তোমার বাবা ছিলেন না,মা কান্নাকাটি করেছিলেন,আত্মীয়স্বজন বলছিল তোমার সন্ধান পেলেই আমার দাদুকে জানাবে।তোমার সন্ধান এই দীর্ঘ দিন কেউ পায়নি।

মা ভীষণ আফসোস করত কাঁদতো,এই দীর্ঘ একত্রিশ বত্রিশটা বছর। তোমার সন্তান মায়ের গর্ভে দাদু জানতে পেরে খুব খুশী,দাদু তোমাকে বিশ্বাস করতেন স্নেহ করতেন কিন্তু এই চক্রান্তে দাদুও দিশেহারা ছিলেন। ভেবেছিলেন তোমার মত সুন্দর গরীবের ছেলে, সম্পত্তির লোভে নিশ্চিত ভবিষ্যত জন্য বিয়ে করলেও আমার মাকে নিয়ে তুমি তৃপ্ত নয়।


তোমার ছবি ঘরে আজও টাঙ্গানো আছে।গতবছর মা মারা যায়।মৃত্যুর আগে অবধি তোমার ছবি সকালে উঠে মা প্রথমেই দেখত, খুব আশা করত একদিন তুমি ঠিক ফিরে আসবে।বলত মানুষটাকে ভুল বুঝে, মহাপাপ করেছি, নরকভোগ করছি।তবে তার মাতৃত্বের জন্য ,তোমার প্রতি খুব কৃতজ্ঞ ছিল, বলত কে আমাকে বিয়ে করত !

বলত আমার সম্বন্ধ আসত না।মামা দাদুও চাইত না প্রতিবন্ধী মায়ের বিয়ে হোক।মা আরও বলত এত রূপ, এত রং, এত বুদ্ধি সব তোর বাবার জন্য।ও যদি থাকত কত খুশী হত। আমি তোমার ছবিটা খুব দেখতাম প্রায় প্রতিদিনই। আজও বাড়ি গেলে দেখি আমার বাবা,আমি জন্মেছি তাই জানে না,খুব দুঃখ হয় কান্না পায়। তুমি বেঁচে আছো, তাই জানতাম না ,কিন্তু মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তুমি বেঁচে আছো একদিন ঠিক ফিরে আসবে।"

হৃদয়ানন্দ স্বামী একটা কথাও বলেনি, মাথা নামিয়ে চুপ চাপ সব শুনছিল।

অন্তরা জিজ্ঞেস করে" তুমি কিছুই বলছ না কেন ?"


ভারাক্রান্ত মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেমন উদাস কন্ঠে বলে,

"এই বত্রিশটা বছর আমার মনে যে যন্ত্রণা ছিল আজ তার দ্বিগুণ বাড়ল। কন্যার প্রতি স্নেহ ভালোবাসা দিতে না পারা, আর তোমার মা আর নেই এসব জেনে আমি ভীষণ ভারাক্রান্ত লাগছে।এসব না জানার কারনে আমি অনুতপ্ত ছিলাম না, নিজেকে হতভাগ্য দুখী ভাবতাম, হতাশগ্রস্ত ছিলাম।

মিথ্যা অপবাদ আর মারধর চরম লাঞ্ছিত করে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে ছিল। তখন খুব মনে কষ্ট হত,এখন আর এসবে মনে কিছু হয় না।তোমার মা ভুল করছিল কিন্ত, এই ভুলের জন্য সে অনেক বড় শাস্তি পেলো ! সব ঈশ্বরের লীলা।আমি সেদিন খুব দুঃখে হতাশায় হরিদ্বার চলে যাই। এক আশ্রমে আশ্রয় পাই, সন্ন্যাস নিয়েছিল।

খুব সুখের জীবন নয়।বড় কষ্ট যন্ত্রণার ইতিহাস, তোমাকে পরে কোনদিন দেখা হলে বলব।গতবছর গঙ্গা সাগর মেলায় এসেছিলাম, তারপর আর হরিদ্বার যায়নি।শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।এ শহরে একবছর আছি।আমার অনেক কলেজ জীবনের সহপাঠী পূর্ব পরিচিত বন্ধু বান্ধব আছে। আমাকে ওরা ভিখারী বা সন্ন্যাসী যেভাবেই হোক একটু দয়াদাক্ষিন্য করে।

