২৫ শে বৈশাখ
২৫ শে বৈশাখ
২৫ শে বৈশাখ
আজ খুব তাড়া ছিলো অফিস যাওয়ার। প্রতি বছরের মতো এবারেও আমাদের রেডিও স্টেশনে রবীন্দ্রজয়ন্তী। অনুষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্ব আমার উপরে। তার উপর আজকের একটা স্পেশাল অন ওয়েব সিডিউলও আছে ।খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটবে আজ। একের পর এক কল আসছে। আর তার পছন্দ মতো গান শুনিয়ে যাচ্ছি। কখনও "পুরানো সেই দিনের কথা" কখনও বা "আমার হিয়ার মাঝে"। রেডিও স্টেশন এর এই মাথা থেকে ওই মাথা পুরোদমে আজ রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত। নেক্সট কলের জন্য অপেক্ষা করছি আর তখন গান চলছে
"কেন চলে গেলে দূরে"। রবি ঠাকুরের গানের লিরিক্সের জাদুতে বুঁদ হয়ে আছি। হঠাৎই নিস্তব্ধতা ভেঙে একটা কল এলো। গলা শুনে মনে হল একটা ১৬ অথবা ১৭ বছরের মেয়ে।
"হ্যালো লাইনের ওপারে কে আছে? "
"আমি অহনা। "
"বাহ নামটা তো খুব সুন্দর। কোথা থেকে বলছো তুমি? "
"আমি বাগবাজার থেকে বলছি"
"তুমি কী করো অহনা? "
"আমি স্কুল স্টুডেন্ট।"
"আচ্ছা, অহনা আজকে সারাদিনটা তুমি কীভাবে পালন করবে?"
"আজ আমাদের স্কুলে রবীন্দ্র জয়ন্তী। আমি নাচবো সেখানে।নাচতে আমার খুব ভালো লাগে। Hobby বলতে পারো "
"বাঃ। দারুণ তো। আচ্ছা আজকের দিনে কী গান শুনতে চাও তুমি?"
"আজ একবার 'এসো হে বৈশাখ' গানটা শোনাবে?"
অনেক দিন পরে হঠাৎ আজ আমি চমকে উঠলাম গানের নামটা শুনে। একটা ফ্ল্যাশ ব্যাক। সেই শ্যামল স্যারের কোচিং। সেই কোঁকড়ানো চুল।সেই রাবীন্দ্রিক গোছের শাড়ি। কিছুটা সামলে উঠে চালিয়ে দিলাম গানটা।
২৫শে বৈশাখ :
"এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাকভুলে যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।"
সেবার শ্যামল স্যারের কোচিংয়ে বিশাল ভাবে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন হওয়ার কথা।সেইমতো একটা পাঞ্জাবি চাপিয়ে চলে এসেছিলাম।অনুষ্ঠান শুরু হলো। প্রথমেই নৃত্য মেয়েদের। লাল পেরে শাড়ির ভীড়ে হঠাৎই চোখ পরলো এক জনের উপর।নাম মহুল। অঙ্ক ব্যাচের সবচেয়ে ভালো স্টুডেন্ট। অঙ্ক ছাড়া একটা কথা বলতে শুনিনি। ব্যাচ চলাকালীন আমাদের সমস্ত ছ্যাবলামি ভুঁরু কুঁচকে একদম মাঠের বাইরে ফেলত। তাই আমাদের খুব রাগ ছিলো ওর উপর। কিন্ত আজ একদম অন্যরকম লাগলো। কুঁচকানো চুল।একটা ছোট্ট টিপ। সাদা লাল শাড়ি। "এসো হে বৈশাখ" এর সুরে ওর মুখটাকে খুব মায়াবী মনে হচ্ছিলো সেদিন। একটা কেমন রাবীন্দ্রিক ছোঁয়া। কিছুতেই চোখ ফেরানো যায় না। আর হ্যা রবিন্দ্রনাথ এর সুরে আমার সত্যিকারের প্রথম প্রেমে পরা ঠিক ওই দিনই।
২৫ শে বৈশাখ :
সেবছর কলেজে আমি চতুর্থ বর্ষের ছাত্র দিল্লীতে। ওই কোচিং গুলো ছেড়ে তখনও রবি ঠাকুর সুদূর দিল্লির কোনও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পৌছাননি।তাই বোরিং ক্লাস করতেই হচ্ছে। আর আমার সেই রাবীন্দ্রিক প্রেম মহুল এখন কলকাতায় এক কলেজে পড়ে।সেই বার প্রেমে পড়ার পর কম চক্কর খাইয়েছিলো মেয়ে।তবে সব শেষে ওই লাল পেরে শাড়ি মাথা রেখেছিল ওই পাঞ্জাবি পড়া ছেলেটার বুকে।এবার আসি আবার সেই বোরিং ক্লাসে।কি করে টাইম পাস করি ?
মহুল কে লিখেই ফেললাম :
"কি করছিস?"
"সামনে ক্যাম্পাসিং একটু পড়ছি।"
"শোন না আজ তো ২৫ শে বৈশাখ।"
"তো?"
"দেখা করবি ওই লাল পেরে শাড়িটা পড়ে?"
"দিল্লী টু কলকাতা ?"
"অনেকটা দূর তাই না ?।"
"এসব ছাড় আমায় আজ একটা গান শোনা। তোর তো RJ হওয়ার বড় শখ। ধর আজকের জন্য তুই RJ। কী গান শোনাবি?"
