আজিজুন বাই
আজিজুন বাই
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় জাতি ধর্ম নির্বিশেষে দেশের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন পরাধীনতার শিকল ছেঁড়ার জন্য। ভারতের অন্যান্য জায়গার মত মুজাফফরনগর এলাকাতেও সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখা গিয়েছিল হিন্দু-মুসলিম নারীদের। আশা দেবী, বখতাভারি, হাবিবা, ভগবতী দেবী ত্যাগী, ইন্দ্র কৌর, জামিলা খান, মন কৌর, রহিমী, রাজ কৌর, শোভা দেবী, উমদা- ধর্ম ও জাতি নির্বিশেষে তাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। পঁয়তাল্লিশ বছরের আসগরি বেগমকে বাদ দিলে, এই সমস্ত মহিলারই বয়স ছিল বিশের কোঠায়। তাঁদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল কাউকে কাউকে। এই যে মধ্যবয়সিনী আসগরি বেগমের কথা বললাম, তিনিই বা কে? ১৮১১ সালে জন্মগ্রহণকারী আসগরি বেগম পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন। ১৮৫৮ সালে আসগরিকে ব্রিটিশরা জীবন্ত পুড়িয়ে দেয়। এর মধ্যে রয়েছে কানপুরের গণিকা আজিজুন বাঈ-এর কথা। সেই কানপুর, যা নানাসাহেব বা তাঁতিয়া টোপির লড়াই মনে রেখেছে, কিন্তু ভুলেছে আজিজুনকে।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অদ্ভুত চরিত্র উত্তরপ্রদেশের কানপুর শহরের আজিজুন বাঈ। সেই সময় তাঁর সাধারন পরিচিতি ছিল নাচ-গানে পটু একজন বেশ্যা। পেশাগত পরিচয়কে আজিজুন বাঈ ব্যবহার করেছেন দেশের জন্য লড়াইয়ে। আজিজুন বাই জন্মগ্রহণ করে ছিলেন লখনৌতে, কিন্তু তার একলা জীবন যাপিত হয়েছিল কানপুরে - যেখানে তিনি পরিচিত ছিলেন পেশাদারী কোঠিওয়ালি হিসাবে। যার অর্থ এই দাঁড়ায় যে তিনি একজন পেশাদার গণিকা ছিলেন। তার জীবনে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো দেখলে এটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে তিনি একজন দক্ষ কৌশলী মানুষ ছিলেন।
১৮৫৭র মহাবিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়া নানা সাহেবের দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। পুরুষের বেশ ধরে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন। কোমরে গোঁজা থাকত পিস্তল। তথাকথিত ভদ্রলোকেরা তাঁর বাড়ি এড়িয়ে চলত বলে তিনি তাঁর বাড়িকে সিপাহীদের আলোচনার গোপন ডেরা হিসেবে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখা হত সেখানে। নিজে হাতে আহত সৈন্যদের ক্ষত পরিষ্কার করা, বিপ্লবীদের লড়াইয়ে উৎসাহিত করা এবং তাদের দরকারমত অস্ত্র ও গোলাবারুদ, খাবারদাবার, আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করতেন এই মহীয়সী।
কবি মাখমুর জালুন্ধর তাঁরই উদ্দেশে লিখেছেন -
'তেরে ইয়ালগর মে তামির থি তখরিব না থি
তেরে ইসার মে তরগিব থি তাদিব না থি'
(আপনার যুদ্ধের কান্না ছিল, ধ্বংস নয়/
আপনার আত্মত্যাগ এক অনুপ্রেরণা ছিল, কোনো উপদেশ নয়)