আজ আমি উঠি মা। বাবার হওয়ার কোন যোগ্যতা আমার নেই,কুকুর বিড়ালের মত,শুধু জন্ম দিয়েছি"

"কিন্তু আমি তো তোমাকে ছাড়বো না বাবা ! তুমি আমার কাছেই এবার থাকবে ।"


"সেটা কী করে সম্ভব মা! আমি ভিখারী, তোমার তাতে সমাজে সংসারে স্বামী শ্বশুরের কাছে আমার জন্য মান হানি হবে।"


"আমি নিজের যোগত্যায় কাজ করি,উপার্জন করি আমার বাবাকে আমার কাছে রাখব,এটা আমার সিদ্ধান্ত, অন্যের কথায় আমি চলি না।আর আমার শ্বশুর স্বামী ভালো মানুষ, আমাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়।"

খানিক থেমে অন্তরা বলে,

 "মামার কথা বলা হল না ।জানো ওর কী হাল!"


"আমার মা আর এসব ভালো লাগে না।"


"কিন্তু যে মানুষটার জন্য আমি বাবার স্নেহ আদর বঞ্চিত ,মা স্বামীর ভালোবাসা পেলো না আর তুমি চরম কষ্টে দারিদ্র্যতায় পথের ভিখারী। চরম দঃখ লাঞ্ছনা আর হতাশায় ভুগছ,অসুস্থ। কেন কী দোষ ছিল!

পরিচালিকাকে বোনের মত স্নেহ করতে বিশ্বাস করতে,আর মামার সম্পত্তির ললসায় সব শেষ করেদিল।মামা আজ বারো বছর ধরে পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী।গায়ে ঘায়ে গলে গেছে,ছেলে বৌ, মামীমা সবার কাছে পাপ। ওর মৃত্যু সবাই কামনা করে।আর তাদের জন্য সম্পত্তির লালসায় কত সর্বনাশ আমাদের জীবনে করেছিল।"

হৃদয়ানন্দ স্বামী কেমন এতক্ষন উদাসীন ছিল এবার খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,

"বেশ তো ছিলে মা,আবার এই হতভাগা কুপয়াকে নিয়ে নিজেকে বিপদে ফেলো না। আমাকে আমার মত থাকতে দাও ,তবে আমার সন্তান এত সুন্দরী এত বড় মাপের মানুষ ! ভাবতে মনটাও বড় গর্বে ভরে হচ্ছে, যদিও তাতে আমার কোন অবদান নেই।"


"তুমি ভুলে যাচ্ছ বাবা,মা কিন্তু প্রায়ই বলত,তোর রূপ রং বুদ্ধি মেধা আর মানসিকতা ঠিক বাবার মত।তোমার অভাব জন্ম থেকেই অনুভব করতাম। এটাও মায়ের মুখে শুনতাম, আমি গর্ভে জন্মেছি তুমি জানতেই না,তাই তুমি নির্দোষ কন্যাকে স্নেহ দিতে পারোনি সেটা দুর্ভাগ্য তোমার আমার সবার ।

তবু আমার জীবনে সাফল্য পেতে কোন অসুবিধা হয় নি।তোমার অস্তিত্ব সদা আমার সঙ্গে অনুভব করতাম।

আমি তোমাকে আর কাছ ছাড়া করব না।মা নেই তুমি আমার সঙ্গে থাকো। আমার এই আবদার তুমি ফেলে দিও না।"


খানিক চুপ থাকে হৃদয়ানন্দ চোখ দুটো জলে চিক চিক করেছিল বলল,

"তোমার আবদার ফেলার সামর্থ্য এক হতভাগ্য বাবা হিসাবে নেই ।তবে আমি তো সন্ন্যাসী।মানুষ ভিখারী বলে তাতে আমার দুঃখ লজ্জা নেই আর তো কবছর। বেশ থাকব। তুমি মা আমাকে কিছু ভিক্ষা দিতে পারো,আর অভাবে পড়লে তোমার কাছে নিশ্চয় আসব,তোমার ভালোবাসা করুনা পেলে আমার মন তৃপ্ত হবে।"