সেদিন হোস্টেলে এসে ওকে আমি আমার গিটারটা বাজিয়ে শুনিয়েছিলাম :
"আমার পরান যাহা চায়,
তুমি তাই, তুমি তাই গো !
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই কিছু নাই গো !"
গান শুনে একটা হাসি দিয়ে বলেছিল "সত্যি? "
আর হ্যা রবীন্দ্রনাথের গান সেদিন ওই দূরত্বকে, এক নিমেষে নিয়ে এসেছিল বুকে মাথা রাখা দূরত্বে।
২৫শে বৈশাখ :
পড়াশোনা শেষ। শখটাকে বাঁচিয়ে রাখতে এখন একটা রেডিও স্টেশন এ ইন্টার্ন হিসাবে জয়েন করা। রেডিও স্টেশনটায় খুব বড়ো প্রোগ্রাম হয় রবীন্দ্রজয়ন্তী তে।কিন্তু আমার অফিস যাওয়া হয়নি। আমি বসে মহুলের ঠিক মাথার কাছে।
"আজ তো তোর গান করার কথা ছিলো।তুই গেলিনা অফিস।"
"ভালো লাগছে না গান গাইতে।আমি আর গান গাইবো না।"
"ধুর পাগল।মানুষ সব সময় থাকে না কিন্ত ওই গানগুলো থেকে যায় সারা জীবনের জন্য।"
"তুই চুপ করবি?"
"শোন না মিঃ RJ, শোনাবি আমায় একটা গান? খুব ইচ্ছা করছে আজ তোর গলায় একটা গান শুনতে।"
"কী গান শুনবি?"
"তোর মর্জি।"
সেদিন অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওর কথা ফেলতে পারিনি। গানটা গেয়েছিলাম।
"রাত্রি এসে যেথায় মেশে
দিনের পারাবারে।
তোমায় আমায় দেখা হল
সেই মোহানার ধারে ॥
সেইখানেতে সাদায় কালোয়
মিলে গেছে আঁধার আলোয়—
সেইখানেতে ঢেউ ছুটেছে এ
পারে ওই পারে ॥
নিতলনীল নীরব-মাঝে
বাজল গভীর বাণী,
নিকষেতে উঠল ফুটে
সোনার রেখাখানি।
মুখের পানে তাকাতে যাই,
দেখি-দেখি দেখতে না পাই—
স্বপন-সাথে জড়িয়ে জাগা,
কাঁদি আকুল ধারে ॥"
এরপর থেকে রবীন্দ্র জয়ন্তীগুলোতে কেউ আর রবি ঠাকুরের গান শুনতে আবদার করেনি। শখের মিঃ RJ যে কখন জীবিকার RJ তে পরিনত হলো বুঝতে পারিনি। ইন্টার্ন থেকে পাকাপাকি ভাবে RJ হয়ে ওঠা। বাকি দিনগুলোতে কিছু হিন্দি সিনেমার গান আর ব্যান্ডের গানে রবি ঠাকুরের দেখা মেলা ভার। তাই পুরোনো স্মৃতি চাগাড় দেওয়ার সুযোগও কম। কিন্তু আজ বড্ড ওর মুখটা ভেসে আসছিলো প্রতিটা গানের লাইনে। মনে হচ্ছিলো আরেকবার যদি ওর সেই ... না টপটপ করে জল পড়তে লাগলো। ইতিমধ্যে গানও শেষ। এরপর আর কোনও কল নিলাম না। সোজা চালিয়ে দিলাম ...
"মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে
একেলা রয়েছ নীরব শয়ন-'পরে
প্রিয়তম হে, জাগো
জাগো জাগো ॥"
কলেজে পড়াকালিন হঠাৎই মাথা ঘুরে পরে যায় মহুল।এরপর আরো কয়েকবার হয় এরকম। সব টেস্ট করার পর রিপোর্ট আসে ব্রেন টিউমার।সেদিনের সেই রাবীন্দ্রিক সাজে সজ্জিত মেয়েটার মুখ সেদিন খুব অচেনা লেগেছিল ।মাথায় নেই একটাও চুল।তবু সে আমার জন্য পড়েছিল সেই লাল পেরে শাড়িটা।"কী সুন্দর লাগছে তোকে রে মহুল" এর উত্তরে ও বলেছিল "চুল ছাড়াও রাবীন্দ্রিক লাগে তাই না? "।
প্রতিটা বছর এই দিনটা আসে কিছু পুরোনো স্মৃতি নিয়ে।আমাদের ভালোবাসার কোনও না কোনও মুহূর্ত কিন্তু রবি দাদুর গানের ঝুলিতে মজুত থাকে।আমরা বের করে নি একেকটা গান সেই ঝুলি থেকে । আমার আর মহুলের জন্য কোনও গান লিখে জাননি তিনি হয়তো কিন্তু জীবনের প্রতিটা মোরে দাঁড়িয়ে আমি উপলদ্ধি করেছি একেকটা মুহুর্ত যেনো, ওই গানগুলো কে ছুঁতে বদ্ধপরিকর । আর এখানেই এই ২৫ শে বৈশাখ আর পাঁচটা দিনের থেকে একদম আলাদা।আমি জানি আগামী প্রতিটা বছর ২৫ শে বৈশাখ আসবে , নিয়ে আসবে মহুলকে সঙ্গে করে।বাকি দিনগুলি না হোক বাকি গানের ভীড়ে ঘুমিয়ে থাকুক "ও" কোনও এক নির্জন দ্বীপে।