ভেবে দেখুন, রানি-যোদ্ধাদের মতো, বিদ্রোহে তাঁর কোনো ব্যক্তিগত লাভ ছিল না। তিনি কেবল আদর্শগতভাবেই ইংরেজদের মেনে নিতে পারেননি। কানপুরের কথিত, তিনি পুরুষের পোশাক পরে, পুরুষ সৈন্যদের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে, পিস্তলে-গোলাবারুদে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধে যেতেন। ৪ঠা জুন ১৯৫৭ খৃষ্টাব্দ। নানা সাহেব সশস্ত্র যুদ্ধে যোগদানের আহ্বান জানালেন। সাড়া দিলেন আজিজুন। যেদিন কানপুরে প্রাথমিক বিজয় উদযাপনের পতাকা উত্তোলন হয়েছিল, সেদিন তিনি মিছিলে হেঁটেছিলেন।
লতা সিং তাঁর প্রবন্ধ ''মেকিং দ্য মার্জিন 'ভিজিবল' "-এ লিখেছেন, কানপুরের দ্বিতীয় অশ্বারোহী সিপাহীদের মধ্যে আজিজুন ছিলেন এক প্রিয় মুখ। সৈনিক শামসুদ্দিনের ছিলেন তাঁর প্রেমিক। তাঁর কোঠা ছিল সিপাহীদের মিলনস্থল। তিনি মহিলাদের, বিশেষত বারাঙ্গনাদের একটি দলও গঠন করেছিলেন, যারা সৈন্যদের শুশ্রূষা, অস্ত্রবিতরণের পাশাপাশি প্রয়োজনে যুদ্ধও করত। শোনা যায়, তিনি উমরাও জানের সমসাময়িক ছিলেন। ব্রিটিশদের গোপন তথ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সরবরাহ করতে গিয়ে ইংরেজদের হাতে গ্রেফতার হন তিনি। জেনারেল হ্যাভলকের জিজ্ঞাসা করেন, ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে মুক্তিলাভ না শাহদত, কী চান তিনি? দ্বিতীয়টি বেছে নেন আজিজুন।
রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের ''অন দ্য সিটি ওয়াল''-এও তো পাই ১৮৫৭ সাল ও তার নিকটবর্তী সময়ে গণিকাদের ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপের উল্লেখ। প্রকৃতপক্ষে, আরও অনেক গণিকার কোঠাই বিদ্রোহীদের আশ্রয়স্থল ছিল। ১৮৫৭ সালের পরে তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পূর্ণশক্তি নিয়ে এই কোঠাগুলিকে ধ্বংস করে। প্রাচীন সংস্কৃতি এবং চারুকলায় প্রজ্ঞা ছিল যাঁদের, সেই নগরনটীরা সাধারণ দেহোপজীবিনীতে পরিণত হন। তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়।
ত্রিপুরারী শর্মা নামে একজন নাট্যকার একটি নাটক লিখেছিলেন 'আজিজুন নিসা সান সাত্তাবন কা কিসসা '(Azizun Nisa San Sattavan Ka Kissa) যা তাঁকে শিল্পের মাধ্যমে অমর করে দিয়েছে।
কানপুরের পতনের পরও আজিজুন বাই বেঁচে ছিলেন এবং ব্রিটিশ শাসকদের হাতে তিনি বন্দী হন। তারা আজিজুন নিসাকে অন্যতম প্রধান ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে চিহ্নিত করে আর তার স্বীকারোক্তির জন্য বাধ্য করতে চায়। কিন্তু তার সৌন্দর্যের মত তার সাহস ব্রিটিশদের সেই আশা পূরণ করার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় । ফলে তারা অসফল হয়।
আজিজুন সম্পর্কে কিছু আধা ঐতিহাসিক তথ্য, যেমন নানক চাঁদের ডাইরি, প্রমান দেয় যে তার বিচার হয়।কিন্তু তারা কিছুতেই তাঁকে শাস্তি প্রদান করতে পারে নি। আজিজুনের দুর্দান্ত সাহস ও অদম্য প্রাণশক্তি প্রান্তিক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
তথ্য : আন্তর্জাল, বিভিন্ন পত্রিকা।