অন্তরা বুঝেছিল তার বাবা তার মতই আত্মসম্মানী ভোগের লালসা নেই। মা তাকে পছন্দ করেছিল তার ভালোবাসায় মুল্য দিয়ে ঘর জামাই হয়েছিল। ধনীর কন্যা বলে তার অর্থ লোভ নয়। এক নারীর ভালোবাসার ইজ্জত ,মা সেটা মাঝে মাঝেই বলত। দেখতে সুন্দর সে যুগে গ্রাজুয়েট দারিদ্র্যতার কারনে,তার বাবার ধানের আড়তে ম্যানেজার কাজ করত।

হাঁটা চলাফেরার খুব সমস্যার, তাই অন্তরার মা, ইস্কুলে যাওয়া হয়নি। তার তখন পরিনত বয়স, প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রতিদিন রাতে আটটার পর দুঘন্টা সময়, ষোল সতের বছরের সুভদ্রাকে, গৃহ শিক্ষক হিসাবে হৃদয় টিউশন পড়াত।এজন্য তাকে ভালো পারিশ্রমিক পেতো।

 এই বাড়িতেই সে খেতো তারপর বাড়ির বাইরে রাতে বৈঠকখানায় হৃদয় শয়ন করত। এবাড়ীর এক সদস্য হয়ে গেছিল।তখন অন্তরা মায়ের সাথে বিয়ে হয়নি ঘর জামাই ছিল না। বয়সও বত্রিশ তেত্রিশ, বিয়ে নিয়ে কোন ঝোঁক ছিল না। কোন ভবিষ্যত পরিকল্পনা ছিল। উদাসীন মানুষ, যা আয় হত গরীব মাকে, আর সংসারেই সিংহভাগ দিতো।

টিউশন পড়াশোনার থেকেই অন্তরার মা হৃদয়ের প্রেমে পড়েছিল। এই প্রেম এক তরফে হলেও,হৃদয় প্রতিবন্ধী মেয়েটির আশাহত করেনি । আর সেই সঙ্গে তাকে আশাহত করলে এ কাজ ছাড়তে হত। সুভদ্রাকে আশাহত করে অসম্মানিত করে এ বাড়ী থাকা ও তার বাবার ধানের ম্যানেজারী কাজ করা হৃদয়ের পক্ষে সম্ভব হত না। বেকার যুগে দরিদ্র হৃদয় সে সবে ঝক্কীতে যায়নি ।এমনিতেই বিয়ের ব্যাপারে, মেয়ে মানুষ তাদের রূপ যৌবনের প্রতি তার এত প্রলোভন ছিল না। ধার্মিক মনোভাব আর সংসার বিরাগ বিয়ের আগেও ছিল।

হঠাৎই পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতায় এ বিয়ে করে।কিন্তু তাকে অন্তরার বোঝেনি । অকারণ সন্দেহ প্রবন সংকীর্ণ মনোভাব, আর দাদার কুটচালে, নিজের ভবিষ্যতটাই নষ্ট করেছিল।মেয়ে পিতৃস্নেহ থেকে চির বঞ্চিত হল । যদি তখন অন্তরার মা নিজেকে গর্ভবতী জানত , হয়ত একটা অন্য আপোষ রফা হত।দাদার কুটচাল কাজ হত কীনা সন্দেহ ছিল। 

অন্তরা আবেগ তাড়িত হয়ে বলে

" আমার অনুরোধ তুমি রাখবে না বাবা !"

আমাকে আর তোমার কোন প্রয়োজন নেই।আমি সমাজ সংসার যতটুকু জানি,আমার জন্য তোমার সম্মান যাবে সমস্যা হবে,আমি এতটা অধম মানুষ নই।নিজের তুচ্ছ উপভোগ আরামের কারনে মেয়ে সমস্যা বাড়াই।বাবাকে যদি সম্মান করো,আমায় আমার মতই থাকতে দাও মা।"


অন্তরা দুঃখে হতাশায় দুচোখ জলে ভরে গেছিল, বাবাকে সে ধরে রাখতে পারবে না বেশ বুঝেছিল তাই বিষন্ন কন্ঠে বলল,

"তোমার সব ওষুধ পেয়েছ!"


"যা পেয়েছি আপাতত চলে যাবে মা।আমি আবার তোমার কাছে দরকার হলেই আসব।"


অন্তরা কিছু টাকা দেবো ভাবলেও এতে বাবাকে হয়ত আঘাত করবে। শুধুমাত্র বলল,

" তোমার কিছু পোষাক পরিচ্ছদ কিনতে বা হাত খরচ মেয়ে হিসাবে তো দিতে পারি!"

"অবশ্যই মা, আমি মা আবার আসব ,সেদিন দেবে আজ আমি আসি।"


অন্তরার দুচোখ জলে ভরে গেছিল। সব কথা ফোনে স্বামীকে জানালে,অন্তরাকে অভী বলল,

" তোমার বাবা আমারও বাবা, তাই বাবাকে আমাদের সংসারে এক সঙ্গেই থাকতে বললে না কেন!"

শ্বশুর সব শুনে বিচক্ষন মানুষ বললেন, 

"তোমার বাবার পক্ষে ,এই মানসিক পরিস্থিতিতে এখন সংসারে থাকা হয়ত অস্বস্তিকর হবে।তবে

আমার তো একটা গঙ্গার সাথে ফার্ম হাউস আছে ওখানে একটা আশ্রমের মত করে দেবো ,উনি ওখানে থাকলে কোন অস্বস্তি অসুবিধার কথা নয়।আমার বয়স হচ্ছে মাঝে মধ্যেই আমি গিয়ে উনার সাথে কথাবার্ত্তা গল্প করলে, আমারও ভালো বেশ লাগবে।উনার কত অভিজ্ঞতার গল্প জানতে পারব।উনাকে ছাড়লে কেন ! জোর করে আমার কাছে আনতে পারতে,উনি আমার চেয়ে কিছু ছোট, তবু প্রায় সম সমসাময়িক, আমার কথা উনি হয়ত গুরুত্ব দিতেন।

যাক ওকে খুঁজে বের করো।দরকার হলে কাল খুব সকালেই স্টেশন চত্বরে ড্রাইভারকে নিয়ে তুমি যাও দেখলেই নিয়ে আসবে। আমার কথা বলবে।হয়ত আমার বাড়ি তুমি বৌমা লজ্জা সংকোচ করেছেন।"


অন্তরার মনে ভীষণ আফসোস হচ্ছিল। কেন সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুরের সাথে ফোনে কথা বলে উনার পরামর্শ নিলাম না! শ্বশুরের এতটা উদার বাস্তবাদী মানসিকতা অন্তরারাও ঠিক ধারনা হয়ত ছিল না।


পরদিন ভোর ভোর রেল স্টেশন চত্বর তন্ন তন্ন করে অন্তরা আর তাদের গাড়ির ড্রাইভার খুঁজেছিল।কিন্তু তারা হৃদয়ানন্দ স্বামীর কোন সন্ধান পায়নি।

অন্তরা তার শ্বশুর নিজেরা এমন কী পুলিশকে বলে হৃদয়ের বর্ণনা দিয়ে,কম বয়সের ছবি দিয়ে অনেক খোঁজ সন্ধান চালায়,কিন্তু তার আর দেখা মেলেনি।


আন্তরার এই আফসোস জীবনে যাবে না। বৃদ্ধ অসুস্থ বাবাকে কাছে পেয়েও ধরে রাখতে পারেনি।অন্তরা বুঝেছিল, বাবা যেন তারই মত ! হারতে শেখেনি। সংসারে অনীহা,সংসারের গন্ডীতে আর ঢুকতে চায় না।তাতে সে অনাহারে অপুষ্টিতে বা বিনা চিকিৎসায় মরুক কোন আফসোস নেই। এই শেষ জীবন আর কোন কিছুতেই সে আকৃষ্ট নয়। বরং যৌবনের সেই সংসার স্মৃতিচারণে সে ক্লান্ত কেমন বিভীষিকা লাগে!

যাবার সময় খুব আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েছিল অন্তরার অজ্ঞাত সন্ন্যাসী বাবা হৃদয়ানন্দ স্বামী। উল্কার মত অন্তরার জীবনে আবির্ভাব হয়েই যেন মিলিয়ে গেল। শুধুমাত্র তার বাবার শেষ কথা গুলো আজও অন্তরার কানে বাজে ।


"তুমি আজ আমার দিশাহীন জীবনে নতুন এক স্বার্থকতা দিলে।তুমি আমার আত্মজা জেনে বড় তৃপ্ত হলাম , সুখে থেকো মা, অনেক বড় হও ।"

             সমাপ্ত 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract